গণতন্ত্রের গোরস্তান আফগানিস্তান
প্রকাশিত : ১৫:২৭, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | আপডেট: ১৫:৫৪, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
ক্ষমতার দুর্নিবার অভীপ্সা এবং সহনশীলতার সশস্ত্র সংগ্রামের দুই দশক পর, প্রায় অতর্কিতেই গত পনেরোই অগাস্টের কাবুলে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন তালেবানের। মধ্য অগস্টের সে নিশীথের অবসানে, ম্লান হল বহির-শক্তির ক্ষমতার বর্মে সুরক্ষিত-সুসংহত এক প্রজাতন্ত্র। আবার মাথা চাঁড়া দিল বারুদ-বুলেট-বর্মায় আর উগ্র বিমূর্ত মতবাদের এক অবয়ব-আফগানিস্তান ইসলামী আমিরাত।
তালেবানের পুনরুত্থান এবং নগর দখলের প্রাক্কাল থেকেই উষ্মা ছিল জগতজোড়া। হাহাকার ছিল দেশ জুড়ে।
সন্ত্রাসবাদের জন্য কুখ্যাত নয়-এগারোর বিশ বছর পূর্তিতে, কোন রকম বহর বাদেই শপথ গ্রহণ করে তালিবানদের তেত্রিশ জনের মন্ত্রী ও মাতব্বর সভা। মোল্লা হাসান আকুন্দ প্রধান মন্ত্রী পদ মর্যাদার পদে অভিষিক্ত হন। তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ঘানি বারাদারকে দেওয়া হল উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাখা হল দাগি জঙ্গি এবং হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা আলহাজ মল্লা সিরাজউদ্দিন হাক্কানীর উপর। মূলত বরাদর এবং হক্কানী নেটওয়ার্ক এর অন্তর্দ্বন্দ্বকে সমাধা করার অভিপ্রায়েই এই সিদ্ধান্ত। তবে ইতিমধ্যেই সামনে এসেছে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব। এমনকি বরাদরকে নিগ্রহ করেন হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা খলিলুর রহমান হক্কানী। যা পরবর্তীতে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গুলি চালাচালিতে শেষ হয়।
সবচেয়ে উৎকণ্ঠার বিষয় হলো তালিবানদের এই মন্ত্রিসভা কোনভাবেই তাদের জনজাতির বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে না। তাদের জেদ জারী রেখেই পরিহার করে একটি অন্তর্ভুক্ত পরিকাঠামোর প্রস্তাব। আফগানিস্তান নানা জাতি নানা ভাষার সমাহার। সংস্কৃতির বৈচিত্রতাই তার বাহার। সে দেশের অহম এবং অস্মিতা। আফগানিস্তানের সংবিধানের ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে, পাস্তুন, তাজিক হাজারা উজবেক ব্যতীত ১৪টি প্রধান জনগোষ্ঠীকে সাম্যতার সঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তালিবান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, তাদের এই ক্যাবিনেটে কোনভাবেই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী গুলিকে উপেক্ষা করেছে। তাদের পার্ষদে ৩৩টি মন্ত্রী ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ গুলির মধ্যে শুধু মাত্র দু’জন তাজিক জনজাতির মানুষ এবং একজন উজবেক। তাজিক জনজাতি ভুক্ত কাদ্রি দীন মোহাম্মদ হানিফকে দেওয়া হয়েছে অর্থনৈতিক মন্ত্রিত্ব এবং কারী বাসে উদ্দিনকে নিয়োগ করা হয়েছে সেনাপ্রধান হিসেবে। উজবেকদের মধ্যে থেকে মৌলভী আব্দুল সালাম হানাফী কে দেওয়া হয়েছে প্রধান মন্ত্রিত্বের একটি বিশেষ পদ। দেশে স্থুল হাজারা জনবসতি থাকলেও মূলত শিয়া পন্থী হওয়ায় তাদের মধ্যে থেকে কাউকেই কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত করা হয়নি। প্রায়ই হিংসালীলা চলে হাজারাদের ওপর।
প্রায় চার কোটি নাগরিকের সমাহার আফগানিস্তনে-প্রায় অর্ধেকই নারী। এক কঠিন কঠোর শরিয়া পন্থার দোহায় দিয়ে, নারীদেরকে মন্ত্রিসভার অধিকার থেকে বঞ্ছিত করা হয়েছে। যদিও নারীদের উচ্চ শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান এর ব্যাপারে কিছুটা শিথিল হবে বলেই তাদের ঘোষণা থেকে আশা করা যায়। পূর্বে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল অবধি তালিবান শাসনে কন্যা সন্তান এবং কিশোরীরা শ্রেণিকক্ষে এবং কর্মক্ষেত্রে ছিল সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ। এবারে ক্ষমতায় এসে তারা মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ধূলিসাৎ করে। সে মন্ত্রণালয় নবনামাঙ্কিত হয়েছে নৈতিক মন্ত্রণালয় হিসেবে।
তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে বিদেশের রাষ্ট্রগুলোর কাছে আইন ও কূটনৈতিক ব্যকরণ গত সমস্যা ছিল। রাষ্ট্রপতি ঘানীর পলায়নের পর একই দেশে ছিল তালেবান এবং আমরুল্লাহ সালের অন্তর্বর্তী সরকার। পাঞ্জশিরে আমরুল্লাহ সালে এবং আহমেদ মাসুদের অন্তর্বর্তী সরকারের পতনের পর বর্তমানে একমাত্র তালেবানই গোটা আফগানিস্তান শাসনের দাবীদার এবং অভিভাবক। গোটা দুনিয়ার তালেবানদের প্রতি দৃষ্টিকোণ ও মনোভাব বদলাতে, তালিবানের প্রধান কাজ হওয়া উচিৎ গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার ও মহিলা সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এক রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতাবস্থা এবং হিংসামুক্ত পরিবেশ লালন করাই তাদের আশু লক্ষ্য হওয়া জরুরী। তাদের দারিদ্র্যক্লিষ্ট, যুদ্ধ-দীর্ণ এই আফগানিস্তান শাসন করতে গেলে বৈদেশিক সহায়তা, বিনিয়োগ এবং ব্যবসা এই তিনটে জিনিস অত্যন্ত তাৎপর্যময়।
স্বীয় জাতীয় স্বার্থের সিদ্ধির জন্য পাকিস্তান, ইরান, কাতার এবং তুরস্ক তালিবান সরকারের সঙ্গে আঁতাত গড়ে তুলবে। পাকিস্তানের সামরিক স্নায়বিক কেন্দ্র রাওয়ালপিন্ডি চাইবে যে কোন ক্রমে হাক্কানি নেটওয়ার্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি। তাদের মদত পুষ্ট হাক্কানী নেটওয়ার্ক এর উপর যথেষ্ট ভরসা রাখে পাকিস্তান। সুবিস্তৃত ডুরান্ড লাইন অর্থাৎ আফ-পাক সীমান্তজুড়ে হাক্কানী নেটওয়ার্কের দাপট থাকলে, কিছুটা হলেও নিরাপত্তার ভার লাঘব হবে পাক-সেনার। অন্যদিকে, তালেবানের পাকিস্তান শাখা তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের কাছে যথেষ্ট উদ্বেগের। তাদেরকে দমিয়ে রাখতে এই হাক্কানীই বেশ শানিত এবং প্রযোজ্য অস্ত্র। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের ব্যাবসায়িক এবং অন্যান্য সম্পর্ক ছেদ করতে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাবে ইসলামাবাদ। ভারত মূলত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর মত আগামীতে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে। তালেবানের অভ্যুত্থানে চীনের ফায়দা হলেও, তুর্কমেনিস্তানের ভূখণ্ডে বাসা বাঁধা ইস্ট তুর্কমেনিস্তান ইসলামিক মুভমেনট চীনের কাছে আশঙ্কার। ওই সংগঠন চীনের উইগুর মুসলমান সমাজে প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তার করতে পারে। তাই তালেবানদেরকে এবিষয়ে কড়া বার্তা দিয়েছে বেজিং। সন্ত্রাসবাদ অব্যাহত থাকলে, তা আফগানিস্তানে চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের গতিকে শ্লথ করবে।
তালিবান শুধু একটি উগ্র ইসলামপন্থী দলই নয়। তালিবান একটি মতবাদ যার প্রসার প্রভাব কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। একটি প্রতিষ্ঠিত মতবাদকে কখনো বিস্ফোরক দিয়ে ওড়ানো যায় না বা বুলেটে বিদ্ধ করা যায়না। আফগানিস্থানে ব্রিটিশ থেকে সোভিয়েত, সোভিয়েত থেকে পেন্টাগন যে সৈন্যদলই এসেছে তারা নির্দিষ্ট সময় পর ফিরে গিয়েছে। কিন্তু তালিবান দুর্নিবার স্পর্ধা নিয়ে মাটি কামড়ে পড়েছিল দুর্গম ভূখন্ডে। এমনকি মার্কিন এবং ন্যাটো সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতেও তালিবান বেশকিছু জেলায় এক সমান্তরাল প্রশাসন চালাত। বিশ বছর বাদে ক্ষমতায় ফিরে, তালিবান যে উদ্ধত্যপূর্ণ এবং অমানবিক আচরণ করবেন না, তা কল্পনা করাটাই অলীক। আছে আরও এক উদ্বেগের হেতু। এবার তালিবান ক্ষমতায় একা নয়। মূলত ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়েছে হাক্কানীর সঙ্গে একটি জোট সরকার। হাক্কানী ছাড়াও তোরাবোরা মিলিটারি ফ্রন্ট এবং অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী দল সংগ্রামে লিপ্ত। এদেরকে দমিয়ে রাখা ও তালিবানদের কাছে হবে প্রতিবন্ধকতার। সংখ্যা গরিষ্ঠ এবং প্রশাসক পাস্তুন দের মধ্যেও রয়েছে নানা ভেদাভেদ এবং বেশ কয়েক টি উপ-জাতি। জাতি গোষ্ঠীগুলোর নিজেদের মধ্যে বিবাদ এবং অন্তরকলহ, এদেশে আচলাবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখবে।
অন্যদিকে আল কায়দা, ইসলামিক স্টেটের মত উগ্র জঙ্গিদের বধ্যভুমি এই আফগানিস্তানকে, সুষ্ঠু এবং সুশৃঙ্খল শাসন ব্যবস্থার আবরণে জড়িয়ে ফেলা তালেবানদের কাছে আগামীর দায় হয়েই থাকবে। সাম্রাজ্যের সমাধি নামে পরিচিত আফগানিস্তানে তালেবানদের হর্ষ বলে গেল মিথোজীবী গণতন্ত্র বড় ক্ষণজীবী। তারা মহাউল্লাসে নিভৃত এক গোরস্থানে খুঁড়ে গেল গণতন্ত্রের গভীর কবর।
(লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক এবং পি এইচ ডি-রত কূটনীতি গবেষক।)
এসএ/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।