সাবেরের স্বপ্ন ও ‘জরিনা সুপার স্টোর’
প্রকাশিত : ২১:৫৬, ৯ জানুয়ারি ২০২১ | আপডেট: ২১:৫৮, ৯ জানুয়ারি ২০২১
নিজের দোকানে স্বপ্ন বোনা সাবের
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
মুঠোফোনটা ছেড়ে দিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম। একটা বিষন্ন ধূসরতায় ছেয়ে গেল গোটা অবচেতন। ফোন করেছিল সাবের। ঢাকায় আমাদের বাড়ীর উল্টোদিকে ছোট্ট একটি মনোহারী দোকান ছিল ওর। তেমন আহামরি কিছু নয়, ঢাকার পাড়ায় পাড়ায়, গলিতে গলিতে যেমনটি থাকে, ঠিক তেমনটি।
দেশে গেলেই দরকারে-অদরকারে আমি যেতাম ওর দোকানে। টুকটাক কেনার পরে গল্প হত। ঠাট্টা করতাম ওর দোকানের কোন নামাঙ্কিত ফলক নেই বলে। ও স্মিত হেসে জবাব দিত, যে দিন ওর দোকান খুব বড় হবে, সে দিন ওর দোকানের বিরাট করে নামকরণ করবে- ‘জরিনা সুপার স্টোর’। লাজুক হেসে জানান দিত, জরিনা ওর ঘরণীর নাম। বুঝতাম, ও স্বপ্ন দেখছে আরও ওপরে ওঠার।
‘আমার সব স্বপ্ন সব গুঁড়া গুঁড়া হইয়া গ্যালো স্যার’- কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলল সাবের। কোভিডের শুরু থেকেই দোকান বন্ধ ছিল তিন মাস। তারপর মাঝে মাঝে একটু-আধটু খুললেও তা না খোলারই সামিল। শেষে নামমাত্র দামে দোকান বিক্রি করে দিয়েছে সাবের। সেটা দিয়ে নানান দেনা মিটিয়েছে সে। ওর আয় বন্ধ হয়ে গেছে ছ’মাস ধরে। কাজ খুঁজেছে নানান জায়গায়। এ সঙ্কটে তাকে কাজ দেবে কে? সঞ্চয় ভেঙ্গে ভেঙ্গে এ পর্যন্ত খেয়েছে। কিন্তু আর সে পারছে না। উপায়ন্তর না দেখে সে আমাকে ফোন করেছে লন্ডনে, কিছু সাহায্যের জন্যে।
আমার লেখার টেবিলের উল্টোদিকে রাস্তা পেরিয়ে ঝাঁকড়া গাছটির দিকে তাকাতে তাকাতে সাবেরের একটি কথাই আমার করোটিতে ‘জলের মত ঘুরে ঘুরে’ কথা কইতে লাগলো, ‘আমার সব স্বপ্ন গুঁড়া গুঁড়া হইয়া গ্যালো, স্যার।’ কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিল কোভিড, কত প্রান্তিক মানুষের জীবন লন্ডভন্ড করে দিল এ সঙ্কট, কত নাজুক জনগোষ্ঠীকে আরও ভঙ্গুরতার দিকে ঠেলে দিল এ বৈশ্বিক মহামারী।
সাবেরের কথার সূত্র ধরেই বলি, করোনা সঙ্কটে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও হবে দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষেরা এবং নাজুক জনগোষ্ঠী। এর মধ্যে থাকবে বিত্তহীন বঞ্চিত মানুষেরা, প্রান্তিক গৃহাস্থালী, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী, নারীরা।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে গত তিন দশকে চরম দারিদ্র্য হ্রাস করার ব্যাপারে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে, তা ব্যাহত হবে। গত ত্রিশ বছরে বিশ্বের চরম দারিদ্র্যের সংখ্যা ১৯০ কোটি থেকে ৮৯ কোটিতে নেমে এসেছিল। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন বিশ্বে ২ লক্ষের বেশী মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমার ওপরে উঠে আসছিলো। এখন প্রাক্কলনে বলা হচ্ছে যে- কোভিডের কারণে সারা বিশ্বে নতুন করে ৫০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমার নীচে চলে যেতে পারে।
বাংলাদেশেও গত তিন দশকে চরম দারিদ্র্যের আপাতন ৪৪ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। গত ৭ বছরে ৮০ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে পেরেছে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন যে, কোভিডের ফলে এটা বেড়ে আবার ৩০-৩৫ শতাংশ হয়ে যেতে পারে। শুধু চরম দারিদ্র্যই নয়, কোভিডের কারণে সারা বিশ্বে অসমতা বৃদ্ধি পেতে পারে। এ অসমতা বাড়বে বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে, বঞ্চিত ও সুবিধাভোগীদের মধ্যে এবং গ্রামাঞ্চল ও নগরের মধ্যে।
বৈষম্য শুধু বাড়বে ফলাফলে নয় (যেমন- আয়ের ক্ষেত্রে), অসমতা বাড়বে সুযোগের ক্ষেত্রেও (যেমন- শিক্ষা, সেবার ক্ষেত্রে)। কতগুলো নাজুক জনগোষ্ঠী (যেমন- বৃদ্ধ) এ অসমতা ও বৈষম্যের সবচেয়ে বড় শিকার হবেন।
