আফগানিস্তান: একটি অশণি সঙ্কেত
প্রকাশিত : ১২:৩৩, ১৯ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ১৫:২৮, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
আফগানিস্তান এখন তালেবানদের দখলে, তালেবান সরকারই সেখানে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। না, কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে আসেনি তারা, মাও সেতুংয়ের ‘বন্দুকের নলই সব ক্ষমতার উৎস’ আপ্তবাক্যটির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তারা এ কাজটি করেছে। আফগানিস্তান এখন শরীয়াহ্ আইন ভিত্তিক একটি ইসলামিক রাষ্ট্র।
যদিও আফগানিস্তানের ঘটনা-প্রবাহে অনেকেই বিস্ময়ে থ হয়ে গেছেন, ‘গেল গেল’ রব তুলছেন। কিন্তু ঘটনাটিতে চমকিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। একটু একটু করে তালেবানদের শক্তি ও বিস্তার দানা বাঁধছিল সবার অলক্ষ্যে পুরো আফগানিস্তান জুড়ে এবং চূড়ান্ত আঘাতটি তারা হেনেছে অতি সম্প্রতি। আজ তারা বিজয়ী।
বিশ বছর বাদে আফগানিস্তানে তালেবানদের পুন:প্রতিষ্ঠার একটি চালচিত্র আছে, একটি ইতিহাস আছে, একটি কার্যকারণ আছে। বিগত বছরগুলোতে একাধিক কারণ তালেবানদের আবার ক্ষমতা দখলের পথকে সুপ্রশস্ত করে দিয়েছে।
প্রথমত: আফগান সরকার প্রথম থেকেই ছিল দুর্বল, নাজুক এবং দক্ষতাবিহীন। বিগত দুই আফগান রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই ও ড. আশরাফ গনি ছিলেন বহিরাগত এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত। ফলে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের বশংবদও ছিলেন। হামিদ কারজাই রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার আগে ভূতপূর্ব যুক্তরাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্রপ্রতি ডিক চেনীর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ায়।
আর ড. আশরাফ গনিকে আমি ব্যক্তিগতভাবেই চিনতাম। আমি যখন জাতিসংঘের দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের প্রধান, তখন তিনি বিশ্বব্যাংকের সামাজিক উন্নয়ন বিভাগের প্রধান। দু’জনেই পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সেখানকার জীবনধারায় অভ্যস্ত। আফগানিস্তানের জটিল বাস্তবতা তাঁদের বোধগম্যতার বাইরে ছিল এবং দেশের জীবন ও তার সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের কোনো আত্মিক সংযোগ ছিল না।
ফলে, একটি কার্যকর শাসন ব্যবস্থা তাঁরে গড় তুলতে পারেন নি। গত দু’দশকে আফগানিস্তানের অংশগুলো ছিল একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং মূলত: আঞ্চলিক যুদ্ধপ্রভুরাই আফগানিস্তানের প্রশাসন চালিয়েছেন। কেন্দ্রীয় প্রশাসন ছিল ভঙ্গুর এবং অঞ্চলপর্যায়ে অক্ষম।
দ্বিতীয়ত: কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার কারণে বিগত বছরগুলোতে কোনো কার্যকর, কার্যক্ষম সুদক্ষ শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে ওঠেনি দেশটিতে। ফলে যে মুহূর্তে পশ্চিমা সেনাবাহিনী আফগানিস্তান ছেড়েছে, সে মুহূর্তেই প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়েছে এবং তালেবান আফগানিস্তানের প্রতিটি ইঞ্চি দখল করে নিয়েছে। আশি হাজার তালেবান যোদ্ধার কাছে হার মেনেছে ১ লাখ ৮৯ হাজার আফগান সৈনিক। আফগানিস্তানে থাকাকালীন পশ্চিমা সেনাবাহিনীর অন্যতম একটি দায়িত্ব ছিল- আফগান সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া। কার্যত: সেটা হয় নি। সুতরাং ফল যা হওয়ার, তাই হয়েছে।
তৃতীয়ত: আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলে আফগান সরকার যে অনুপস্থিত ছিল, শুধু তাই নয়, তালেবান অত্যন্ত কৌশলে তাদের স্বপক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। গত বিশ বছর ধরে গ্রামের অশিক্ষিত মানুষকে অত্যন্ত সুদক্ষভাবে তালেবানেরা বুঝিয়েছে যে, দেশটি ইসলামের বিরুদ্ধ শত্রু পাশ্চাত্যের অধীনে চলে গেছে এবং তার বিরুদ্ধে জিহাদে তারা লিপ্ত। এর মাধ্যমে তারা গ্রামীণ আফগানীদের গণসমর্থন পেয়েছে এবং বৃহত্তর আফগানিস্তানে তাদের ভিত শক্ত করেছে।
চতুর্থত: বিগত বছরগুলোতে আফগানিস্তানে পশ্চিমা দেশগুলো একটি দু’মুখো নীতি অবলম্বন করেছিল। একদিকে তারা কারজাই বা গণি সরকারকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে, অন্যদিকে তারা তালেবানদের সঙ্গে গোপন আলোচনা চালিয়ে গেছেন। গতবছর মার্কিন সরকার আফগান সরকারকে না জানিয়েই গেপনে তালেবানদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিল। এর ফলে আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়েছে আর তালেবানদের হাত শক্ত হয়েছে।
পঞ্চমত: ঐতিহ্যমতো যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তাদের মিত্রদের অরক্ষিত অবস্থায় রেখে অতি অল্প সময়ের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তল্পি-তল্পা গুটিয়েছে। এমনটা তারা ভিয়েতনামেও করেছে পঞ্চাশ বছর আগে। কাবুল বিমানবন্দরে মানুষের উদভ্রান্ত অবস্থার ছবি ভিয়েতনামে মার্কিন দূতাবাসের ফটকের বাইরে অসহায় মানুষের ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়।
যে আফগানীরা নিজের জীবন ও পরিবারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মার্কিনীদের পক্ষে দোভাষীর কাজ করেছে, তাঁদের বিস্মৃত হতে মার্কিনীদের তিলমাত্র সময় লাগেনি। তারা আবারও তাদের আপ্তবাক্য প্রমাণ করল, ‘আমাদের কেন স্থায়ী বন্ধু নেই, কোনো স্থায়ী শত্রু নেই, আমাদের শুধু স্থায়ী স্বার্থ আছে’।
আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের এই ক্রান্তিকালে তাদের বিষয়ে তিনটি পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক, তালেবানেরা মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনার অনুসারী। তাই শরীয়াহ্ নিয়মবিধি অনুসারেই দেশ চলবে। সেই সঙ্গে বিজ্ঞানমনস্কতা, আধুনিকতা এ উদারপন্থি যে কোনো মানুষ বা কর্মকে তারা রুখবেই। তাই তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে প্রথমেই হত্যা করেছে খ্যাতনামা প্রতিবাদী কবি, গবেষক, ইতিহাসবিদ আবদুল্লা আতিফিকে। প্রহার করে হত্যা করেছে কৌতুকশিল্পী ফজল মোহাম্মদকে।
দুই, তালেবানরা ধূর্ত, শঠ, প্রবঞ্চক এক গোষ্ঠী। তাই মিথ্যা বলতে, শঠতা করতে এবং প্রবঞ্চনা করতে তাদের একচুলও বাধবে না। অতীতে এমন কাজ তারা অতি সহজেই করেছে। সুতরাং নারীদের সব অধিকারই রক্ষিত হবে বলে যতই তারা আশ্বাস দিক না কেন, অতি দ্রুতই নারী অত্যাচারে তারা নেমে পড়বে। তালেবান আমলে আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশী নিগৃহীত হবে নারীরা। এখনই শোনা যাচ্ছে যে, তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে তালেবানরা বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মীয় চরমপন্থিদের আফগানিস্তানে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে এবং এর পুরস্কার স্বরূপ তাদের আফগান নারীদের ভেট দেয়া হবে। যৌনদাসী হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাঠানোরও অভিযোগ উঠেছে। বহু মা-বাবা তাঁদের তরুণী মেয়েদের রক্ষার জন্যে তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে বিয়েও দিচ্ছেন।
তিন, তালেবানরা অতীত থেকে শিক্ষা নেবে বলে অনেকে আশা প্রকাশ করেছেন। শিক্ষা তারা নেবে ঠিকই, কিন্তু তা ইতিবাচক গঠনমূলক শিক্ষা নয়। দু’দশক আগে আল-কায়েদাকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দিয়ে তালেবানদের শিক্ষা হয়েছে। সুতরাং এমন কাজ তারা এবার আর করবে না। সব বিদেশীরা আফগানিস্তান ত্যাগ করার আগে তালেবানরা চুপচাপ থাকবে, তারপরই তারা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করবে। বিশ বছরের আগের ভুল তারা আর করবে না।
শেষের কথা বলি। তালেবানরা শুধু আফগানিস্তানের মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখবে না, তারা তাদের প্রভাব-বলয় বিস্তার করতে চাইবেই। আমার মনে হয়, পাকিস্তান তালেবানদের পরবর্তী লক্ষ্য হবে। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী তালেবানদের প্রতি সহানুভূতিশীল মন্তব্য করেছেন। একটা সময়ে তারা বাংলাদেশের দিকেও তাকাবে। অশণি সঙ্কেতটি সেখানেই।
এনএস//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।