স্মার্টফোন আসক্তি ও একটি প্রজন্মের লাভ-ক্ষতি
প্রকাশিত : ১২:২৭, ১০ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৫:২০, ১০ জুলাই ২০২১
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবরের শিরোনাম ছিল- এত নারী নিখোঁজের রহস্য কী? খবরে বলা হয় যে, চলতি বছরের ছয় মাসে চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানায় ১৩৯ জন নারী নিখোঁজ হওয়ার তথ্য জানিয়ে সাধারণ ডায়েরি বা জিডি ও মামলা করেছেন অভিভাবকরা। একই সময়ে জেলার মতলব উত্তর থানায় ৪৩ জন নারী ও শিশু নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জিডি করা হয়েছে। চাঁদপুর সদর মডেল থানায় জিডি করা হয়েছে একই সময়ে ৯৭ জন নারী ও কিশোরী নিখোঁজ হওয়ার।
শুধু চাঁদপুরের থানাগুলোতে নয় দেশের অন্যান্য থানাতেও নারী ও কিশোরী নিখোঁজ হওয়ার জিডি এবং মামলার সংখ্যা উদ্বেগজনক। খবরে বলা হয়, এর কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে নানা চমকপ্রদ তথ্য। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, নিখোঁজ এসব নারীর মধ্যে অধিকাংশই স্কুল-কলেজের ছাত্রী। আর একটি অংশ প্রবাসীর স্ত্রীর।
তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে ছেলেদের নানা প্রলোভনের প্রতি আসক্ত হয়ে ঘর ছাড়ছেন। আবার ঘর ছেড়ে অনেকেই হচ্ছেন প্রতারিত ও পাচারের শিকার।
আমরা যদি একটু চিন্তা করি- একটি জেলার তিনটি থানায় যদি এই সংখ্যক কিশোরী স্কুল-কলেজের ছাত্রী এবং প্রবাসীর স্ত্রীরা ঘর ছেড়ে প্রতারণা ও পাচারের শিকার হন, তাহলে সারা দেশে কতগুলো থানা রয়েছে! প্রত্যেক থানায় যদি গড়ে ৫০-১০০ জন নিখোঁজ, প্রতারণা ও পাচারের শিকার হন, তাহলে এই সংখ্যাটা কত বড় হতে পারে! কত আতঙ্কজনক হতে পারে!
একজন পুলিশ কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, নিখোঁজ নারীদের বেশিরভাগই প্রবাসীদের স্ত্রী। সাধারণ মানুষের সবার হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম ভিগো ভাইবার হোয়াটস অ্যাপ ও টিকটক অ্যাপসহ বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করেন। এসবের মাধ্যমে ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাদের। অনেকে বখাটে যুবকদের পাল্লায় পড়ে ঘর ছাড়ছেন। তিনি আরো বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় স্কুল কলেজে পড়া কিশোরীরা ঘর ছাড়ছে। তারা এই স্মার্টফোন ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেলেদের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করছে এবং আসক্তি ও নানাবিধ প্রলোভনে পড়ে ঘর ছাড়ছে।
তার মতে, করোনা সংক্রমণজনিত কারণে স্কুলগুলোতে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। অনেক অভিভাবক ছেলে-মেয়েদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিয়ে মনে করেন- সন্তানরা অনলাইনে ক্লাস করে। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে না। প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক ছেলেমেয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।
আসলে শুধু কি ছেলেমেয়েরাই ছাত্রছাত্রীরাই আসক্তি ও অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে? এক্ষেত্রে অনেক মা-বাবার অবস্থানটা কোথায়? সেটাও আমরা দেখতে পারি আরেকজন লেখকের দৃষ্টিতে। লেখক ‘স্মার্টফোন আসক্তি ও একটি প্রজন্মের হারিয়ে যাওয়া’ নিবন্ধে লিখেছেন, “করোনার প্রথম ঢেউ অতিক্রান্ত হওয়ার পর এক পড়ন্ত বিকেলে ছাদখোলা এক রেস্টুরেন্টে পরিবারসহ কফির আড্ডায় বসেছিলাম। লক্ষ্য করলাম- আমাদের খুব কাছাকাছি কয়েকজন ছবি তোলায় ব্যস্ত। তাদের প্রত্যেকের বয়স ৪২ থেকে ৪৫ এর মধ্যে।
ছবি তুলতে তারা এতটাই মশগুল ছিলেন যে স্থান-কাল-পাত্রের জ্ঞান হারিয়েছেন যেন! করোনা পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনীয় দূরত্ব তো দূরের কথা, পারলে তারা যেন গায়ের ওপর উঠে ছবি তোলেন। যতক্ষণ রেস্টুরেন্টে ছিলাম পুরো সময়ই তাদের ছবি তুলতে দেখেছি। স্থির হয়ে নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময় করার যেন সময়ও নেই তাদের।
এদের মধ্যে আমি আমার একজন সাবেক সহকর্মীকেও খুঁজে পেলাম। পোশাকে আর কড়া মেকআপে তিনি যেন অনেকটাই অচেনা। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার পরও তার মধ্যে ভাবান্তর লক্ষ না করে নিজেই খানিকটা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম। সৌজন্য বিনিময়ের হাসিটুকু দ্রুত গুটিয়ে নিয়ে ভাবলাম- কোথাও আমার ভুল হচ্ছে না তো! তবে সেই রাতেই ফেসবুকের ওয়ালে সাবেক সহকর্মীর পোস্ট করা ছবি দেখে নিশ্চিত হই বিকেলে তাকে চিনতে আমার কোনো ভুল হয়নি।
তিনি এরপরে একটি নির্মম বাস্তবতার পর্যবেক্ষণকে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অসম্ভব জনপ্রিয়তা সম্ভবত বাস্তব জীবন আর স্ক্রিনবন্দি জীবনের মধ্যে সীমারেখা টেনে দিচ্ছে”। সেখানকার একটি জীবন চেনে না আরেকটি জীবনকে। একই ব্যক্তির যেন দুটি সত্তা। একটি বাস্তবতার টানাপোড়েনে পরিপূর্ণ। আর অন্যটি স্ক্রিনে কৃত্রিম আলোর মতোই ঝলমলে আর চোখ ধাঁধানো। দুটি জীবনের কুশীলবরাই যেন অনেকটাই আলাদা।
তিনি লিখেছেন, ‘আর ইওর প্যারেন্টস অ্যাডিক্টেড টু ফোনস?’ শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ২০১৯ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়। ১০০০ জন মা-বাবা ও তাদের সন্তানদের ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় বলা হয়, যেখানে প্রতি ১০ জনে ৬ জন মা-বাবা মনে করেন, তাদের সন্তান মোবাইলে আসক্ত, সেখানে প্রতি ১০ জনে ৪ জন সন্তান মনে করে যে তাদের মা-বাবা মোবাইলে আসক্ত। জরিপে অংশ নেওয়া ৩৮ শতাংশ কিশোরবয়সী মনে করে, তাদের মা-বাবা মোবাইলে আসক্ত। শুধু তা–ই নয়, তাদের মা-বাবার মোবাইল আসক্তি থেকে তারা তাদের মা-বাবার মোবাইল আসক্তি থেকে মুক্তি কামনা করে”।
লেখক তার লেখায় একটা নির্মম সত্যকে তুলে এনেছেন। আসলে ভার্চুয়াল ভাইরাসে আসক্ত মানুষের দুটি সত্তা। একটি বাস্তবতার টানাপোড়েনে পরিপূর্ণ। আর অন্যটি স্ক্রিনে কৃত্রিম আলোর মতোই ঝলমলে আর চোখ ধাঁধানো।
আমরা সচরাচর শিশু-কিশোর তরুণ প্রজন্মকে স্ক্রিনবন্দি জীবনে আসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করি। কিন্তু আমরা যারা পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছি তারা কি সত্যিকার অর্থে এই আসক্তি থেকে দূরে আছি! শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের পরিক্রমায় আমরা যে ভালো অভ্যাসগুলো অর্জন করেছিলাম, সেই অভ্যাসগুলো আমরা কি ধরে রাখতে পেরেছি? আমরা নিজেরা কি হারাতে বসিনি সামাজিকতা মূল্যবোধ আর শিষ্টাচারের শিক্ষা?
শিশু-কিশোর তরুণদের প্রযুক্তি নির্ভরতা আর মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি নিয়ে আলোচনা হয় বিস্তর। সন্তানদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে অভিযোগ প্রায় প্রতিটি মা-বাবার। কিন্তু এদিকে মা-বাবাই যে মোবাইল আসক্তিতে তলিয়ে যাচ্ছে সেই খবর কি আমরা রাখি? কিছু চটকদার খবরের শিরোনাম, টিকটক, পরিচিতদের নিউজফিড, কিছু ভিডিও লিঙ্ক আর চ্যাটিংয়েই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি নিজেদের জীবন।
শিশু-কিশোর-তরুণদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে বিভিন্ন মহলে কথা হয়, আলোচনা হয়। কিন্তু পরিণত প্রজন্মটির বদলে যাওয়া অভ্যাস নিয়ে কেউ কথা বলে না। অথচ পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে আমাদের মতো পরিণত প্রজন্মের প্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল আচরণ ও চর্চা খুব জরুরি। আমরা নিজেরাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়লে কাদের অনুসরণ করবে শিশু-কিশোর-তরুণরা? পর্দার ‘আমি’ আর বাস্তবের ‘আমি’! দুই আমি’র দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে পারিবারিক জীবনও!
পর্দার ‘আমি’ নিয়ে তো গল্প আছে যে, চার্লি চ্যাপলিন- হলিউডের হাসির রাজা। তিনি বিষণ্ণতায় ভুগছেন। একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়েছেন পরামর্শের জন্যে- ‘যে আমি তো হাসতে পারি না। আমি তো বিষণ্ণতায় ভুগছি। হাসতে পারি না।’ তিনি তার বিষণ্ণতার কারণ বলছেন দুঃখ বলছেন। সব শুনে টুনে সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন আপনি চার্লি চ্যাপলিনের ছবি দেখেন। তাহলেই আপনি হাসতে পারবেন। চার্লি চ্যাপলিন আরো বিষণ্ণ মুখ করে বললেন, আমিই তো চার্লি চ্যাপলিন।
তো আসলে পর্দার আমি আর বাস্তবের আমি, পর্দার জীবন আর বাস্তবের জীবন, স্ট্যাটাসের ছবি আর বাস্তব ছবি- এর মধ্যে মিলের চেয়ে অমিল, মিলের চেয়ে সংঘাত অনেক অনেক বেশি। এখানে একটা বিষয় তুলে ধরছি যা আপনারা অনেকে হয়তো দ্বিমত করতে পারেন। ১৯৯৫ সালে ইংল্যান্ডের গবেষকদের জরিপে সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছিল। এর মূল কারণ ছিল আমাদের পারিবারিক বন্ধন।
তখনই আমরা উপলব্ধি করেছিলাম- নেক্সট এট্যাক হবে পরিবারের ওপর। কেননা শোষকরা সবসময় গবেষণা ও অনুসন্ধান করে উদীয়মান জনপদের শক্তির জায়গাটা খুঁজে বের করে। তারপর সেটাকে ধ্বংস করে।
১৯৯৫ সালে আমাদের অভাব ছিল, বার্গার খেতে পারতাম না। কিন্তু পরিবার ছিল, একধরনের শান্তি ছিল।। তারপর কী হলো? একান্নবর্তী পরিবারকে আমরা যন্ত্রণা মনে করতে শুরু করলাম। ‘হাম দো হামারা দো’ থেকে এখন আরো ছোট ফর্মে দাঁড়িয়েছে- হাম হাম তুম তুম। আমরা যাকে ব্যক্তি স্বাধীনতা মনে করি সেটা আসলে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা। একজন মানুষ যখন সত্যিকারের স্বাধীন হয় তখন সে নিজের ও অন্যের কল্যাণ করে। এক ঘরে বাস করলেই পরিবার হয় না। যখন আমার সুখের চেয়ে আমার বাবা-মা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রীর সুখ বড় হবে তখনই আমরা মানুষ হবো, সেটা পরিবার হবে।
অনেক অভিভাবক এখন অভিযোগ করছে বাচ্চা বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা তো বেয়াদব হবেই। কারণ সে ঘুরঘুর করছে আপনার পাশে। আপনি তাকে সময় না দিয়ে টিভি সিরিয়াল কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুবে ছিলেন। ভার্চুয়াল ভাইরাস ডুবে ছিলেন। ভার্চুয়াল ভাইরাস এমন নীরব ঘাতক যে খুন হওয়ার আগে আপনি বুঝতেই পারবেন না আপনি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
এখন বাস্তবতা আরও বদলেছে। আপনি শুধু টিভি সিরিয়ালে আসক্তই নন, আপনি সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকার মতো ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিতেও আসক্ত হয়ে গেছেন। এখন আমরা প্রত্যেকেই পর্দার আমি, ছবির আমি- যেই স্ট্যাটাস আমি দেই সেই আমির সাথে বাস্তব আমির যে অমিল দ্বৈতসত্তার যে মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্বই আমাদেরকে অস্থির করছে এবং অসহিষ্ণু করছে।
মন ও আত্মার মধ্যে দূরত্বই সৃষ্টি করে বাস্তব দূরত্ব! আমি যদি অস্থির অসহিষ্ণু ও মমতাহীন হই, দুর্ব্যবহারকারী হই, আমার সন্তান স্থির প্রশান্ত সমমর্মী হবে এই আশাটা দুরাশারই নামান্তর। আসলে আমরা এতক্ষণ তো অবস্থা বিশ্লেষণ করলাম। প্রতিকারটি কী?
