ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

জেল হত্যা দিবসের নৃশংসতা

ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে

প্রকাশিত : ০৮:০৯, ৩ নভেম্বর ২০২১

আমরা সকলেই জানি বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ দুটি সমার্থক শব্দ। বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র গঠনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান বাংলার ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ যা মুছে ফেলার ক্ষমতা কারো নেই। তবে একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপশক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে।  

১৯৪৭ সালের দেশভাগ হওয়ার পর থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যেভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছিল সেই বৈষম্য দূর করা এবং বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য শেখ মুজিব ১৯৫০ পরবর্তী বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ গঠন প্রক্রিয়ায় সরাসরি ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৬ এর ছয় দফা, ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। 

এই প্রত্যেকটি রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই যোগ্য নেতৃত্বের বাংলার মানুষ পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মাত্র নয় মাসের মধ্যে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। এটি সত্য যে পাকিস্তানী জান্তা সরকার অনেক চেষ্টা করেছিল বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে তাকে সরিয়ে দিয়ে সামরিক শাসন চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু তারা বঙ্গবন্ধুর ভেতরে যে রাজনৈতিক সত্তা, সেটিকে সঠিকভাবে বুঝতে পারেনি। এই কারণেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে কূটনৈতিক ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে একটি অবিচ্ছেদ্য নাম, ঠিক তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশকে বুঝতে হলে বঙ্গবন্ধুর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহচর, বিশেষ করে আমাদের জাতীয় চার নেতা (তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী) সম্পর্কে এবং ১৯৭১ সালের ৩রা নভেম্বরের নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানা উচিত। 

আমরা সকলেই জানি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সমস্ত রাজনৈতিক আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমনকি ২৫ মার্চ রাত্রে স্বাধীনতার ঘোষণার দেওয়ার পরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধুই ছিলেন। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতারা, বিশেষ করে জাতীয় চার নেতা, যেভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন এবং পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের সাথে যোগাযোগ রেখে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন তার জন্যই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আলাদা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলেও তখনও বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। ওই সময় তিনি মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন; কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাজানো মিথ্যা মামলায় তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যেমন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে তার সহচররা চেষ্টা করে গেছেন কিভাবে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করা যায়। তাই তারা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন এবং এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে বাংলার মাটিতে পদার্পণ করেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। 

দেশে ফিরে এসেই বঙ্গবন্ধু তার এই ঘনিষ্ঠ সহচরদের নিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন।  তার মূল লক্ষ্য ছিল সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা এবং এই সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তিনি নিয়েছিলেন। তবে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে সকলকে খুশি করা সম্ভব হয়নি বিধায় দলের মধ্যে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার ঘনিষ্ঠ সহচরদের অনেককেই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ব্যবধান তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু এই চার নেতা বঙ্গবন্ধুর  প্রতি এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে তার সব সময় বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন।

কিন্তু যখন হায়েনার দল দেখল বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন কার্যক্রম পাকিস্তান সরকারের এবং পাকিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে তখন তারা আবার ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাতে বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যদের সাথে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং তৎপরবর্তী সময়ে খন্দকার মোশতাক, যিনি ইতিহাসে মীরজাফর হিসেবে পরিচিত, ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। 

খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখলের পর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর যারা ছিলেন তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন তার সরকারে যোগদানের জন্য। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেযন। কিন্তু যে চারজন নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বেঈমানি না করে মন্ত্রিসভায় অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তারা ছিলেন আমাদের জাতীয় চার নেতা।

জাতীয় চার নেতা যখন মোস্তাকের মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান, তখন তাদেরকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে রাখা হয়। তাদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট চার্জ না থাকলেও কারান্তরীণ রাখা হয়। চেষ্টা করা হয়েছিল, তাদেরকে  কারান্তরীণ রেখে ভয়-ভীতি দেখিয়ে মোশতাক সরকারের মন্ত্রিসভায় অংশ গ্রহণে বাধ্য করা। কিন্তু তারা যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতোই কঠিন। তারা কখনও তাদের নীতির সাথে এবং তাদের গুরুর সাথে বেইমানি করেননি। তাদের এই সিদ্ধান্তে তৎকালীন হায়েনার দল খুশি হতে পারেনি বিধায় কারান্তরীণ অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভোর রাত্রে জাতির চার সূর্যসন্তানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কারাগারকে সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান বিবেচনা করা হয়। এমনকি যারা অপরাধ করে তাদেরকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কারাগারে রাখা হয়। কিন্তু এই সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থানে নৃশংসভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা ছিল ইতিহাসের একটি জঘন্যতম ঘটনা। 

তাদেরকে হত্যা করার মূল লক্ষ্যই ছিল তারা যেন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের জনগণকে অনুপ্রাণিত করতে না পারেন, যেমনটি তারা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। 
এখন প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন হল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে জাতীয় চার নেতাকে কেন হত্যা করা হয়েছিল? 

এই প্রশ্নের একমাত্র উত্তর হল- এই হায়েনার দল বঙ্গবন্ধুকে যেমন ভয় পেত ঠিক তেমনিভাবে তার ঘনিষ্ঠদেরও ভয় পেত। তারা মনে করেছিল, এই চারজন জাতীয় নেতা যদি জেলের বাইরে থাকে তবে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করবেন এবং একইসাথে দেশব্যাপী আন্দোলনের ডাক দিতে পারেন। পাশাপাশি বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে পারেন। এই ভয়ে মোস্তাকগং ইতিহাসের আরেকটি জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটায় ৩ নভেম্বর।

জেলহত্যা দিবসে রাজনৈতিক-অর্থনীতি যদি আমরা বিচার করার চেষ্টা করি তাহলে দেখব যে হায়েনার দল ভেবেছিল, আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত করার জন্য যে চারজন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত তারা ছিলেন বঙ্গবন্ধু ঘনিষ্ঠ চার সহচর। তারা খুব ভালোভাবেই জানতেন যে, তারা বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে কখনো বেইমানি করবেন না।
তবে এই ঘাতকের দল বুঝতে পারেনি যে বঙ্গবন্ধু এবং তার চার ঘনিষ্ঠ সহচরকে নিহত করা সম্ভব হলেও তাদের অবদান বাংলাদেশের জনগণ কখনই ভুলবে না। তাদের অবদানকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা সফল হয়নি ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা দেশে ফেরার মধ্য দিয়ে। 

দেশে ফিরে শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বই গ্রহণ করেননি, তিনি ভঙ্গুর আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেছেন, ক্ষমতায় নিয়ে গেছেন এবং সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। কোনোটি শেষ হয়েছে, আবার কোনোটি চলমান। 

আসুন ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাই এবং সেইসঙ্গে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে দেশ গড়ার কাজে একসঙ্গে নিয়োজিত হয়। এটিই হোক ২০২১ সালের জেল হত্যা দিবসের মূলমন্ত্র।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর। 

এএইচএস/এসবি


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি