ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

জঙ্গিবাদের বিদায় ঘণ্টা

সাব্বির আহমেদ

প্রকাশিত : ১৩:৩৫, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ | আপডেট: ২০:৪১, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

“আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত শুধু আফগানিস্তানের জন্যেই নয়, এর মাধ্যমে জাতি গঠনের জন্য বিভিন্ন দেশে সেনা মোতায়নের অধ্যায় শেষ হলো”, আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ সেনা প্রত্যাহারের ২৪ ঘণ্টা পর হোয়াইট হাউস থেকে এ কথা বলেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। 

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকান তাদের প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করলেও যে পরিমাণ রক্তক্ষয় এবং বিশৃঙ্খলার মধ্যে তা ঘটেছে, তাও মানতে পারছে না সে দেশের বেশিরভাগ মানুষ। বিরোধী রিপাবলিকান দলের নেতারা এই ব্যর্থতার জন্য জো বাইডেনের পদত্যাগ দাবি করেছেন। 

আফগান যুদ্ধের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল আল-কায়দা দমন করা। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সে উদ্দেশ্য কিছুটা পূরণ হলেও আমেরিকা খুঁজে পাচ্ছিল না আল-কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে। ১১ বছর ধরে হন্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি করার পর ২০১১ সালের মে মাসের ২ তারিখে পাকিস্তানের এবোটাবাদে লাদেনকে খুঁজে পেয়ে হত্যা করে আমেরিকার মেরিন সেনারা। অন্তত এদিন আমেরিকার আফগানিস্তান অভিযান শেষ হয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। আমেরিকা তা করেনি বা করতে পারেনি। 

যুদ্ধ শেষ করতে না পারার প্রধান কারণ ছিল তালেবান। তালেবান দমন হয়নি। তালেবান দমন করতে না পারলে আমেরিকার বসানো পুতুল সরকার টিকবে না; আফগানিস্তান আবারও মধ্যযুগীয় বর্বর তালেবানদের হাতে পড়বে এবং আমেরিকাসহ ন্যাটোর পরাজয় নিশ্চিত হবে। এই ভয়ে পরবর্তী বিশ বছরেও আফগান যুদ্ধ শেষ করতে পারেনি জর্জ ডব্লিউ বুশ থেকে শুরু করে ট্রাম্প পর্যন্ত তিন জন রাষ্ট্রপতি।

তালেবানদের দমন করতে না পেরে সেই তালেবান সন্ত্রাসীদের হাতেই পশ্চিমাদের দীর্ঘ ২০ বছরের সহযোগী আফগানদের তথা আফগানিস্তানের সকল প্রগতিশীল মানুষদের ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তালেবানদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন তথা সকল ন্যাটো সদস্যসমূহের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জো বাইডেন নন, নিয়েছিলেন তার পূর্বসুরী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের চুক্তি অনুসারে মে মাসের মধ্যে সেনা প্রত্যাহারের চুক্তি হলেও বাইডেন তা বাড়িয়ে ৩০ আগস্ট করেছেন। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। বাইডেন সৈন্য প্রত্যাহার সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে পারলেন না। 

এই ব্যর্থতার জন্য দেশে এবং বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বহু পর্যবেক্ষক বলেছেন, আফগানিস্তানে লজ্জাজনক পরাজয়ের মাধ্যমে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের এবং আমেরিকান শতাব্দীর শেষ হলো। এমন সমালোচনার মুখেই চিরতরে অন্যদেশে সৈন্য মোতায়ন করে দেশ গঠন বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ পরিহার করার ঘোষণা দিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি। অতীতে আমেরিকা অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যা পরবর্তীতে তারা পালন করেনি। তবুও জো বাইডেনের এমন ঘোষণা শান্তিকামী বিশ্ববাসীর মনে শান্তির পরশ বুলিয়েছে।

আমেরিকা শুধু আফগানিস্তানেই নয়, কোরিয়া যুদ্ধের পর প্রায় সকল আগ্রাসনেই ব্যর্থ হয়েছে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে কোরিয়া যুদ্ধ থেকে শুরু করে এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা, আফ্রিকাসহ অনেকগুলো দেশে সেনা মোতায়ন করে আগ্রাসন চালিয়েছে ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা। ষাট, সত্তর এবং আশির দশকে তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভাবিত কমিউনিস্ট প্রভাব ঠেকাতে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সংঘাত সৃষ্টি করে, যুদ্ধ করে দেশে দেশে তারা সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। তাদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায়নি তাদের প্রতিবেশী মেক্সিকো, কলাম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, চিলি, গুয়েতেমালা, আফ্রিকার দেশ কঙ্গো। সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে ভিয়েতনাম, লাউস, ক্যাম্বোডিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায়। আশির দশকে প্রক্সি যুদ্ধ করেছে আফগানিস্তানে। কমিউনিজমের আতঙ্ক থেকে হত্যা করেছে জনন্দিত চিলির নেতা আলেন্দেকে, কঙ্গোর পেট্রিস লুমুম্বাকে। আমাদের বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনেও মার্কিন কূটনীতির হাত ছিল বলে ধারণা করা হয়। মার্কিন আগ্রাসনগুলোর সবকটির ফলাফল হয়েছে দীর্ঘ মেয়াদী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কঙ্গো, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া এখনো সুস্থ হয়ে ওঠেনি।

প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের আগ্রাসনের সহায়তার জন্য সৃষ্ট বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তীতে অস্ত্র ধরেছে। তারা ইরানে শাহ্কে বসিয়ে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। শাহ্কে সরিয়ে ইরানে খোমেনিরা রাষ্ট্র দখল করলে খোমেনি দমনে তারা ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। তারপর সেই সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করতে আবার ইরাকে তাদের যুদ্ধের ঘোষণা দিতে হয়। আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত দমন করতে গিয়ে তারা পাকিস্তানের মাধ্যমে আফগান মুজাহিদিনদের জন্য যে বিলিয়ন ডলার খরচ করে সেই আফগান মুজাহিদিনরাই পরবর্তীতে জন্ম দেয় আল-কায়েদা, তালেবান, আইসিস। আল-কায়দা, তালেবান, আইসিস দমন করতে আবার তাদের সরাসরি যুদ্ধ করতে হয় ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তানে। ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা – প্রচুর মানব হত্যা, সম্পদ নষ্ট, নগর-বন্দর ধ্বংস, ঐতিহাসিক নগরগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে কোথাও তারা তাদের তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

সবগুলো আমেরিকান আগ্রাসনে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করে একটা সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো এই নিবন্ধের সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়। আমরা সদ্য সমাপ্ত আফগান যুদ্ধের দিকে তাকিয়ে কিছুটা সামগ্রিক ধারণা পাবার চেষ্টা করতে পারি। আফগানিস্তানসহ সব কয়টি মার্কিন আগ্রাসনের কমন অজুহাত ছিল গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা। মূলত গণতন্ত্র স্থাপনের জন্যেই তারা কাজ করছে বলে নিজ দেশের জনগণকে এবং সেইসঙ্গে বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে। 

অন্যান্য আগ্রাসনের মতো আফগানিস্তানেও আমেরিকা প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে গণতন্ত্র এবং আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল তা তারা রক্ষা করতে পারেনি। মাঝখান থেকে চলে গেল দুই লক্ষাধিক প্রাণ, বিশ বছর সময়। আমেরিকার আগ্রাসনের পূর্বে আফগান জনগণ যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেল। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন থেকে শুরু করে আমেরিকা সেখানে একদিকে আল-কায়দা এবং তালেবান দমনের চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে আফগানিস্তানে পুতুল সরকার গঠন করে এবং একটা সুশীল সমাজ বানিয়ে দেশটাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। 

তারা সেখানে যা খরচ করেছে তার ৯৫ শতাংশ সামরিক খাতে যার প্রধান অংশ আমেরিকান সরকারের হাত ঘুরে চলে গেছে আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ীদের হাতে। ১% অর্থ খরচ হয়েছে মাদক নিয়ন্ত্রণে, ১.৫% প্রশাসনিক কাজে আর বাকি মাত্র ২.২% শতাংশ বা ২১ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে দারিদ্র্য দূরীকরনে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নে। ফলাফল হয়েছে যুদ্ধে পরাজয়, মাদক ব্যবসা তালেবানদের হাতে, ৬৩ বছরের গড় আয়ু, মাত্র ৪৩% শিক্ষার হার, উচ্চতম পর্যায়ের শিশু মৃত্যু হার, বিশ্বের নিম্নতম পর্যায়ের মানব সম্পদ উন্নয়ন। আমেরিকা আসলে সেখানে কিছুই করতে পারেনি। শুধু শুধুই গেল ২ লক্ষ ৪০ হাজার আফগান আর হাজার ৩/৪ পশ্চিমা প্রাণ। প্রেসিডেন্ট বাইডেন হয়তো এখান থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। তাঁর দেশ আর কোনো দেশে আগ্রাসন চালাবেনা বলে নাকে ক্ষত দিয়ে তওবা করেছেন। 

দেশে দেশে আমেরিকার একের পর এক ব্যর্থতার প্রধান কারণ হচ্ছে যে, তারা দেশ-কাল-সমাজ-সময়-ঐতিহ্য-রাজনীতি এক কথায় সংস্কৃতি বিবেচনা না করে। সকল দেশে সকল সময়ে তাবেদার সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠা করে একই ওষুধ, গণতন্ত্র গিলিয়ে মনে করেছে এবার দেশটা গণতন্ত্র আর মানবাধিকারে সয়লাব হয়ে যাবে। মুখে তারা গণতন্ত্রের ফেনা তুললেও কোথাও সুস্থ রাজনীতির চর্চা করতে দেয়নি। বেশিরভাগ দেশে তারা সামরিক শাসক বসিয়ে ডাণ্ডা দিয়ে গণতন্ত্র ঠাণ্ডা করে রেখেছে। 