কোভিডের কারণে বিত্তবান ও বিত্তহীনতদের মধ্যে অসমতা বৃদ্ধির একটি চালিকাশক্তি হবে কর্মসংস্থান ও আয়ের প্রক্রিয়া। কোভিড-কালে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দিন এনে যাঁরা দিন খান তাঁরা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শ্রমিকেরা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীগণ, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা। কোভিড যখন সবাইকে অবরুদ্ধ করে দিয়েছে, সাধারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন বিঘ্নিত হয়েছে, তখন এ জাতীয় মানুষদের কর্মসংস্থান নষ্ট হয়েছে, তাঁদের আয়ের পথ রুদ্ধ হয়েছে। বিত্তবানদের মতো তাঁদের কোনও সঞ্চয়ও নেই, যা তারা ব্যবহার করতে পারেন জীবনধারনের জন্যে।
ইতিমধ্যেই বলা হচ্ছে যে- কোভিডের কারণে ভারতের অনানুষ্ঠানিক খাতে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বহির্বিশ্বে চাহিদা সঙ্কোচনের কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ২০ লাখ কর্মী, যার বেশীর ভাগই নারী, কাজ হারাতে পারেন। ফলশ্রুতি, আয় ও ভোগের অসমতা বৃদ্ধি।
বৈষম্য বাড়বে সেবা সুযোগেও। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই- শিক্ষার সব পর্যায়ে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা দান চলবে আগামী দিনগুলোতে। কিন্তু এ প্রযুক্তি ধনী গৃহস্থালীতে যতখানি সহজ লভ্য, দরিদ্র গৃহস্থালীতে ততখানি নয়, নগর অঞ্চলে এর প্রাপ্তি যতখানি সহজ, গ্রামাঞ্চলে ততখানি নয়। সুতরাং কোভিডের কারণে শিক্ষায় একটি অন্তর্নিহিত বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। পরবর্তী পর্যায়ে কর্মসংস্থান ও আয়ের ক্ষেত্রেও একটি অসমতার জন্ম হবে।
অসমতার প্রকোপ বেশী করে পড়বে কতগুলো বিশেষ জনগোষ্ঠীর ওপরে। রাষ্ট্রের সম্পদ সঙ্কোচনের ফলে বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের মত নাজুক গোষ্ঠীগুলোকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দেয়া যাবে না। ফলে তাঁরা আরও বিপাকে পড়বেন।
নারীরাও অসমভাবে প্রভাবিত হবেন কোভিড দ্বারা। প্রথমত: অবরুদ্ধ অবস্থায় ঘরের অভ্যন্তরে গৃহকর্ম ও সেবামূলক কাজের চাপ নারীদের ওপরে বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে সবাই ঘরেরে মধ্যে আটকা পড়ায় স্বাভাবিকভাবেই ঘরের মধ্যে মতানৈক্য, সংঘাত, খিটিমিটি বেড়ে গেছে। এর সাথে সাথে নারীদের বিরুদ্ধে গৃহাভ্যন্তরীণ সহিংসতাও বিস্তৃত হয়েছে। এ জাতীয় কর্মকাণ্ড সহিংসতার সংস্কৃতিতে আরও জোরদার করতে পারে।
দ্বিতীয়ত: নারীদের একটি বড় অংশ কাজ করেন পোশাক শিল্পে ও অপ্রতিষ্ঠানিক খাতে। সুতরাং কোভিডসৃষ্ট সঙ্কটের নেতিবাচক প্রভাব তাঁদের ওপরেই বেশী পড়বে। তৃতীয়ত: কোভিডের ফলে স্বাস্থ্যখাতের মূল লক্ষ্য যখন এই মহামারী, স্বাভাবিকভাবেই নারীদের স্বাস্থ্য সেবার নানান দিক, যেমন নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য গুরুত্ব বা অগ্রাধিকার পাবে না।
ব্যাপ্তিতে ও গভীরতায় তাই বর্তমান কোভিড সঙ্কট অভূতপূর্ব। আমরা সবাই একই নৌকোর যাত্রী। এ অবস্থায় আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের উত্তরণের পথ হতে পারে না। যুথবদ্ধতাই আমাদের পরিত্রাণের একমাত্র উপায়- এই সহজ সত্যটি আমরা যেন ভুলে না যাই। মনে রাখা প্রয়োজন, ‘নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না’।
কোভিড বর্তমান পৃথিবীতেই অসাম্যের স্থিত দেয়ালকে আরও পোক্ত করেছে এবং সেই সঙ্গে বৈষম্যের নতুন দেয়াল সৃষ্টি করেছে। সুতরাং করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুই শেষ কথা নয়, তার সৃষ্ট বিভাজিত পৃথিবীও এক বিরাট প্রশ্ন।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।