ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪

স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ও আমাদের রাজনীতি

জাহিদুল হক

প্রকাশিত : ১৫:২৯, ২৪ জানুয়ারি ২০২১

আরিফুর রহমান, ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। পারিবারিকভাবে রয়েছে রাজনীতির ঐতিহ্য।  তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের একজন কর্মী এবং নেতা। তার রয়েছে প্রায় ৪৫ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। পেশায় একজন শিক্ষক হওয়ায় সবার নিকট গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে তার। তাই ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু প্রতিবারই তিনি সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন।

২০১৪ সালের পর যখন দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ার সিদ্ধান্ত আসলো। তিনিও দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ করার আশায় ছোটাছুটি করলেন, কিন্তু নমিনেশন পাননি। তার চার দশকের অভিজ্ঞতা দলের উঁচু পর্যায়ের নেতারা আমলে নেননি। বরং তার চেয়ে কম যোগ্যতা সম্পন্ন একজন ব্যক্তিকে নমিনেশন দেয়া হলো। ধারণা করা হয়- বিশাল অর্থের বিনিময়ে তিনি নমিনেশন নিয়ে আসেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে মনোনয়নের এমন চিত্র বেশি ফুটে ওঠে। 

একটি রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের তিনটি স্তর। সর্বোচ্চ স্তরে রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রপতি, মধ্যস্তরে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদ এবং তৃতীয় স্তরে স্থানীয় সরকার। জনগণের সরাসরি ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে- তিনটি স্তরই পরিচালিত হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা। 

রাষ্ট্রকে যদি মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি হলেন মাথা। প্রধানমন্ত্রী হলেন হৃৎপিণ্ড-ফুসফুস এবং স্থানীয় সরকার হচ্ছে ধমনি-শিরা-উপশিরা। 

সাধারণত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর মধ্যে পৌরসভা এবং ইউনিয়নের এরিয়াগুলো হয় ছোট ছোট, যার ফলে সবাই সবাইকে চেনে, জানে। কে কেমন মানুষ, কতটুকু ভালো, কতটুকু মন্দ সেটাও জানে।  রাজনৈতিক দল ভিন্ন হলেও একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে সবার মাঝেই। দলীয় প্রতীক ছাড়া  নির্বাচন হলে অনেক সময় গ্রামবাসী, আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী হিসেবে পছন্দের প্রার্থীকেই সবাই সমর্থন দিত। 

কিন্তু দলীয় প্রতীকে নির্বাচন শুরু হওয়ার পর নির্বাচনী আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। দলীয় প্রতীক সবসময় ভালো প্রার্থীকে প্রদান করা হয় না। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে মনোনয়ন বাণিজ্য একটি পুরাতন সমস্যা। অর্থের বিনিময়ে অনেক সময় অযোগ্য ব্যক্তিকেই দলীয় মনোনয়ন দিয়ে দলের তৃণমূলের কর্মীদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ের নেতারা মেতে ওঠেন মনোনয়ন বাণিজ্যে, রাতারাতি বনে যান কোটিপতি!

দলের প্রতি অন্ধ সমর্থন তৈরি করতে বাধ্য করেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের। দলীয় প্রতীক থাকার ফলে অনেকাংশে নতুন নেতৃত্বের বিকাশ হয় না। নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে পাশ করা লোকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ফলে বাড়ছে স্থানীয় দ্বন্দ্ব ও কোন্দল। সেখানে বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক বন্ধন। তৃণমূলে পছন্দের প্রার্থী না আসলে বিভিন্নভাগে বিভক্ত হয়ে যায় দলীয় কর্মীরা। ফলে দেখা দিচ্ছে সংঘাত, হানাহানি, মারামারি। অতি সম্প্রতি চট্রগ্রামের কাউন্সিল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে একজনের হতাহতের খবরও পাওয়া যায়। 

সাম্প্রতিক সময়ে ৮৩টি পৌরসভার নির্বাচন হয়ে গেল। প্রথম ধাপে ২৩টি এবং ১৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপে ৬০টি। নির্বাচনগুলোতে মারামারি, খুন-খারাবি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, যানবাহন ভাঙচুর- যা হয়েছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। 

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম না বরং বাংলাদেশ আরও বেশি হচ্ছে। এবার কুষ্টিয়া পৌরসভায় কাউন্সিলর প্রার্থীর উদ্যোগে  ‘কেন্দ্রের পাশেই ১০ মণ চালের বিরিয়ানি’ পাকানো হচ্ছিল। তবে যাদের জন্য তা রান্নার আয়োজন, সেই অতিথিদের ভাগ্যে তা জোটেনি। ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই খাবার নিয়ে বিভিন্ন এতিমখানায় দিয়ে দেয়।’

প্রকৃতপক্ষে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর বিষফোঁড়ার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতেই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনেই রয়েছে মত পার্থক্য।

বিগত নির্বাচনগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর কোন্দল ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে ছিল সবচেয়ে বেশি। দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত প্রার্থী সবার আগে তার দলের প্রতি আনুগত্য বেশি দেখাবেন এটাই স্বাভাবিক। যার ফলে সামগ্রিক জনগণের উপর এর কু-প্রভাব পড়ে। জনপ্রতিনিধিদের স্বাধীনভাবে কাজ করাটাও ব্যাহত হয়। 

তাই নেতৃত্বের স্বাধীন বিকাশের জন্য দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন এখন সময়ের দাবি। সামজিক বন্ধন অটুটকরণ, মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত কমানোর জন্য দলীয় প্রতীকে নির্বাচন বন্ধের বিকল্প নেই। সেইসাথে নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। সংবিধান তাদের যতটুকু স্বাধীনতা দিয়েছে, ততটুকু ব্যবহার করতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের কথা না শুনে নিজেদের আইন অনুযায়ী চলতে হবে।

একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এসিড টেস্ট হচ্ছে নির্বাচন। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর তৃতীয় বিশ্বে একটি বড় সমস্যা। একটি দেশের গণতন্ত্র অনকাংশে নির্ভর করে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের পেছনে রয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থার ব্যর্থতা। তাই ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থার বিকল্প নেই।

লেখক- সাবেক শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এআই/এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি