ক্রিকেট উৎসব এবং বদলে যাওয়া সন্দ্বীপ-২
প্রকাশিত : ২৩:৩৮, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | আপডেট: ২০:৪৩, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১
নবনির্মিত দ্বীপবন্ধু মুস্তাফিজুর রহমান জেটি
চারদিকে সাগর ও নদী পরিবেষ্টিত জলবন্দি সন্দ্বীপের মূল প্রবেশদ্বার এখন গুপ্তছড়াকেই বলা যায়। চট্টগ্রামের কুমিরা থেকে আসার সময় এ ঘাটের কাছাকাছি এলেই দেখতে পাবেন উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। যখনই ঘাটে পা দিবেন উন্নয়নের স্পর্শ পাবেন। আপনাকে এখন আর একহাঁটু বা কোমরজলে ভিজে কিংবা কাঁদা মাড়িয়ে সমতলে আসতে হবে না। এর আগে সাগরে স্থাপন করা বয়া বাতি দেখেও আপনি উন্নয়নের আঁচ পেতে পারেন। তবে ঘাটে পা দিয়ে উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করে ভুলেও মনে করবেন না, ‘মূল প্রবেশদ্বারে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট।’ কারণ যতই ভিতরে যাবেন ততই মধু। দেখবেন শুধু উন্নয়ন আর পরিবর্তন। আর এ উন্নয়ন বা পরিবর্তন শুধু যে সরকারিভাবে হয়েছে তা নয়, বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগতো আছেই, সেই সাথে যোগ আছে প্রকৃতিরও।
বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত সন্দ্বীপ । ছবি- গুপ্তছড়া ঘাট
ঘাট স্পর্শ করলেই উন্নয়ন। আর এ উন্নয়ন হচ্ছে ‘দ্বীপবন্ধু মুস্তাফিজুর রহমান জেটি। স্থানীয় সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার কাছে‘সন্দ্বীপের পদ্মা সেতু, যা নির্মাণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ)। আরসিসি জেটির ৯৯টি পাইলের উপর ৭০০ মি: গার্ডার ও স্লাবের সমন্বয়ে ২৬৬৫ ব: মি. এই জেটিটির নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ৫০৮৪.৭৩ লক্ষ টাকা। প্রকল্প অনুমোদিত মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৫২৬৪.২৫ লক্ষ টাকা। এই নান্দনিক আরসিসি জেটিতে সংশ্লিষ্ট পোস্ট, লাইট ও ক্যাবল লেইং-এর কাজও আছে। এছাড়াও লাইটিং সিস্টেম এবং বৈদ্যুতিক কাজ জেনারেটরসহ একটি দৃষ্টিনন্দন আধুনিক যাত্রী ছাউনিও তৈরি করা হয়েছে। এতে সৌচাগারসহ ব্র্রেস্ট ফিডিং-এর জন্য একটি কক্ষও আছে। যা আমাকে আকৃষ্ট করেছে। কারণ বাংলাদেশের আর কোন স্থানে এরকম অত্যাধুনিক ব্রেস্ট ফিডিং রুম আছে কিনা আমার জানা নেই।
জেটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী
সন্দ্বীপের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি ছিল এ রুটে একটি স্টিমারসহ গুপ্তছড়া অংশে আরসিসি জেটি নির্মাণ করা। যার মাধ্যমে জনসাধারণ নিশ্চিত ও নিরাপদে নৌযান থেকে উঠা- নামা করতে পারে। এর আগে এই জেটি এবং ঘাট নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমেও কম লেখালেখি হয়নি। আমি নিজেও কম লেখালেখি করিনি। কম্পিউটারের কীবোর্ডে আঙ্গুল চালিয়ে যত কঠিন শব্দ আছে, প্রায় সব প্রয়োগ করেছি। করবো না কেন এ ঘাট এবং নৌরুটতো ভয়াল মৃত্যুপুরির মতই। আমাদের সময় থেকে কিছুদিন আগ পর্যন্ত কত মানুষের সলিল সমাধি ঘটেছে এ রুটে। এখন যিনি সংসদ সদস্য খোদ তাঁর পরিবারেরও এই ট্র্যাজেডি আছে। তিনি নিজেও একবার মরণ সাগর থেকে ফিরে এসেছেন।
