ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া সম্ভব

মো. আবু জাফর সিদ্দিকী

প্রকাশিত : ১৫:২০, ২৭ জানুয়ারি ২০২২ | আপডেট: ১৫:২১, ২৭ জানুয়ারি ২০২২

সামাজিক ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা সংরক্ষণের তাগিদে আমরা ন্যায়বিচার শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছি। পৃথিবীর আদিকাল থেকে এক সময় যা ন্যায়বিচার বলে বিবেচনা করা হয়, তা হয়তো অন্য সময়ে একইভাবে বিবেচনা নাও হতে পারে। সেকারণে ন্যায়বিচার শব্দের আপেক্ষিকতা স্থান, কাল ও সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, “যে ব্যক্তি দেশের আইন লংঘন করে অথবা তার যা প্রাপ্য তার চেয়ে বেশী গ্রহন করে, সে অন্যায়কারী অথবা ন্যায়বিচার বিরোধী” উল্লেখিত গুনাবলী নিয়ে কোন মানুষ ন্যায়বিচারের ধারণা করতে পারে না। অবিচার থেকে ন্যায়বিচারের প্রয়োজন সহজে অনুভব করা যায়। বিভাগপূর্ব তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন আমলে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে নির্বাহী কর্তৃপক্ষ যাবতীয় প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করতো। ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠির নিকট রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করার অবকাশ ছিলনা, তখন ন্যায়বিচারের অর্থ ছিল রাজঅনুগ্রহ। সাধারণ মানুষ অনন্যোপায়। “নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে, দরিদ্রের ভগবানে বারে ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে, মরে সে নীরবে;” সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং শাসকের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করার কোন উপায় নেই। ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের জালিয়ান ওয়ালাবাগের নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার কে করবে? “আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিচ্ছায়ে হেনেছে নিঃসহায়, আমি যে দেখেছি শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।”

১৯৪৭ সালে বিদেশী শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে তৎকালীন ভারতবর্ষ দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। উভয় দেশের সংবিধানে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করা হয়। আদালতের আইন কানুন ও ন্যায়বিচার করার অধিকার কোন প্রকার ক্ষুণ্ন করা হবে না, পাকিস্তানে ইনসাফ কায়েম করা হবে। কিন্তু নফছের অনুস্বরনে ইনসাফ পাকিস্তান থেকে বিদায় নিলো। ভারতে অবশ্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। জে, কে, আয়রণ ইউনিয়ন কোং বনাম মজদুর ইউনিয়ন (AIR 1956SC 231) এর মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট বলেছে, কেবল মাত্র নির্বাহী কর্তৃপক্ষের অথবা কর্মচারীগণের ও নিম্ন আদালত সমূহের যথেচ্ছ ক্ষমতা প্রয়োগের প্রতিরোধ করাই নয়, আইন পরিষদ সমূহের তথা পার্লামেন্টেরও যথেচ্ছ ক্ষমতা প্রয়োগের প্রতিরোধ করার কর্তৃত্ব এই আদালতের উপর সংবিধান ন্যস্ত করেছে।

আইন পদ্ধতির মৌলিক বিধি উপেক্ষা করে কোন ব্যক্তিকে তার জান-মাল ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যায় না। যে আইন পদ্ধতিতে ন্যায়পরতার নুন্যতম প্রয়োজনীয় বিধি অনুস্বরনের নিশ্চয়তা থাকে না তা থেকে নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষিত হয় না। নির্বাহী কর্তৃপক্ষ ও আইন পরিষদের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপে প্রতিরোধকল্পে সংবিধানে ন্যায়বিচারের বিধান করা হয়েছে। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আহব্বানে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবন ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্মের পর ১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর আমাদের মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদিত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে। “আমরা আরও আঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষনমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্যে আইনের শাসন, মৌলিক মানবধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।” Further pledging that it shall be a fundamental aim of the State to realise through the democratic process a socialist society, free from exploitation a society in which the rule of law, fundamental human rights and freedom, equality and justice, political, economic and social, will be secured for all citizens যা ঐ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের শাসনের মূল দর্শন হিসাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। All citizens are equal before law and are entitled to equal protection of law.