এখন আমরা সুফিদের একটা গল্প বলতে চাই, গল্প শুনতে চাই।
নির্জন নদীর পাড় দিয়ে আপন মনে হেঁটে যাচ্ছেন একজন মানুষ। বাঁক ঘুরতেই তিনি আওয়াজ পেলেন চিৎকারের চেঁচামেচির। তাকিয়ে দেখলেন দুজন মানুষ নদীর পাড়ে খুব কাছাকাছি- দুই হাত দূরত্বে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি। আপন মনে যিনি হাঁটছিলেন ভাবলেন ব্যাপারটা কী? এত কাছাকাছি দুজন! এত জোরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার কেন, আওয়াজ কেন? তাদের কেউ তো বধীর নয়।
তাদের দুজনের উত্তেজনা এবং চিৎকারে তিনি আর কোনোকিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলেন না। গ্রামে ফিরে এলেন। গ্রামের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি বুজুর্গ, দরবেশ তার কাছে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন যে, হুজুর! আমি দেখলাম দুজন মানুষ দুই হাত দূরত্বে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। মনে হচ্ছে দুইজন যেন নদীর দুই প্রান্তে বা মাঠের দুই প্রান্তে। কিন্তু তারা তো খুব কাছে ছিল। আস্তে কথা না বলে এত জোরে চিৎকার করছিল কেন? আমার বোধগম্য হলো না। আমি বুঝতে পারলাম না।
বুজুর্গ হাসলেন। বললেন, যে আসলে কাছে থেকেও তারা দূরে ছিল। ‘দূরে ছিল’ অর্থাৎ তাদের দুজনের মন ও আত্মার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। এই মানসিক দূরত্বের কারণেই তারা ভাবছিল বাস্তবেও তারা দূরে। এইজন্যেই একজনের কথা আরেকজনের কানে ঢোকানোর জন্যে এত চিৎকার চেঁচামেচি করছিল তারা।
এখন কী করবেন?
আসলে আজকে থেকে প্রথম পদক্ষেপ হোক, ঘরে চিৎকার-চেঁচামেচি-ধমকা-ধমকি বন্ধ। ঘরে আপনারা তো খুব কাছেই আছেন। শুধু দৈহিকভাবে কাছে নন, মনের দিক থেকেও কাছে চলে আসেন। সমমর্মিতা-শ্রদ্ধা-মনোযোগ। আসলে আপনি যেরকম মনোযোগ পেলে খুশি হন, আপনার স্ত্রী আপনার স্বামী আপনার সন্তান আপনার মা আপনার বাবা আপনার আত্মীয় তিনিও মনোযোগ পেলে খুশি হন। অতএব, মনোযোগ দিন। অন্যদের কথা শুনতে শুরু করুন।
প্রথমে বলতে চাইবে না। কারণ হয়তো অনেক অস্থিরতা অসহিষ্ণুতা বিষণ্ণতা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে ইতিমধ্যেই ভার্চুয়াল ভাইরাসের আক্রমণের ফলে। ধৈর্য ধরতে হবে। আপনি উদ্যোগী হয়ে কাছে যেতে হবে। কাছে টানতে হবে। এবং নিজের হৃদয়কে উজাড় করে দিতে হবে। তাহলেই আপনি আজ হোক কাল হোক তাদের অন্তরকে জয় করতে পারবেন। আপনার পরিবার টিকে যাবে।
প্রথমদিকে যত অসুবিধা হোক- আপনি অন্তর খুলে মমতা সমমর্মিতা শ্রদ্ধা ভালবাসা দিন। তাকে কাছে টানুন। ফিল করুন। এ আমার মা, এ আমার বাবা, এ আমার সন্তান, এ আমার স্ত্রী, এ আমার মেয়ে, এ আমার স্বামী। এবং যখনই মেডিটেশনে বসবেন মনের বাড়িতে এনে তাকে বোঝান যে তাকে আপনি কত ভালবাসেন কত স্নেহ করেন কত মমতা করেন কত শ্রদ্ধা করেন। আসলে প্রেম ভালবাসা মমতা শ্রদ্ধা একই জিনিসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন নাম। কিন্তু মূল জিনিস একই। কিন্তু মূল স্পন্দন একই। প্রত্যেক শিশুকেই সমান মনোযোগ দিন...।
