পরীর ‘বিচবার্তা’ ও পুলিশের ‘পার্শ্ব সাংবাদিকতা’
প্রকাশিত : ১০:৩৪, ২ সেপ্টেম্বর ২০২১
১৯৯৩ সালে মুম্বাই হামলার সময় নিজের কাছে অবৈধভাবে অস্ত্র রাখার দায়ে ৪২ মাস জেল খাটতে হয় এক সময়ের বলিউড সুপারস্টার সঞ্জয় দত্তকে। পুরনো এ মামলায় চূড়ান্তভাবে তিনি মুক্তি পান ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬-এ। সেদিন বিবিসি হেডলাইন করেছিল ‘নায়কোচিত মুক্তি সঞ্জয় দত্তের’। সেদিন মুক্তি পেয়েই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন মায়ের কবরের পাশে। কবরের পাশে গিয়ে তিনি কি করেছেন, নিশ্চয়ই তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।
অন্যদিকে মাদকের মামলায় ঢালিউড নায়িকা পরীমনির জামিনে মুক্তির পর বিবিসি হেডলাইন করেছে ‘জেল থেকে বেরিয়ে পরীমনির বিচ বার্তা নিয়ে তোলপাড়’। জেল থেকে পরীমনি বেরিয়েছেন সাদা কাপড়ে মাথা ঢেকে, অনেকটা পরীর বেশেই। হুডখোলা গাড়ীতে দাঁড়িয়ে হাতও নেড়েছেন নেত্রীর বেশে। পরীমনি মুক্তি পেয়ে ছুটে গেছেন নিজের ভাড়া বাসায়। বাসায় ফিরেই গোসল করিয়েছেন নিজের পোষা কুকুরকে।
এ দুটি ঘটনাই ভিন্ন। নিউজের হেডলাইনও ভিন্ন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, একজন সত্যিকারের পর্দা কাঁপানো হিরো আরেকজন কতটা খ্যাতিমান তা নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা কিংবা বিতর্ক হতেই পারে। কেননা, যেখানে গত ২০ বছরে বাংলা সিনেমার হল বন্ধ হয়েছে গণ্ডায় গণ্ডায়। আর সিনেমাও মুক্তি পেয়েছে শতে শতে। অথচ দর্শক ধরার মতো সিনেমা হাতেগোনা দু-একটা। সেখানে পরীরা কোথায়, কি অভিনয় করেন, আর সমাজকেই বা কি উপহার দেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করলেও তা মোটেও অনুচিত হবে না। অথচ সঞ্জয় দত্তের এক ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’ কতটা ব্যবসা সফল, আর সমাজ সচেতনতা তৈরিতে কতটা ভূমিকা রেখেছে- তা পাঠকরাই বিচার করবেন।
তবে হ্যাঁ, পরীমনি আজ ঘুণে ধরা সমাজের বিচদের (কুত্তা) তাকে ভালবাসতে নিষেধ করেছেন, সেটা বেশ যুক্তিযুক্ত। যদিও প্রশ্ন আসে, বিচদের চিনতে কেন তাকে জেলে যেতে হলো। সেটা কোনো মদের বার কিংবা হোটেল লবিতেই চেনা উচিত ছিল কিনা! এটাও পাঠকরাই বিচার করবেন। আবার এটাও সত্যি কথা যে, বিচদের পয়সা দিয়ে পরীদের আলিশান ফ্লাট ভাড়া দেয়া হয় কিনা, ময়ূরপঙ্খী ড্রেস কেনায় ব্যবহৃত হয় কিনা, সে প্রশ্নও তোলা যায় খুব সহজেই।
এবার আসুন, পুলিশের পার্শ্ব সাংবাদিকতার প্রসঙ্গে। পুলিশ প্রধান বলেছেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি পুলিশ এবার সাংবাদিকতাও করবে। হ্যাঁ করুক না! তাতে কি? কিন্তু বিষয় হলো, সাংবাদিকতা কি কোনো পার্শ্ব পেশা? অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫০ বছর কেটে গেল। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে দেশ মধ্যম আয়ের কাতারে ঢুকেছে। অথচ সাংবাদিকতা এখনো একক এবং স্বাধীন পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো না। এটা সত্যিই খুবই অপ্রত্যাশিত।
এদেশে মুদি দোকানী থেকে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ- সবাই এখন সাংবাদিকতার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। অথচ সমালোচনায় জর্জরিত পেশাদার সাংবাদিকরা আজ পরিচয় দিতে লজ্জা পান। পেশাটাকে এমনভাবে নিচে নামানো হয়েছে যে, ডুবে মরারও জায়গা নেই! এরমধ্যেও পুলিশ সাংবাদিকতায় আসতে চায়। তাও নিজেদের পেশাগত কাজের পাশাপাশি! তাহলে, নিশ্চয়ই এখানে কোনো মজা আছে? আমি অবশ্য ১৮ বছরে কোনো মজাই পেলাম না! পেলাম শুধু নেশা।
অথচ এ দেশের পাবলিক সার্ভেন্ট আইন, পুলিশ অর্ডিন্যান্স কি নিজ পেশার পাশাপাশি অন্য কোনো কাজের অনুমতি দেয়? বহু রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, ব্যাংক মালিক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক, আইনজীবী নিজেদের পেশার পাশাপাশি অনলাইন-অফলাইনের নামে সাংবাদিকতার দোকান খুলেছেন। কার্ড বিক্রি করছেন। অথচ এসব দেখার কেউ নেই। যেখানে এসব অনুমোদনহীন, অপেশাদার, সাইনবোর্ড সর্বস্ব সংবাদ মাধ্যম বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নেয়ার কথা, সেখানে পুলিশ প্রধান নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন- পুলিশ আইন শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করবে। তাহলে ক্যামনে কি?
এবার আগের আলেচনায় ফিরে যাই। পরীর গ্রেফতার, রিমান্ড ও মুক্তি নিয়ে কত রকম সাংবাদিকতা হয়েছে- তা দেখে নেয়া যাক। বিভিন্ন অনলাইনে হেডলাইন হয়েছে- পরীমনি জেলে বসে মেহেদী পেলেন কেথায়? এটা অবশ্য যৌক্তিক প্রশ্ন। তবে টাকা দিয়ে বৈধভাবে জেলে যে অনেক কিছুই পাওয়া যায়, তা হয়তো সাংবাদিকদের অনেকেরই জানা নেই। আবার পরী নাকি বিস্কুট খেতে খেতে বাসায় ফিরেছেন- সেটাও নিউজের হেডলাইনে এসেছে! কারাগার থেকে বের হয়েই সেলফি তুললেন পরীমনি, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কি পার্শ্ব সাংবাদিকতারই ফসল?
কথায় বলে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। পরীমনি কি তাহলে কোনো পাপই করেছেন, যার প্রায়শ্চিত্ত করলেন জেল খেটে। এটা অবশ্য বিশ্বের বহু নামী অভিনেতা, অভিনেত্রী, সেলিব্রেটির বেলায়ও হয়েছে। যেমন- বলিউডের ভাইজান খ্যাত সালমান খানের বিরুদ্ধে তিন দফায় বিরল প্রজাতির পাঁচটি কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। যার শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে একটি শুটিং ইউনিট থেকে। সেই মামলায় আদালত সালমানকে পাঁচ বছরের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে। অবশ্য দুই রাত কারাগারে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে যান সালমান খান। আর শেষমেশ এই মামলা থেকে অব্যাহতিও পান ২০১৭ সালে। ২০০২ সালের আরেক ঘটনায় মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে এক পথচারীকে হত্যার অভিযোগে ১৮ দিনের কারাবাস করেন বলিউড সুপারস্টার।
জনপ্রিয় র্যাপার ক্লিফোর্ড হ্যারিস ১৯৯৮ সালে কোকেন বহন, ২০০১ সালে অন্যের বন্দুক ছিনিয়ে নেয়া এবং ২০০৪ ও ২০০৭ সালে অবৈধ অস্ত্র কেনার সময় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেন এবং তিনি জেলও খাটেন।
হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী লিন্ডসে লোহান ২০০৭ সালে মাতাল হয়ে গাড়ি চালানোর দায়ে জেল খাটেন, সঙ্গে জরিমানাও গুণতে হয় তাকে। বলিউডের আরেক সুপারস্টার মনিকা বেদিও পাসপোর্ট জালিয়াতির মামলায় জেল খেটেছেন ভিন দেশে। এছাড়া জ্যাকি চানের ছেলে এবং পপ তারকা জাস্টিন বিবারও জেল-জরিমানার মুখোমুখি হয়েছেন মাদকের মামলায়।
শেষ কথা, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রসিডেন্ট উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন বলেছেন, ‘সরকারের কাজগুলোর মধ্যে শোভনীয় ও মর্যাদাপূর্ণ একটি হলো- কেবল সহ্য করা নয়, বরং উৎসাহিতও করা।’
‘আমার মতে, সব সরকারের মধ্যে সেটিই সবচেয়ে শক্তিশালী যেটি সবচেয়ে বেশি স্বাধীন।’ এই স্বাধীন শব্দটির সঠিক প্রয়োগ হোক গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে। তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে প্রকৃত সত্য। একইসঙ্গে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হোক পরীমনির অঘটনেরও।
এনএস//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।