রাতেরবেলা জরুরি নৌ যান চলাচলের জন্য বয়াবাতি স্থাপন
তাই আমি মনে করি উন্নত সমুদ্রযাত্রা এবং নিরাপদে নৌযান থেকে নামার দাবিতে সোচ্চার থাকা ছিল সন্দ্বীপবাসীর অধিকার। একইভাবে জেলা পরিষদ থেকে ঘাটকে বের করে বিআইডব্লিওটিসির অন্তর্ভুক্ত করে এরুটে নতুন একটি স্টিমার দাবিও তাদের অধিকার। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর ভাষায় আমাদের মহান স্বাধীনতার অধিকার। আমিও তাই মনে করি। সন্দ্বীপের মানুষের উন্নত জীবনের জন্য নানাভাবেই তারা সোচ্চার থাকতে পারেন। নতুন স্টিমার দাবি করতে পারেন। কারণ সরকারি ও বেসরকারি দুটি ব্যবস্থা থাকলে কোনটিরই একচেটিয়া থাকার সম্ভাবনা থাকবে না। অবশেষে এমপি মহোদয়ের আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টায় জেটিটি লোক চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। এটা সন্দ্বীপবাসীর জন্য বিরাট অর্জন ও স্বস্তির বিষয়। আমার বিশ্বাস জেটিটি উদ্বোধনের পর সন্দ্বীপের সবচেয়ে সুখি ব্যক্তিটি ছিলেন নিশ্চয় তিনি। যিনি এসব আলোচনা সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেও ছিলেন। আর সব সমালোচনা আলোচনার মোক্ষম জবাব দেয়ায় (জেটি উন্মুক্ত করায়) ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। আশা করি ভবিষ্যতেও কোন দাবি নিয়ে আলোচনা সমালোচনার জন্ম নিলে এভাবেই তিনি জবাব দিবেন।
সড়ক সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্য বর্ধন
এর আগে আমি যেদিন (২১ জানুয়ারি, ২০২১) সন্দ্বীপ গেলাম তখনো এ রুটের যাত্রীদের স্পিডবোট বা কাঠের বোট থেকে নেমে হাঁটু জলে এবং কাঁদায় হেটে সন্দ্বীপের কিনারে যেতে দেখেছি। আমাকে অবশ্য কাদামাটিতে পা দিতে হয়নি। কিন্তু এজন্য আমি নিজেকে একমুহূর্তের জন্যও সৌভাগ্যবান মনে করিনি। সাংসদ মহোদয় অবশ্য বলেছেন, খুব শিগগিরই এই নতুন জেটিটি উদ্বোধন করে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। তাঁর কথা সত্য হয়েছে এবং এবার আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছি। কারণ আমি সন্দ্বীপ থাকার সময়ে (২৯ জানুয়ারি) মাননীয় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এ জেটিটির উদ্বোধন করেছিলেন এবং পরের দিন থেকে সবার জন্য জেটিটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আমি ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সন্দ্বীপের মানুষের আনন্দের ভাগি হতে পেরেছি। এটা আমার জন্য একটি বড় অর্জন।
জেটিতে যাত্রীদের উঠানামা নিরাপদ করতে গুপ্তছড়া ঘাটে চলছে নদী খনন প্রক্রিয়া
আর সন্দ্বীপে আরো একটি বড় উন্নয়ন কর্মকান্ড দেখতে হলে আপনাকে দক্ষিণে পশ্চিমে উত্তরে একেবারে নদীর কিনারে যেতে হবে। সেখানেও চলছে বিরাট কর্মযজ্ঞ। মূল সন্দ্বীপকে সমুদ্রের জোয়ার এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য নির্মাণ হচ্ছে টেকসই ব্লক বেরিবাঁধ। আমরা সন্দ্বীপ থাকার সময় এ ধরনের বেড়িবাঁধের কথা কল্পনায়ও আনতে পারিনি। ১৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এই বাঁধের নির্মাণ কাজ কিন্তু এখনো শেষ হয়নি (৬০ থেকে ৭০ ভাগ সম্পন্ন)। শুনেছি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সমস্যার কারণে কাজটি আপাতত বন্ধ আছে। আশা করছি সকল প্রকার জটিলতা কাটিয়ে আসন্ন বর্ষার আগেই নির্মাণ কাজ শেষ হবে। না হলে যে লক্ষ্যে এ বেরিবাঁধটি নির্মাণ করা হচ্ছে তা ভেস্তে যাবে।
জেটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ
সন্দ্বীপের মূল ভূখন্ডের রাস্তাঘাট দেখলে মনেই হবে না এটি একটি দ্বীপশহর। ঝাঁ- চকচকে পিচঢালা রাস্তা উন্নয়ন মাথায় নিয়েই যেন শুয়ে আছে। সন্দ্বীপের উত্তর দিকে আমার যাওয়া হয়নি। পূর্ব পশ্চিম ও দক্ষিণে আমি কোন কাঁচা রাস্তা দেখিনি। এমনকি মগধরার চরাঞ্চলে যাওয়ার সময়ও পাকা রাস্তা দেখেছি। অবশ্য হরিশপুরে খোদ নতুন পৌরমেয়রের বাসভবন এলাকার রাস্তাগুলোতে সমস্যা দেখেছি। সন্দ্বীপ অনেক দিন আলোকিত ছিল না। বর্তমান সংসদ সদস্য সন্দ্বীপবাসীকে সেই অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে আসা বিদ্যুতে পুরো সন্দ্বীপ এখন দিবা-রাত্র আলোয় আলোকিত। তবে অনেকে এখনো বিদ্যুৎ বঞ্চিত আছেন। তাদেরকেও এর সুফল পেতে উদ্যোগ নিতে হবে।
সন্দ্বীপে যে প্রভূত উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে, এটি আমার কথা নয়। যখন যেখানে যে প্রান্তে গিয়েছি প্রান্তিক মানুষরাই তা বলেছেন। এর মধ্যে সাংসদ এর দলের বাইরের অন্য রাজনৈতিক দলের লোকেরাও আছেন। সন্দ্বীপের রাজনীতি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে সবাই একমত। সন্দ্বীপে প্রায় ৩৪ টি ইটখোলা থেকে ইট তৈরির পরও বাইরে থেকে ইট আসছে। তিন চার বছর পর সন্দ্বীপে টিনের বাড়ি মনে হয় হ্যারিকেন দিয়ে খুঁজতে হবে। কারণ সন্দ্বীপের সর্বত্রই চলছে নব উদ্যমে দৃষ্টিনন্দন পাকা বাড়ি তৈরির উৎসব। একইসাথে বেসরকারিভাবে নির্মিত হচ্ছে হাসপাতাল, কলেজ এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা।
তবে আমি মনে করি উন্নয়ন এখানেই শেষ নয়, জীবনযাত্রার মান বাড়ার সাথে সাথে উন্নয়নের চাহিদাও বেড়ে যাবে। আরো উন্নয়ন হবে। কালের পরিক্রমায় স্বপ্নের এই জেটিটিও হয়তো একদিন পরিত্যাক্ত হয়ে কুমিরা- গুপ্তছড়া রুটে পদ্মাসেতু না হলেও তারমত একটি ব্রিজ হয়ে আরো মহা উন্নয়ন হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। সেই রকম স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? মাননীয় সংসদ সদস্য প্লিজ সন্দ্বীপবাসীকে এরকম আরো বেশি বেশি স্বপ্ন দেখান। আজকে যা স্বপ্ন, কালকে তা বাস্তব। সন্দ্বীপে যারা থাকেন তারাও তাদের উন্নত ও নিরাপদ জীবনের জন্য আরো উন্নয়ন ভাবনা তুলে ধরেন এবং সোচ্চার থাকুন। তবে শুধু লক্ষ্য রাখতে হবে এসব উন্নয়ন যাতে কখনো খড়গ হয়ে না দাঁড়ায়।
লেখক পরিচিতি: কানাই চক্রবর্তী, উপ-প্রধান প্রতিবেদক, বাসস।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।