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং বাংলাদেশের ন্যায় অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানে আইনানুগ ন্যায়বিচার মূল দর্শন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ, আইন পরিষদ ও নিম্ন আদালত সমূহের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ থেকে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মর্যাদা রক্ষার এটাই একমাত্র রক্ষাকবচ। মানুষের জন্যেই সরকার, মানুষ সরকারের জন্যে নয়, এই মতবাদ থেকে আইনানুগ ন্যায়বিচার নীতি জন্ম লাভ করেছে। এই নীতি অনুসারে জনগণ নির্দিষ্ট আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আগেকার দিনে রাশিয়া, চীন ও স্পেনের ন্যায় একদলীয় শাসন পদ্ধতিতে আইনানুগ ন্যায়বিচার কল্পনা করা যেত না। সামরিক শাসনেও এরুপ অবস্থার অবতারনা হয় যা সুশাসন ও ন্যায়বিচারের দর্শনে গ্রহন যোগ্য নয়।

একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্যে (১) আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (Due process of Law). (২) আইনের শাসন (Rule of Law). (৩) আইনের বিধি বহির্ভূত কোন নিয়ন্ত্রন আরোপ না করা (Save in accordance with law). (শুনানীর সুযোগ দান ব্যতীত দন্ড দান না করা (Audi Alteram Partem). (৫) কেহ নিজের বিচারক নিজে হতে পারে না (No person can be a judge of his own cause), (৬) সার্বভৌম কোন অন্যায় করতে পারে না (King Can do no wrong), (৭) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আদালতের সহজাত এখতিয়ার (Inherent Jurisdiction), (৮) ন্যায়পরতা ও বিচক্ষনতা (equity and expediency) (৯) পুনঃ বিবেচনা (Review), (১০) দায় অব্যাহতি বিধি (Immunity) অনুসরণ করা হয়।

লর্ডহলসবেরি নাগরিক স্বাধীনতার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলে, “প্রকৃত পক্ষে নাগরিকদের তথাকথিত স্বাধীনতার দুটি মৌলনীতি গৃহীত হয়েছে; দেশের মূল আইন লংঘন না করা এবং অন্যের বৈধ অধিকারে হস্তক্ষেপ না করা” একজন নাগরিক তার খুশীমত যা ইচ্ছে করতে ও বলতে পারে, সেজন্যে কোন সরকার আইনের স্বীকৃত বিধান অথবা সংবিধি ব্যতীত কিছুই করতে পারে না। যেহেতু সরকার কোন নাগরিকের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না, অতএব, সে স্বাধীন। ব্রিটিশ আইনপদ্ধতি অনুসারে আইনের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় যাবতীয় বিধি নিষেধ আরোপ ও বলবৎ করা হয়। কার্যতঃ এই প্রক্রিয়াটি লর্ড হিউয়ার্টের উক্তির মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে, তার মতে “ন্যায়বিচার শুধুমাত্র করলেই চলবে না, ন্যায় বিচার যে করা হয়েছে তা প্রতীয়মান হওয়া চাই।”

আইনানুগ ন্যায়বিচার একটি গণতান্ত্রিক চেতনা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পরম নির্দেশনা। এই প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত আইনবিদ ইউলিয়ম পিট বলেছে, “দীনতম ব্যক্তিও তার ভঙ্গুর কুটিরে রাজশক্তির প্রবেশ প্রকাশ্যভাবে অস্বীকার করতে পারে। তার কুটির খানি হতে পারে জীর্ণ শীর্ণ, হয়তো উহার ছাউনি দোলায়মান, হু হু করে উহার ভিতর বাতাস বইছে, উহাতে ঝড় বৃষ্টিও প্রবেশ করতে পারে; কিন্তু ইংল্যান্ডের রাজা উহাতে প্রবেশ করতে পারে না, রাজার ফৌজ সে ভগ্ন কুটিরের চৌকাঠ মাড়াতে সাহস করে না।” রাষ্ট্র কর্তৃক আইনানুগ ন্যায়বিচারের এই বিশুদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি ব্যতিরেকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কি আদৌ সম্ভব?

জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বিশ্বের সেরা সংবিধান বাঙ্গালী জাতিকে উপহার দিয়েছেন, উক্ত সংবিধানের ৩২নং অনুচ্ছেদে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার ওয়াদা করা হয়েছে, “আইন অনুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবেই না।” (No person shall be deprived of life or personal liberty save in accordance with law.) এখনো আমাদের সংবিধানে বলবৎ আছে।

বিচারকের নিরপেক্ষ ভূমিকা যেমন ন্যায় বিচারের জন্যে অতীব প্রয়োজনীয়, তেমনি বিচারকের রায় আইনসম্মত পদ্ধতিতে গৃহীত হয়েছে বলেও প্রমানিত হওয়া আবশ্যক। প্রতিহিংসা কিংবা পক্ষপাতিত্ব যেন বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বিনষ্ট না করে। “দন্ডের সাথে দন্ড দাতা কাঁদে সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।”

মানুষ যুক্তি নির্ভর সামাজিক জীব। সমাজের সহস্র বাঁধনের মাঝে সে মুক্তির স্বাদ লাভ করতে চায়। ভয়-ভীতি থেকে আত্মরক্ষার জন্যে জানমালের নিরাপত্তার জন্যে, জীবনে পূর্ণতা লাভের জন্যে সমাজ গড়ে উঠে। পারষ্পারিক সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্যে মানুষের সামাজিক চেতনা ও দর্শন বিভিন্ন রূপে অভিব্যক্ত হয়। তবে সকল সমাজে একটি অভিন্ন দর্শন আছে, দুঃখ-দৈন্য পরিহার করে সুখ-শান্তি-সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি সাধনের জন্যে নিরলস প্রচেষ্টা। এই ঈপ্সিত লক্ষ্যে উপনীত হতে প্রত্যেক ব্যক্তির আচরণ সমাজের কথিত মূলদর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই আচরণ নিয়ন্ত্রনের কৌশল অবলম্বন ব্যতীত একটি সুশৃংখল জীবন ব্যবস্থা, সভ্যতার অস্তিত্ব, সমাজে কল্পনা করা যায় না। সর্বকালে সকল সমাজে তাই একটি যুক্তি সঙ্গত আচরণ বিধি উদ্ভাবন ও কার্যকর করার নিরলস প্রয়াস এখনো লক্ষ্য করা যায়।

জনকল্যাণকামী সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা পরিকল্পনার জন্যে ন্যায় বিচারের উদ্দেশ্যে মানুষের আচরনের জন্যে একটি নির্দিষ্ট আদর্শে স্থানীয় বিধি থাকা বাঞ্ছনীয়। সমাজের সকলেই উহা অনুস্বরণ করবে অথবা সামাজিক শক্তিবলে উহা পালন করতে বাধ্য করা হবে। সীমা লংঘনকারীকে অবশ্যই দন্ড দেয়া হবে। দন্ডের ভয়ে দুর্বৃত্ত ও দুষ্ট লোকেরা আইন ভঙ্গ করতে সাহসী হবে না। আইন ভঙ্গের জন্যে স্ব-মহিমায় আইন উচ্চারিত হবে, আইন ভঙ্গের দায় নির্ধারন ও দন্ডদানের জন্যে সমাজ ব্যবস্থায় বিচার প্রশাসন পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হয়। আদিকাল হতে বিভিন্ন সমাজের দর্শনের আলোকে বিচার প্রশাসন পদ্ধতির প্রচলন চলমান আছে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আপীল বিভাগের সরকারী কৌশুলী।
এসএ/
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি