শিক্ষার বয়ান
প্রকাশিত : ১২:২৮, ১ মার্চ ২০২২
মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অবস্থার পরিবর্তনে সক্ষম কোনোকিছু আঁকড়ে ধরা এবং এর ভেতরে প্রবেশ করে নিজের সাবলীল সাঙ্গ চরিতার্থ করার উপায় অন্বেষণ করা। এতে দোষের কিছু নেই। বরং সমাজে ক্রম-বিবর্তনের প্রেক্ষাপট ও ইতিচিত্র সাক্ষ্য দেয় যে, চলতে হলে কিংবা বাঁচতে হলে কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে।
ঘটনার পরম্পরা ও অনুকূল পরিস্থিতির উদ্ভাবনে মানুষ শিক্ষাকে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য কৌশলগত প্রক্রিয়া হিসেবে বেছে নিয়েছে এবং অনুশীলনের ফলে পর্যায়গত সাফল্যধারা পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করে শাসনরেখার ওপর মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উত্তম রচনাপর্ব শুরুর সর্বপ্রকার রসদ যোগান দিচ্ছে। পরিবর্তনের কৌশল হিসেবে শিক্ষা এবং উৎপত্তিগত পর্বে মানুষের সম্পৃক্ততার বিষয়ে চিন্তালদ্ধ বয়ান বলছি।
মানুষ আদিবাস থেকে বর্তমান সময়ে পদার্পণের সকল চলন্তিকা শিক্ষার ওপর ভর করে নির্মাণ করেছে। কারণ, মানুষ দেখেছে অক্ষর, শব্দ আর বাক্যের বিন্যাসে জ্ঞানের মাধুর্য স্বল্প সময়ে পরিবর্তনের বাহক হতে তাকে প্রেরণা দেয়।
পরিবর্তনের আরো কতিপয় মাধ্যম রয়েছে, যা চটকদার বিজ্ঞাপনের মতো- এই আছে, এই নেই; এবং এগুলো দীর্ঘস্থায়ী প্রশান্তি বয়ে আনতে পারে না। ক্ষমতা, অর্থের দাপট, অস্ত্রের মহড়া, সম্পত্তির সমারোহ- এসব মানুষের প্রয়োজন রয়েছে। তবে কতটুকু? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে মতপার্থক্য চলমান। হয়তো কোনোদিনই এর সর্বজনবিদিত সমাধানসীমা নির্ধারিত হবে না।
পরিবর্তনের এসব মাধ্যম বা উপকরণ পৃথিবীতে অশান্তির উত্তপ্ত বহর বিছিয়ে দিয়েছে মানুষের মস্তিষ্কের গহরে। মানুষ অন্যায়ে প্রভাবিত হয়েছে। মানুষ দখলদারিত্বের দাপটে মানুষের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে। বিছিন্নতাবোধে মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। মানুষের মনে হয়েছে, এখানেই প্রশান্তির বার্তা। কিন্তু ভুল! এই ভুল এখনো মানুষের দরজায় কড়া নাড়ে। মানুষ উদ্ভুদ্ধ হয় অন্যের অধিকারে অন্যায় হস্তক্ষেপ বিস্তৃত করতে। মানুষ ভুলে যায় জীবনের আদর্শিক ভাবনার সমাপ্তি কিংবা জীবনের পরিবর্তিত চালচিত্র। যেখানে দেখা যাবে মানুষের আফসোস আর আকুতি। কিন্তু সময় শেষ!
পক্ষান্তরে, শিক্ষা পৃথিবী পরিবর্তনের উদ্ভাবনী শক্তিসমূহের মধ্যে অত্যন্ত দাপুটে ও সহনশীল মনোবৃত্তির এক অধ্যায়। যেখানে দূরত্ব নয়, নৈকট্য সৃষ্টি হয়। যেখানে অন্ধ বিশ্বাস নয় বরং বিজ্ঞান আর যুক্তির খেয়ালে মানুষের মনোজগত প্রসারিত হয়। চিন্তার অভিষেক মানুষকে ভাবায় কীভাবে পরিবর্তনের কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন হতে পারে, মানুষের কল্যাণে। সমাজ পরিবর্তনের হাত ধরে দীর্ঘপথ হেঁটে চলছে। তিক্ত-ভিক্ত অভিজ্ঞতার কথনে মানুষের জ্ঞান-পরিসীমায় যুক্ত হয়েছে উত্তর আধুনিকতার অতি গতিশীল আয়োজন। যা সবাই, সবখানে, সমানভাবে মেনে নিতে পারেনি।
তবে শিক্ষার মাধ্যমে পরিবর্তনের ঘোষণা অথবা ব্যক্তিকে প্রস্তুতকরণের প্রাথমিক কর্মাদি সবাইকে আকৃষ্ট করে। এই ভাবনায় তাড়িত করে যে, জ্ঞান কখনো ভুল পথ দেখাবে না। যদি না মানুষ একে ভুল পথে বা স্বার্থে কাজে না লাগায়। এটিতো সর্বজনীন স্বীকৃত সংগীতমালা যেখানে সবাই টের পায় তাদেরই কথা বলছে কেউ একজন। যে হয়তো অপরিচিত। শিক্ষার তাৎপর্য দেশ-সমাজ-ব্যক্তি অতিক্রম করে দূরান্তে দৃষ্টি মেলে সবাইকে সম্পৃক্ত করে এগিয়ে যাওয়ার শুভবোধের সহজাত কামনায়।
শিক্ষার প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন মানুষের দূরত্ব দূর করেছে, নৈকট্য এখন হাতের নাগালে। চাইলেই সম্ভব প্রিয়জনের মুখের ওপর বসিয়ে দেয়া প্রিয় কথার সম্ভাষণ। লক্ষ্যনীয় যে, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন কোনো একটি দেশের মধ্যে সীমিত নেই। ছড়িয়ে পড়েছে, আকৃষ্ট করেছে।
পৃথিবীর সীমানা এখন একটি গ্রামের রূপ ধারণ করেছে; দিন দিন আরো ছোট হচ্ছে। তবে শিক্ষার আদর্শিক ও জনকল্যাণকর দিকের ওপর সেবামুখী দৃষ্টি যত প্রসারিত হবে তত মানুষ খুঁজে পাবে স্বস্তির বাতায়ন। অস্ত্রের কারুকার্য পরিত্যক্ত হবে, বিছিয়ে যাবে জোছনার গালিচা। মানুষের কল্যাণের জন্য শিক্ষার প্রয়োগ এইভাবে পরিব্যাপ্ত হচ্ছে।
শিক্ষা একজন মানুষের অন্তরের গহীনে জমে থাকা কালো ময়লা পরিশুদ্ধ করে, করে নতুন ও অভিনব বিষয়তত্ত্বের প্রতি গুণগ্রাহী। ব্যক্তির আচরণিক পরিবর্তন শিক্ষার অন্যতম আদর্শিক আধেয়। সাম্প্রদায়িক চিন্তার অসুখ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনার মনোবল জাগ্রত করে মননে এবং পরিপুষ্ট করে এগিয়ে দেয় ব্যক্তিকে, দিয়ে যায় পরিবর্তনের ডাক। জাতিসত্তার মূল চেতনায় ব্যক্তিকে নিয়োজিত রাখা শিক্ষার অন্তর্নিহিত শক্তি। একজন ব্যক্তি শিক্ষার পরিধিভূক্ত হলে যতপ্রকার অশুভ প্রচেষ্টা সক্রিয় রয়েছে, সেসব থেকে নিজেকে দূরে রাখে।
ফলে অশুভ শক্তির ক্ষমতা কমে যায়। শিক্ষিত ব্যক্তিরাই অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে সমবেত কোরাস গায়, ভয় ধরিয়ে দেয় অনিষ্ঠকারীদের কলিজায়। পরিবর্তন কিংবা উন্নয়নের ঝাঁঝালো গতিপথ শিক্ষার প্রাগ্রসর উদ্ভাবনের মাধ্যমে নিশ্চিত হবে। শিক্ষার পথ ব্যতিরেকে ভিন্ন পথে অকল্যাণের পরিসর খুব স্বল্পতে বৃদ্ধি পেলেও তা টেকসই হয় না। বয়ে আনে অনিষ্ঠের যত সমারোহ, সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলার আয়োজন। সততার প্রকৃত অনুশীলন শিক্ষার সতত আহ্বান। জাতিস্বত্তার মূল উপজীব্যতা গড়ে ওঠে শিক্ষার বিস্তৃতকরণ ও সহজলভ্যতার পরিবেশ কতটা সকলের করা সম্ভব হয়েছে তার ওপর।
বাংলাদেশ কিংবা বৈশ্বিক রাজনীতি ও সন্ত্রাসবাদের সম্প্রসারণ এবং এর মাধ্যমে প্রশান্তির ঘরে অসুখের বাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছে সেই সব ব্যক্তি, যারা শিক্ষার প্রকৃত শক্তি ধারণ করতে পারেনি। শিক্ষা মানুষকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদসহ সকল প্রকার অশুভ পাঁয়তারা থেকে বিরত রাখে। উদ্বুদ্ধ করে কল্যাণের পথে, যা শুভশক্তি জাগ্রত করে, শিক্ষা সেখানে হাসিমুখে ছড়িয়ে পড়ে। এবং ছড়িয়ে দেয় মুক্তার মত মূল্যবান উপকরণ। শিক্ষার সংজ্ঞায়ন নিয়ে যতই বহুবিস্তৃত তাত্ত্বিক পর্যালোচনা থাকুক না কেন শিক্ষাই একমাত্র উপায়, যা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ও সমবেতভাবে এগিয়ে চলার মানসিকতা ধারণ করতে সক্ষমতা গড়ে দেয়। প্রতিষ্ঠিত হয় জীবনের মহত্ত্ব এবং সম্প্রীতির মূল সারাংশ অথবা বন্ধুত্বের মায়া।
লেখক: কবি ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এএইচএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।