তাঁহারে আমি নমি
প্রকাশিত : ১০:৪০, ৫ জানুয়ারি ২০২১
ঠিক ৮৫ মাস আগে এই দিনে ৮৫ বছরে ‘মাদিবা’ আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন। ঐ এক নামেই তাঁকে জানতো আর ডাকতো সারা দক্ষিণ আফ্রিকার লোকজন। ও নামেই তাঁকে স্মরণ করে তারা এখনও তাঁর কথা উঠলেই। নিজের চোখেই তো দেখেছি, কি শ্রদ্ধা, কত ভালোবাসা আর কেমন মমতা ঝরে পড়ে তাদের চোখে-মুখে যখনই তারা ঐ নামটি উচ্চারণ করে।
সারা বিশ্ব অবশ্য তাঁকে জানতো নেলসন ম্যান্ডেলা বলে। ওটা তাঁর পোশাকী পূর্ণ নাম নেলসন রোলিলাহলা ম্যান্ডেলার সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। কিন্তু দক্ষিন আফ্রিকার আপামর জনতার কাছে তিনি ছিলেন শুধুই ‘মাদিবা’- যে গোত্রে জন্ম নিয়েছিলেন তার স্মরণে। বড় আদরের ডাক এটা, বড় মায়ার, আর বড় মিষ্টি।
সশরীরে তাঁকে দেখেছিলাম একবারই- খুব কাছে থেকে নয়, আবার খুব দূরত্বও ছিল না। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষন দিতে এসেছিলেন ১৯৯৪ সালের ৪ অক্টোবর। দক্ষিন আফ্রিকার প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান যাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল জাতিসংঘে ভাষন দিতে।
সাধারণ পরিষদ সে দিন উপচে পড়ছিল মানুষের ভীড়ে। দক্ষিন আফ্রিকার রাষ্ট্রপতির ভাষন শুনতে নয়- শুধুমাত্র ম্যান্ডেলার কথা শুনতে, তাঁকে দেখতে। জানি, ১৯৭৪ সনে বঙ্গবন্ধু যখন সাধারণ পরিষদে ভাষন দিয়েছিলেন, তখনও এমন আবহের সৃষ্টি হয়েছিল। গর্ব অনুভব করি এটা ভেবে যে, সে ভাষন ছিল বাংলায়। তবে সেটা দেখার সৌভাগ্য তো আমার হয় নি।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলাম ম্যান্ডেলার বক্তৃতা। একটা কথার অনুরনণ এখনও রয়ে গেছে হৃদয়ে - ‘যেটা অসম্ভব বলে মনে হবে, সেটাকে জয় করার জন্য চেষ্টার ক্ষান্তি দেবে না। চেষ্টা না করলে বুঝবে কি করে যে কোনটা সম্ভব। দক্ষিন আফ্রিকার দিকে তাকিয়ে দেখো। আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করে ছেড়েছি।’ তাঁর ঐ কথাটা আন্দোলিত করেছিল আমাদের- নিজের জীবনে অনুসরন করেছি নিরন্তর।
১৯৯৭ সালে মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন উপস্হাপন করেছিলাম কেপ টাউনে। যোগ দিয়েছিলেন দক্ষিন আফ্রিকার তদানিন্তন উপ-রাষ্ট্রপ্রধান থাবো বেকি। কেপ টাউন থেকে আধা দিনের জন্য গিয়েছিলাম
‘রবেন দ্বীপে’- যেখানে তাঁর ২৭ বছরের বন্দী জীবনের ১৮ বছর কাটিয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। সারা বিশ্বের মানুষের কাছে ওখানে যাওয়া একটা তীর্থযাত্রার মতো।
‘রবেন দ্বীপে’ পৌঁছুলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল সেইখানে, যেখানে ম্যান্ডেলা সহবন্দীদের সঙ্গে পাথর ভাঙতেন। তারপর দ্বীপের এদিক সেদিক ঘুরিয়ে অবশেষে এলাম সেই কক্ষের কাছে। কক্ষ না বলে খুপরি বলাই ভালো। ছোট্ট খুপরিটির একদিনের দেয়াল ঘেঁসে একটি তোষক পাতা বিছানা, পায়ের দিকে একটি ভাঁজ করা কম্বল। অন্য দেয়ালে প্রাত্যকৃত্যাদি সারার ব্যবস্হা। একটু উঁচুতে তৃতীয় দেয়ালে মোটা লোহার শিকের সরু জানালা- যেখান থেকে এক চিলতে আকাশ দেয়া যায়।
এই ঘরে সম্পূর্ন একাকী কাটিয়েছেন ২৭ বছর কারাবাস জীবনের ১৮ বছর- সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সবার থেকে। একবছরে মাত্র ৩০ মিনিটের জন্য শুধু একজন দর্শনার্থীর দেখা পেতেন। ৬ মাসে একটি মাত্র চিঠি লিখতে পারতেন আর একটি মাত্র চিঠি পাওয়ার অনুমতি ছিল।
সেই খুপরিতে ঢুকে চোখ ছাপিয়ে জল এলো আমার। আমার শুধু মনে হয়েছিল, কেমন করে ঐ মানুষটি বেঁচে ছিলেন- উন্মাদ হয়ে যান নি, ভাঙ্গেন নি, নিরাশ হন নি। কথা বলার সুযোগ ছিল না, প্রিয়জনের মুখ দেখেন নি কত দিন, ছবিতে দেখেছি ঐ সরু গবাক্ষের শিক ধরে তাকিয়ে আছেন এক চিলতে আকাশের দিকে।
আমার জানা মতে যাঁরাই ঐ ঘরে ঢুকেছেন, তাঁরাই আবেগে আপ্লুত হয়েছেন। আমার যাওয়ার বছর ১৫ পরে আমাদের কণিষ্ঠা কন্যা গিয়েছিল ওখানে। তার সহকর্মীদের মুখে শুনেছি, ঐ খুপরিতে ঢুকে সেও ঝরঝর করে কেঁদে দিয়েছিল তাঁর পিতার মতো।
এতো কিছুর পরেও নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তির পরে তাঁর শত্রুদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। প্রতিশোধ নয়, মীমাংসার পথ খুঁজে নিয়েছিলেন, সংঘাত নয়, শান্তির পক্ষেই দাঁড়িয়ছিলেন। আমি ভাবি, এ তো মানুষ নয়, মানুষরূপী দেবতা।
আমি জানি এমন একটি মানুষ আমাদের পৃথিবীর বুকে হেঁটেছেন। বিনম্র হই এই ভেবে যে ঐ মানুষটিকে চাক্ষুস দেখার এবং তাঁর কথা সামনা সামনি শোনার অনন্যসাধারণ সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। নমিত চিত্তে বলি,
জানি বা আমি, নাহি বা জানি,
মানি বা আমি, নাহি বা মানি,
জগতে চাহিয়া, পেয়েছি আমি
তোমারি পরিচয়।
তোমারে আমি নমি।
এসএ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।