দু নাম্বার পয়েন্ট হচ্ছে তাদের কথা শুনুন। তাদেরকে বলতে উদ্বুদ্ধ করুন। তাদেরকে সময় দিন। আসলে আপনার সন্তানের ব্যাপারে আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে আপনার মনোযোগ। গত ডিসেম্বরে জার্মানির হামবুর্গে একদল শিশু মা-বাবার মোবাইল আসক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসছিল। আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সাত বছর বয়সী এমিল আহ্বান জানায়, তোমরা আমাদের সঙ্গে খেলো, স্মার্টফোনের সঙ্গে নয়।
আসলে প্রত্যেক শিশুই মা-বাবার মনোযোগ চায়। স্কুল করার জন্যে, ক্লাস করার জন্যে সন্তানকে বাধ্য হয়ে কিনে দেয়ার পর সন্তান যদি স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে গিয়ে থাকে তাহলেও ধৈর্য হারাবেন না। পড়াশোনার বাইরে স্মার্টফোন নিয়ে কিছু করছে কিনা এটা আপনি তখনই বুঝতে পারবেন যখন আপনি সন্তানের প্রতি, শিশুর প্রতি মনোযোগী হবেন।
আপনি মনোযোগী হোন। প্রথম প্রথম সন্তান আসক্ত হয়ে গিয়ে থাকলে আপনার সাথে বিরূপ আচরণ করবে। কিন্তু আপনার মনোযোগ আপনার ধৈর্য আপনার মমতা দিয়ে আপনি তাকে ইনশাল্লাহ সুস্থতায় ফিরিয়ে আনতে পারবেন। যে মা-বাবার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানকে জীবনের লক্ষ্য দেয়া। এবং যদি লক্ষ্য দেয়া যায় সন্তান যে শিশুবয়সেও কতকিছু করতে পারে… দাবার সবচেয়ে ছোট গ্রান্ডমাস্টার অভিমন্যু মিশ্র এর উদাহরণ।
অভিমন্যু মিশ্র জন্মগ্রহণ করেছে আমেরিকায়। তার বাবা হেমন্ত মিশ্র যখন তার বয়স আড়াই বছর তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ট্যাবলেট বা আইফোনে সন্তান যাতে আসক্ত না হয় সেজন্যে তাকে দাবা খেলা শেখালেন। দাবার গুটি তার হাতে তুলে ধরলেন। এবং এই শুরু। আস্তে আস্তে তাকে খেলা শেখালেন। তাকে লক্ষ্য দিলেন যে তোমাকে খেলায় চ্যাম্পিয়ান হতে হবে। এবং অভিমন্যু মাত্র ১২ বছর বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ গ্রান্ডমাস্টার হলেন দাবায়।
অভিমন্যু বলেন যে, গত দেড় বছর করোনাকালে লকডাউনকালে আইসোলেশনে থাকার সময়ে সময় নষ্ট না করে আমি আমার লক্ষ্য অর্জনের জন্যে, দাবায় দক্ষ হবার জন্যে আমি দৈনিক গড়ে ১২ ঘণ্টা করে সময় ব্যয় করেছি। এবং আমার এখন লক্ষ্য হচ্ছে ১৫ বছর বয়সে আমি একজন সুপার গ্রান্ডমাস্টার হতে চাই। এবং এরপরের লক্ষ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়া।
আসলে সন্তানকে জীবনের একটি লক্ষ্য দেওয়া ছোট্টবেলা থেকে শিশু বয়স থেকে তাকে সময় দেয়া তাকে আদর করা এবং আদর করতে করতে জীবনের একটা লক্ষ্য তার মধ্যে দিয়ে দেওয়া, এটাই মা-বাবার জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যদি একবার লক্ষ্য দিতে পারেন তাহলে সন্তান বাকি কাজগুলো নিজেই করবে। তারপরেও সবসময় খেয়াল রাখতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে- সে কী করছে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে, শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ না করছে।
আজকে যদি ভার্চুয়াল ভাইরাসের হাতছানিতে আপনার পরিবারকে আপনি ধ্বংস করে দেন, আপনার মৃত্যুর সময় কোনো ভার্চুয়াল বন্ধু আপনার কাছে আসবে না। আপনার বিপদের সময় কোনো ভার্চুয়াল বন্ধু আপনার কাছে আসবে না। অতএব পর্দার যে সত্তা, ছবির যে সত্তা, স্ট্যাটাসের যে সত্তা, কৃত্রিম আলোর চোখ ধাঁধানো ভার্চুয়াল বা বায়বীয় সত্তা- এই সত্তার পরিবর্তে বাস্তব সত্তাকে সম্মান করুন, শ্রদ্ধা করুন। আপনি জীবন ফিরে পাবেন।
এএইচ
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।