কপ-২৬: উষ্ণতা বেড়ে চলুক দেশের সম্পর্কে
প্রকাশিত : ১৫:৩০, ৪ নভেম্বর ২০২১
করোনার প্রকোপ কিছুটা শিথিল হতেই স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ৩১ শে অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর অবধি অনুষ্ঠিত হচ্ছে ষড়বিংশ কপ (কপ-২৬) শীর্ষক বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন। যদিও কপ বা কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিস ২৬ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গত বছর নভেম্বরে। দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত জীবাশ্ম জ্বালানির দহনে, দুর্বিষহ দৈনন্দিন জীবন। তার থেকে রেহাই পেতে নানা পরিকল্পনার বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের ও বিশেষজ্ঞদের চিন্তাভাবনা একত্রিত করবে এই সম্মেলন। কপ-২৬ মূলত দুটি বিভাগে বিভক্ত। গ্রিন জোন এবং ব্লু জোনে বিভক্ত। ব্লু জোন মূলত রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি ও নির্বাহী আধিকারিকদের জন্য। গ্রিন জোনে থাকবেন পরিবেশ বিষয়ে উৎসুক সাধারণ মানুষ। এই সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহে কার্বন, পরিবেশ ও জলবায়ু খাতে বিভিন্ন দেশের অর্থ ব্যয়, বৈশ্বিক জলবায়ু ইত্যদি নিয়ে আলোচনা হবে। দ্বিতীয় সপ্তাহে থাকবে লিঙ্গ, পরিবহন এবং বিভিন্ন সমধান মূলক আলোচনা।
কোভিডের প্রকোপে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া এ পৃথিবীতে, পরিবেশের প্রতি সচেতনতা অনেক হ্রাস পেয়েছে। পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে কপ-২৬ নানা অগ্রণী ভূমিকা নেবে বলেই আশা রাখা যায়। প্রায় দু’শরও বেশি দেশ থেকে আসা পরিবেশ চিন্তাবিদদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া হবে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমাতে তাদের পদক্ষেপ ও চিন্তাধারা।
১৯৯৫ সাল থেকে ইউএন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স হয়ে আসছে প্রতিবছর। কনফারেন্স অফ দ্য পার্টিস মূলত ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সামিট। ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, ইউএন কনভেনশন টু কমব্যাট ডিসার্টিফিকেশন এবং কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি এই তিনটিই ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে আর্থ সামিটে জন্ম নেয়। জাতিসংঘের প্রত্যেক সদস্যই ইউএনএফসিসিসি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনসহ প্রায় একশ রাষ্ট্র নেতা-নেত্রী কপ-২৬ এ অংশ নিয়েছেন। ব্রিটিশ মন্ত্রী এবং কপ-২৬ এর সভাপতি অলক শর্মার মত অনুসারে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে এখন থেকেই দীর্ঘ পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি এবং এই সম্মেলনই শেষ সুযোগ। নচেৎ সমুদ্রসীমার স্ফীতি ঘটার কারণে অনেক দেশই পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস অলক শর্মার বক্তব্যকে সম্মতি দিয়ে জানান, এই কপ-২৬ই হল শেষ ও চূড়ান্ত সুযোগ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জানান, এই সম্মেলনের মাধ্যমে সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নত দেশগুলোকে তাদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) এবং জাতীয় কার্বন নিঃসরণ হ্রাস এর জন্য আবেদন জানান। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম এবং ভি-২০ ( দ্য ভালনরেবল ২০) এর সভাপতি শেখ হাসিনা সিভিএফ এবং কমনওয়েলথ এর মধ্যে সহযোগিতার জন্য ছয় দফার একটি প্রস্তাবও দাখিল করেন। উন্নত দেশগুলোর উচিত অভিযোজন এবং প্রশমনের মধ্যে ৫০:৫০ আনুপাতিক হারে ভারসাম্য রাখা। উন্নত দেশগুলোকে এই নির্দিষ্ট তহবিলে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার প্রদানের কথাও স্মরণ করান প্রধানমন্ত্রী হাসিনা।
জলবায়ুর কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে স্বল্প ও সুলভ মূল্যে পরিচ্ছন্ন এবং সবুজ প্রযুক্তি প্রদান করা উন্নত দেশগুলির কর্তব্য। সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম বা সিভিএফ দেশগুলিকে সাহায্য করা উন্নত দেশগুলোর মধ্যেই পড়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, নদী ভাঙন এবং পরিবেশগত কারণে পরিযোজন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রী এই মঞ্চে আরও অবহিত করেন ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয় এবং এবছর বাংলাদেশ সরকার ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী গ্লাসগোতে এই সম্মেলনে অংশ নিয়ে ভারতের তরফ থেকে পাঁচটি প্রতিশ্রুতি দেন। ভারত ২০৩০ সালের মধ্যে অজীবাশ্ম শক্তির পরিমাণ ৫০০ গিগাওয়াটে রাখবে। দ্বিতীয়ত, ২০৩০ সালের মধ্যে মূল শক্তির ৫০ শতাংশ পুনর্নবীকরণ শক্তির মাধ্যমে পূরণ করবে। তৃতীয়ত, ২০৩০ সাল পর্যন্ত যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হওয়ার পূর্বাভাস আছে, তা এক বিলিয়ন টন কম করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। চতুর্থত, কার্বন নিঃসরণ ৪৫ শতাংশ কম করবে ২০৩০ সালের মধ্যেই। পঞ্চমত, ২০৭০ সালের মধ্যে ভারত কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে স্বক্ষম হবে।
প্রতিটি দেশের নির্দিষ্ট ভূ-সীমানা, জলসীমান্ত, বনজ সম্পদ এবং আকাশসীমা থাকলেও পরিবেশ মূলত গোটা দুনিয়ার কাছে একটি সার্বজনীন সম্পদ। গুটিকয়েক উন্নত দেশের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা, শিল্পোন্নয়ন এবং নানাবিধ অত্যাধুনিক যান্ত্রিক ব্যবহারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গোটা দুনিয়া। পিছিয়ে পড়া দেশগুলো ধুঁকতে থাকে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর নিঃসরণে। তাদের নির্মল আকাশে মিশতে থাকে বিষ-বাষ্প। জলবায়ু ও পরিবেশগত কারণে বিপদসীমায় ঝুলে থাকা দেশগুলো থেকে যায় আশঙ্কায়, অনিশ্চয়তায় এবং আতঙ্কে। কনফারেন্স অফ পার্টিস এর অন্যতম মুখ্য বিষয় হবে একে অপরের আস্থা অর্জন করা। একমাত্র তবেই গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখা যাবে।
উষ্ণতা বাড়ুক দেশের সঙ্গে দেশের সম্পর্কে। কার্বনের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হোক পৃথিবী।
লেখক: ভারতীয় সাংবাদিক এবং কূটনীতি গবেষক।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।