২০২০, কোভিডের লন্ডন ও একটি লাল গাড়ী
প্রকাশিত : ০৯:১৩, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
২০২০ শেষ হয়ে এলো। এ বছরটি পুরো মানবজাতির জন্যে অভূতপূর্ব, অদৃষ্টপূর্ব, অশ্রুতপর্ব। গত ১০০ বছরে কোভিডের মতো মহামারী দেখেনি সারা বিশ্ব। আমাদের সবার জন্যে এ বছরটি সংজ্ঞায়িত হয়েছে এবং প্রভাবিত হয়েছে কোভিড দ্বারা। হ্যাঁ, ঘটেছে বহু কিছু এ পৃথিবীতে ২০২০-এ, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে কোভিডই আমাদের জীবনের বাস্তবতা এ বছরের। তাই আমার দেখা একটি জীবনের বাস্তবতার কথাই লিখলাম।
প্রথমে চোখে পড়েনি, কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই দৃশ্যটি দৃষ্টি কাড়লো। না কেড়ে উপায় নেই। সময়টা এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ। লন্ডনে তখন করোনার মৃত্যু মিছিল চলছে। টেলিভিশন দেখতে পারি না, ভাঁজ করা সংবাদপত্র খুলি না, বিবিসি এড়িয়ে চলি সযত্নে। তবু শুনতে পাই, বৃটেনে প্রতিদিন এক হাজারের মতো মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে করোনার কারণে- তার একটা বড় অংশই বৃদ্ধাশ্রমে। লন্ডনের রাস্তা-ঘাট প্রায় জনশূন্য, কোনও গাড়ী-ঘোড়া দেখি না কোথাও, দোকান-পাট বন্ধ, মানুষ নিজেকে আটকে ফেলেছে স্বগৃহের চৌহদ্দিতে।
আতঙ্ক এতো ঘন হয়ে জমেছিলো চারদিকে যে, মনে হয়- মাখনের ছুরি দিয়ে তাকে কাটা যাবে। ভয়ে বারান্দায় পর্যন্ত বেরুতাম না। মনে হতো চারদিকে করোনা-সর্পরা ওঁৎ পেতে বসে আছে- বেরুলেই ছোবল দেবে। সকালেই জানালার ধারের লেখার টেবিলে বসি- লিখি, রাস্তার ওপারের ঝাঁকড়া গাছটা দেখি, নীল আকাশের দিকে তাকাই। মনে হয়, করোনা মানুষকে বন্দী করেছে, কিন্তু প্রকৃতিকে মুক্ত করে দিয়েছে।
এর মধ্যেই একদিন চোখে পড়ল একটি ছোট লাল গাড়ী- তারপর প্রতিদিনই সেটাকে দেখি। প্রত্যেক দিনই গাড়ীটি রাস্তার ওপারে এসে থামে। একই জায়গায় নয়- কখনও ফটক থেকে এগিয়ে, কখনও বা পিছিয়ে এবং একই সময়েও নয়- কখনও সকালে, কখনও দুপুরে, কখনওবা বিকেলে। গাড়ীটির চলে যাওয়ার সময়ও ভিন্ন- তবে সন্ধ্যে সাতটার পরে ওটাকে কখনও দেখিনি।
গাড়ী থেকে নামেন মাঝবয়সী বিরল কেশ এক ভদ্রলোক। ঢিলেঢালা পোশাক পরা। তাঁর হাতে কখনও থাকে একটি কাপড়ের থলে, কখনও তিনি শূন্যহস্ত। আন্দাজ করি, থলেতে বাজার করা সামগ্রী ও সেই সঙ্গে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র থাকে। আমি অবাক হই, এ করোনার কালেও তিনি প্রতিদিন রাস্তায় বের হন, গাড়ী চালান। সবদিনই দেখি, লাল গাড়ী থেকে নেমে তিনি গাড়ীর দরজা আটকান তারপর ধীর পায়ে ফটক পেরিয়ে সামনের দিকে এগোন।
যে ভবনটির দিকে ভদ্রলোক এগোন, সেটি একটি বৃদ্ধাশ্রম। আমার জানালার উল্টোদিকে রাস্তার ওপারের ওই বৃদ্ধাশ্রমটিকে আমি বহুদিন ধরেই চিনি। করোনা সঙ্কটের আগে ঐ ভবনের নানান জানালার লেসের পর্দা দেখতাম, চোখ যেত ভবন প্রাঙ্গণের দিকে যেখানে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা ধীর পায়ে হাঁটছেন, পরস্পর গল্প করছেন। কখনও কখনও তাঁদের কারো কারো সঙ্গে পরিচর্যাকারী থাকেন। ছুটির দিনে দেখতাম বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকদের আত্মীয়-স্বজনেরা আসছেন তাঁদের দেখতে। বোঝা যেত, হাসি-ঠাাট্টা, গাল-গল্প চলছে সেখানে। সুসময়ে এটাই তো ছিল পরিচিত দৃশ্য ঐ বৃদ্ধাশ্রমে।
করোনা পরবর্তী সময়ে এ দৃশ্যপট বদলে গেলো। কেমন একটা থমথমে ভাব বৃদ্ধাশ্রমটিকে ঘিরে। ঘরে ঘরে আর বাতি জ্বলে না, ভবন প্রাঙ্গণ জনশূন্য, কাউকেই দেখি না বাইরে, স্বজনদের আসা-যাওয়ায় ভাটা পড়েছে, পরিচর্যাকারীদের সংখ্যা তলানীতে এসে ঠেকেছে। কাউকেই বৃদ্ধাশ্রমের ফটক পেরিয়ে ঢুকতে বা বেরুতে দেখিনা। শুধু মাঝে মাঝে কাউকে কাউকে বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকদের জন্যে খাবারের থলে হাতে আসতে দেখি। মনে হয়, এ যেন এক মৃতপুরী।
মনে আছ, কোনও এক ভোর রাতে ঐ বৃদ্ধাশ্রমের সামনে এ্যম্বুলেন্সের শব্দ শুনে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। দুরু দুরু বুকে ভাবছিলাম, কারো কি কিছু হলো! পরের দিন খোঁজ নিয়ে জানলাম, এমনি নিয়মিত চক্করে এসেছিলো এ্যাম্বুলেন্স- কোনও অঘটনের কারণে নয়।
এই সব যখন ভাবছিলাম, ততক্ষণে ভদ্রলোক পৌঁছে গেছেন মূলভবনের দরজায়- তারপর ভেতরে মিলিয়ে গেলেন। পড়ার টেবিলে লিখতে লিখতে বেশ কিছুটা পরে চোখ তুলে দেখি, ভদ্রলোক একজন অতি বৃদ্ধার হাত ধরে বেরিয়ে আসছেন। ছোট খাটো বৃদ্ধাটির শণের মতো সাদা চুল, গায়ে নীল রঙ্গের একটি শীতের কোট, পরনে হাল্কা গোলাপী প্যান্ট, পায়ে গোলাপী প্যান্টের সঙ্গে মিলিয়ে গোলাপী কেডস। বৃদ্ধার শরীর বার্ধ্যকের ভারে একটু নুয়ে পড়েছে সামনের দিকে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম কি পরম যত্নে ভদ্রলোক বৃদ্ধাকে ধরে প্রাঙ্গণের দিকে নিয়ে গেলেন, অশেষ মমতায় তাঁকে ধরে বৃদ্ধার ধীর পায়ে হাঁটার সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। দূর থেকে বুঝতে পারছিলাম, তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে গল্প করছেন মৃদু স্বরে। বড় ভালো লাগলো দৃশ্যটি। আন্দাজ করলাম- তাঁরা দু’জনে মা-ছেলে।
তারপর থেকে তাঁদের দু’জনকে প্রায়ই দেখি। আস্তে আস্তে একদিন তাঁরা দু’জনে ফটক খুলে বাইরে এলেন হাঁটতে। আমার জানালার পরে রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকের পায়ে চলার পথে তাঁরা হাঁটেন। সেই মায়াময় ভঙ্গি আগের মতোই। বুঝতে পারি, মা’কে নিয়ে হাঁটাতে বেরিয়েছেন ভদ্রলোক- যা হয়তো বৃদ্ধা মহিলার জন্যে অত্যাবশ্যকীয়। বৃদ্ধার দিকে তাকালে বোঝা যায়, যৌবনে দুর্দান্ত সুন্দরী ছিলেন তিনি। কি আদুরে দৃষ্টিতে তাকান তিনি ছেলের দিকে। মাঝে মাঝে তাঁদের মৃদু হাসির শব্দ শুনি আমি আমার জানালা থেকে। কোনও কোনও দিন তাঁরা অনেকটাই হাঁটেন, কোনও কোনও দিন একটু হেঁটেই তাঁরা ফেরত যান। সে সব দিনে বৃদ্ধাটি হয়তো ক্লান্ত বোধ করেন।
গত তিন মাস ধরেই এ কেমন এক নেশায় পেয়েছে আমার। সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করি, কখন লাল গাড়ীটি আসবে, কখন মা-ছেলেতে হাঁটতে বেরুবেন, কখন তাঁদের মায়াময় মমতার ভঙ্গিটি দেখবো। এ করোনা প্রকোপকালে মা-ছেলের এ সঙ্গ, এ যৌথ সময় কাটানো আমার বড় ভালো লাগে। বুঝি, ভদ্রলোক প্রতিদিনের বেশীর ভাগ সময়টাই কাটান তাঁর মা’কে সঙ্গ দিয়ে, তাঁর সঙ্গে গল্প করে, তাঁর দেখাশোনা করে। হয়তো বহুদূর থেকেই তিনি আসেন, আসতে হয়ত অনেক সময়ও নেয়- তবু তিনি আসেন। ছেদ পড়েনি তাতে একদিনের তরেও। আসলে চূড়ান্ত বিচারে, সময় আর ভালোবাসাটুকুই তো আমরা একে অন্যকে দিতে পারি।
কিন্তু এমনই কি চলতে থাকবে দিনের পর দিন? বোধ হয়, না। একদিন হয়তো ভদ্রলোক আর আসবেন না। হয়তো তাঁর আসারও কোনও প্রয়োজনও হবে না। করোনা শেষ হবে। সব পরিচর্যাকারীরা ফিরে আসবেন ঐ বৃদ্ধাশ্রমে। ‘আবার জমবে মেলা’ ঐ ভবনকে ঘিরে।
কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা- কোনও একদিন হয়তো ঐ ভদ্রলোকের বৃদ্ধাশ্রমে আসার কারণটিও ফুরিয়ে যাবে। একদিন তাঁর অতিবৃদ্ধা মা পৃথিবীর মায়া কাটাবেন। তখন ঐ লাল গাড়ীটিকে আর কোনদিন বৃদ্ধাশ্রমের সামনে দেখা যাবে না। ‘গডোর প্রতীক্ষায়’-এর মতো আমি অপেক্ষা করবো সকাল-সন্ধ্যে একটি লাল গাড়ীর জন্যে। কিন্তু সে গাড়ীর আর দেখা পাবো না। কে জানে, হয়তো তখন আমিও এ বাড়ীতে আর থাকবো না, খুঁজে নেবো অন্য কোনও ঠিকানা। হয়তো...।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।