যুদ্ধবিরতি, নাকি পরবর্তী হত্যাযজ্ঞের জন্য শক্তিসঞ্চয়?
প্রকাশিত : ০৯:২১, ২৪ মে ২০২১
আপাতত বিশ্ববাসীর স্বস্তির কারণ ঘটিয়ে ইসরায়েলি বাহিনী এবং তাদের সাথে অসমান লড়াইয়ে নামা ফিলিস্তিনি একটি উপদলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। কিন্তু পূর্বাপর বিবেচনায় স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে, এর পর কি হবে? মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার টেকসই সমাধানের পথ কি খুলবে? নাকি পুরনো কৌশল অনুযায়ী এটিও হয়ে থাকবে কয়েকবছর পরের আরেকটি হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার লক্ষ্যে ইসরায়েলি বাহিনীর শক্তি সঞ্চয়ের উপায়!
যেমনই হোক, এ যুদ্ধবিরতিতে হয়তো 'লড়াই' নামের একপক্ষীয় একটি পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ থেমেছে, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় বাহিনী যে পবিত্র রমজান মাসে মসজিদুল আকসায় নামাজরত মুসল্লিদের ওপর হামলা চালাল, আবাসিক এলাকায় লাগাতার বিমান হামলা চালিয়ে শিশু ও নারীসহ এতো এতো অসামরিক ফিলিস্তিনিদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিল! এসবের কি কোনও টেকসই সুরাহা হবে না?
আগের মতোই, যখন যেভাবে ইচ্ছা নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের হত্যার লাইসেন্স যদি ইসরায়েলের কাছে থেকেই যায়, তাহলে এই যুদ্ধবিরতি নামের নাটকের কি প্রয়োজন! আজ যুদ্ধবিরতি হলো, একবছর পর দেখা গেল আবার...! যুদ্ধবিরতির ২৪ ঘণ্টাও না পেরোতে আল আকসায় ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক পুনর্বার হামলা- এই অমোঘ বাস্তবতাকেই পরিস্ফুট করে তোলে।
আমি মনে করি, যুদ্ধবিরতি প্রপঞ্চটি কেবল তখনই প্রাসঙ্গিক হতে পারে, যখন এটা নিশ্চিত করা যাবে যে, ইসরায়েল আর কোনওদিন নিজের ইচ্ছামাফিক ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরতা চালাতে পারছে না। বিশ্ব সম্প্রদায় যখন ফিলিস্তিনিদের ওপর যুগযুগ ধরে অন্যায়-অত্যাচার চালানোর বিষয়টি ইসরায়েলকে নাকে খত দিয়ে স্বীকার করতে বাধ্য করতে পারবে, অসহায় ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা এবং মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তিপ্রতিষ্ঠা কেবল তখনই সম্ভব হতে পারে। একইসঙ্গে এই নির্বিচার প্রাণহানি এবং সম্পদবিনষ্টের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণও ফিলিস্তিনিদের প্রাপ্য।
মানবতাবিরোধী এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিশ্বজনমত যখন মূক ও বধির, তখন আমাদের দেশের মানুষের অনুভূতির মানবিক প্রকাশ দেখে গর্বিত না হয়ে পারা যায় না। লকডাউনের কারণে সভাসমাবেশ করতে না পারলেও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট-কমেন্টে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে দেশবাসী সবাই এই বর্বরতার নিন্দা জানিয়েছেন। অসংখ্য মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্থ, খাবার, ওষুধপত্রাদি দিয়ে ফিলিস্তিনের দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এবং ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতার প্রতিবাদে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তাঁর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি, এ বিষয়ে মত প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকেই আবার দেখছি বুঝে, না বুঝে ধর্মকেও জড়িয়ে ফেলছেন। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার বিরোধিতা করতে গিয়ে শাপশাপান্ত করছেন ইহুদি ধর্ম এবং এর অনুসারীদেরকেই। তাদের উদ্দেশে বলব- কোনও ধর্মকে অমর্যাদা করে কিছু বললে প্রকারান্তরে তার মাধ্যমে আসলে নিজ ধর্মকেই ছোট করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে এখানে ধর্ম বিষয়টিই অপ্রাসঙ্গিক। ঠিক যে কারণে আমরা মুসলিমপ্রধান জাতিগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও পাক হানাদার বাহিনী ও রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি চিরকাল তীব্র ঘৃণা, ক্ষোভ ও বিদ্বেষ অনুভব করে থাকি, সেই একই কারণে দখলদার ও সহস্র বছরের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের হোতা ইসরায়েলি বাহিনীকেও ঘৃণা করি, ধিক্কার জানাই অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে।
ফুটন্ত গোলাপের মতো নিষ্পাপ শিশুদের জীবনপ্রদীপ যারা নিভিয়ে দিয়েছে, অভিভাবকহীন অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতা-নিষ্ঠুরতার সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দিচ্ছেন দিনের পর দিন। আমার মনে হয় শেষ বিচারের দিনে এমনকি ইহুদি ধর্মের প্রবর্তক মহাপুরুষও এই ইসরায়েলি বাহিনী ও তদের নীতিনির্ধারকদের ক্ষমার জন্য স্রষ্টার নিকট কোনওরকম সুপারিশ করবেন না।
জানি না, এ অমানবিক, একপাক্ষিক হত্যাযজ্ঞ আর কত যুগ অব্যাহত থাকবে! সিনাই পর্বতমালার ওপর দিয়ে শনশন শব্দে বয়ে চলা মরু ঝড়ো হাওয়া আর কতো কাল বয়ে নিয়ে চলবে বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম নির্যাতনের শিকার হতভাগা এক জনগোষ্ঠীর বুকফাটা হাহাকার ধ্বনি!
লেখক- বিসিএস (পুলিশ), এএসপি (রাঙ্গুনিয়া সার্কেল), চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।