আফগানিস্তানে এই বিশ বছরে তালেবানদের দূরে সরিয়ে রাখতে পেরেছিল। এই সুযোগে তারা পুতুল সরকার না বসিয়ে সুস্থ রাজনীতির চর্চার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার গঠন করতে দিলে এই সুস্থ রাজনীতির লোকেরাই তালেবানদের মতো মধ্যযুগীয় বর্বরদের রাজনীতির মাধ্যমে মোকাবেলা করে আফগান রাজনীতিতে তাদের অবস্থান শূন্য করে ফেলতে পারত। সেটা হলে তালেবানরা আজকে আফগান সমাজে গুরুত্বহীন হয়ে থাকত অথবা বিলীন হয়ে যেত। আফগান জনগণ তালেবানদের বিপরীতে কোনো আধুনিক চিন্তাধারার শক্তিশালী রাজনৈতিক দল না পেয়ে নিজেদের দেশ থেকে বিদেশি আগ্রাসন তাড়াতে সবেধন নীলমণি তালেবানদের উপরই নির্ভর করেছে। 

সুস্থ রাজনীতির চর্চা থাকলে যে সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ থাকলেও ধর্মের নামে চলা সন্ত্রাসী রাজনীতি জনসমর্থন পায় না, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ পাকিস্তান আর বাংলাদেশ। পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশেও তারা ইসলামিক জঙ্গিবাদীদের সকল রকম সাহায্য করেছে, নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণ করতে। বাংলাদেশের তুলনায় পাকিস্তানে তারা বেশি সফল হয়েছে বটে, তবে দেশটার রাষ্ট্র ক্ষমতা তালেবানদের মতো জঙ্গিদের হাতে চলে যায়নি। ঘুরে ফিরে নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ এবং ভূট্টোদের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির হাতেই সে দেশের পরিচালনার ভার ছিল। এই দুই দল ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে ইমরান খানের তেহরিক-এ-ইনসাফ সে দেশ পরিচালনা করার দ্বায়িত্ব পায়। পাকিস্তানের ক্ষমতা কখনোই তালেবানদের মতো চরম উগ্র সন্ত্রাসী দলের হাতে তো নয়ই, এমনকি জামায়াতের মতো তুলনামূলক কম উগ্র ইসলামিকদের হাতেও পড়েনি। 

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে আমেরিকার কূটনীতিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা বাংলাদেশ বিরোধী, পাকিস্তানপন্থী জামায়াতে ইসলাম এবং জামায়াতের ঔরসে জন্ম নেয়া বিএনপির হাতে চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করা এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হত্যা, ধর্ষণে সরাসরি যুক্ত থাকা উগ্র ধর্মীয় সংগঠন জামায়াতের পক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আহরণ করা সম্ভব ছিল না বলেই তারা বিএনপি নামক দলটির জন্ম দেয়। বিএনপি’র ছাতার তলে তারা নিজেরা এবং আরেক মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকারী দল মুসলিম লীগের লোকেরা লুকিয়ে সামরিক শাসকদের হাতে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের ধর্ম ব্যবসায়ীরা এখানেও আফগানিস্তানের মতো একইভাবে ধর্মের নামে নিজেদের মধ্যযুগীয় রাজনীতি স্থায়ী করতে চেয়েছে। 

তারা বাংলাদেশিদের পাকিস্তানে এবং আফগানিস্তানে নিয়ে গিয়ে টাকাপয়সা এবং ট্রেনিং দিয়ে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করার জন্য। তারা এখানে এসে জামায়াত-বিএনপি আমলে প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের দল ঘোষণা করেছে। সিলেট এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ে ছোট ছোট ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তুলেছে। দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় ছাত্রদের সন্ত্রাসী ট্রেনিং দিয়েছে। 

বাংলাদেশের রাজপথে জামায়াতে ইসলামী মিছিল করে স্লোগান দিয়েছে, “বাংলা হবে আফগান, আমরা হব তালেবান”। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে তাদের একমাত্র পথের কাঁটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তার নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য একুশ বার সশস্ত্র চেষ্টা করেছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার গ্রেনেড তৈরি হয়েছে পাকিস্তানে। হামলার পেছনে কাজ করেছে তৎকালীন সরকার এবং হামলা করেছে পাকিস্তানের মদদপুষ্ট ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা, যারা হামলার পরে আবার পাকিস্তানেই আশ্রয় নিয়েছে। এত চেষ্টা করেও বাংলাদেশে তালেবানী কায়দার, এমনকি জামায়াতী স্টাইলের রাজনীতিতেও সফল হতে পারেনি। আমেরিকান, সৌদি, পাকিস্তানী বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আর শত চেষ্টার পরেও তাদের সাফল্য না আসার কারণ একটাই - বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘকালের সুস্থ ধারার রাজনীতির চর্চা, যা বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেও শেষ করে দেয়া যায়নি। 

আফগানিস্তানের জনগণের দুর্ভাগ্য এই যে, তাদের দেশে কখনোই সুস্থ রাজনীতির চর্চা হয়নি। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত সেখানে চলেছে সামন্ততন্ত্র। তখন তারা প্রথম পেল প্রজাতন্ত্র। সেই প্রজাতন্ত্রে কয়েক বছর ছিল দুর্বল মার্কিনপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতা দাউদ খানের নেতৃত্ব, তারপর ১৯৭৯ সালে চলে যায় কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রণে। জনকল্যাণকামী মধ্যপন্থী কোনো রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক চর্চা তাদের কোনোকালে ছিল না বলেই আফগানদের আজকের এই পরিণতি। 

হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে আফগান জনগণ ইসলাম গ্রহণ করে। মধ্যপন্থী রাজনীতির চর্চা না থাকলেও ১৯৭৯ সাল থেকে আমেরিকান অর্থ আর অস্ত্র আসার আগ পর্যন্ত আফগানরা উগ্র ইসলামীস্ট ছিল না। ইসলাম দিয়ে কমিউনিস্ট ঠেকানোর আমেরিকান কৌশলের বলি আফগানিস্তান। ইসলামের নামে চলা সন্ত্রাসীরা আফগানদের সভ্য জগত থেকে দিন দিন দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। মোঘল আমলে ভারতের সভ্যতার সঙ্গে তুলনীয় ছিল আফগানিস্তান। বহু প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন রয়েছে সেখানে। আমেরিকার চক্রান্তে মুজাহিদিন, তালেবানি রাজনীতিতে দেশটা পিছিয়ে পড়েছে অনেকটাই। যতদিন সেখানে সুস্থ রাজনীতি ফিরিয়ে না আনা যাবে, ততদিন ঘুচবে না আফগান জনগণের পেছনে হাঁটা। 

আফগানিস্তানে তালেবানদের রাষ্ট্র দখলের প্রভাব উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে কি হবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে তালেবানদের কাবুল দখলের দিন থেকেই। জামায়াতে ইসলামী, তালেবান,  আল-কায়েদা, আইসিসসহ যত ইসলামী জঙ্গিবাদী সংগঠন পৃথিবীতে আছে, তার সবগুলোর জন্ম হয়েছে আমেরিকার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতায়। ইরাক এবং সিরিয়া আইসিস দমন করতে গিয়ে আমেরিকা নিজেদের হাতে বানানো ফ্রাংকেইনস্টাইনের হাতে ভালোই শিক্ষা পেয়েছে। 

রাশিয়ার নাক গলানোতে সিরিয়ার নেতা বাসার আল-আসাদের পতন না করেই, কুর্দিদের হাতে প্রতিশ্রুত কুর্দিল্যান্ড তুলে না দিয়েই পড়িমরি করে পালিয়েছে আমেরিকা। এমন পরিস্থিতিতে হিলারি ক্লিনটনের পর থেকে ধীরে ধীরে জঙ্গিবাদী রাজনীতি থেকে নিজেদের তুলে নিচ্ছিল আমেরিকা। ট্রাম্প আমল থেকে কোনো ইসলামী দলই আর পাচ্ছে না আমেরিকার অর্থ কিংবা অস্ত্র। আফগানিস্তানে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর নাকে খত দিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন আর অন্যদেশে সামরিক আগ্রাসন চালাবেন না বলে তওবা করেছেন। 

আমেরিকানদের অর্থ, অস্ত্র, কৌশল এবং কূটনৈতিক সাহায্য ছাড়া মধ্যযুগীয় উগ্র ধর্মীয় চিন্তাধারার মানুষদের পক্ষে রাজনীতি করাও সম্ভব নয়। তার উপর বাংলাদেশ এবং ভারতের সরকারগুলো সদা তৎপর রয়েছে জঙ্গি দমনে। আমেরিকার টাকা পয়সা বন্ধ হওয়ার পর থেকে পাকিস্তনের রাজনীতিতেও জঙ্গিবাদের গুরুত্ব কমে গিয়ে জঙ্গিবাদ বিরোধী ধারা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের স্থানীয় শক্তি দিয়ে কিছু দিন তারা নামকাওয়াস্তে টিকে থাকতে পারবে বটে, তবে তা বেশিদিন নয়।

লেখক- চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড।

এনএস//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি