গাফফার চৌধুরীর মৃত্যু নেই
প্রকাশিত : ১৪:২৮, ২০ মে ২০২২
প্রতিটি মহান ব্যক্তির এমন একটি কর্ম থাকে যা তাদেরকে জীবনের অমরত্ব দান করে।আবদুল গাফফার চৌধুরী একজন কিংবদন্তি সাংবাদিক, কলামিস্ট, সু-সাহিত্যিক, গীতিকার ছিলেন। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে ভাষা সৈনিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন।‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি সমগ্র ফেব্রুয়ারি জুড়েই সব বাঙালির হৃদয় আলোড়ন তৈরি করে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় আবদুল গাফফার চৌধুরীর নামটিও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
৫২'র ভাষা আন্দোলনের শহীদ রফিকের লাশ ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় পড়ে ছিল।বন্দুকের গুলিতে মাথার খুলি উড়ে যায়। মেঝেতে রফিকের মরদেহ দেখে তৎকালীন ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরীর মনে হয়েছিল, যেন তাঁর নিজের ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে৷ তখনই মন গুনগুন করে গেয়ে ওঠে একটি কবিতা, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। সেই কবিতা পরবর্তীতে গানে রূপ নেয়৷ আলতাফ মাহমুদের সুরে এটি প্রভাত ফেরির গান রূপে গৃহীত হয়৷ যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে, ততদিনই কোটি মানুষের কন্ঠে প্রভাত ফেরিতে এই গানটি বেজে উঠবে।
গানটি এখন শুধু বাংলা ভাষাভাষি মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠছে। কারণ, একুশে ফেব্রুয়ারি এখন সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আর এই গানটি এখন পর্যন্ত হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানিসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়েছে।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর আরেকটি কালজয়ী সৃষ্টি হলো ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ সিনেমা। সিনেমাটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের চক্রান্ত অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পলাশী থেকে ধানমণ্ডি, মীরজাফর থেকে মোশতাক, জগৎশেঠ থেকে জিয়াদের কর্মকাণ্ড দেখানো হয়েছে। জিয়াউর রহমানকে যারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে নায়ক বানাতে চান, এই সিনেমায় তিনি তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ সিনেমাটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান যে সরাসরি জড়িত, সে বিষয়টি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সিনেমাটিতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিটি চরিত্রে উপযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচিত করে আবদুল গাফফার চৌধুরী পরিচালক হিসেবে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর স্কুল জীবনেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে দশম শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় ‘সওগাত’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয়। ১৯৫০ সালেই 'দৈনিক ইনসাফ' পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে পরিপূর্ণভাবে কর্মজীবন শুরু করেন। পাকিস্তান আমলে দৈনিক সংবাদ, মাসিক সওগাত, মাসিক নকীব, দিলরুবা, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ১৯৬৬ সালে ছয়-দফা আন্দোলনের মুখপত্র‘দৈনিক আওয়াজ’ ও পূর্বদেশসহ অসংখ্য পত্রিকায় কাজ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলম যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। মুজিবনগর সরকারের নিবন্ধিত প্রথম পত্রিকা 'সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। লেখালেখির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস যোগাতেন। মুক্তিযুদ্ধের খবর দেশ-বিদেশে পৌঁছে দিতেন। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর 'দৈনিক জনপদ' পত্রিকা বের করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর কর্মজীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৭৪ সালে প্রিয়তমা স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথম ভারতে পরবর্তীতে লন্ডনে নিয়ে যান। শুরু হয় প্রবাস জীবন। ১৯৭৬ সালে লন্ডনে তিনি 'বাংলার ডাক' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এরপর নতুন দিন, নতুন দেশ, পূর্বদেশ পত্রিকা বের করেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রবাসে থাকলেও বাংলাদেশকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লিখে গেছেন।
রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোতে নিয়মিত কলাম লিখেছেন। তাঁর কলাম পাঠকদের কাছে বাড়তি উদ্দীপনা সৃষ্টি করত। ইতিহাসের খুঁটিনাটি বিষয় অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরতেন। অনেক সময় তাঁর একটি লেখা সমাজ পরিবর্তন এমনকি রাষ্ট্রের অনেক সিন্ধান্তকেও প্রভাবিত করত।
আবদুল গাফফার চৌধুরী সাহিত্যিক হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে- চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, নাম না জানা ভোর, নীল যমুনা, শেষ রজনীর চাঁদ, কৃষ্ণপক্ষ, সম্রাটের ছবি, সুন্দর হে সুন্দর, ডানপিটে শওকত অন্যতম। এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশ কথা কয়, পলাশী থেকে ধানমন্ডি, আমরা বাংলাদেশি নাকি বাঙালী। স্বীকৃতি হিসেবে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, ইউনেস্কো পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে বাবা হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। আর গত ১৯ মে ৮৮ বছর বয়সে সকলকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁর মৃত্যু বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত অপূরণীয় ক্ষতি।
আবদুল গাফফার চৌধুরী জাতি পিতা বঙ্গবন্ধুর খুব স্নেহধন্য ছিলেন। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সাথেও সুসম্পর্ক বজায় ছিল। অনেক ক্ষেত্রে তিনি তাঁদের অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তায় সে বিষয়টি তুলেও ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে আমার বহু স্মৃতি। অনেক পরামর্শ পেয়েছি। একজন বিজ্ঞ ও পুরোধা ব্যক্তিত্বকে হারালাম যিনি তার লেখা ও গবেষণায় আমাদের বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।’
পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছেন যাদের কখনো মৃত্যু হয় না। তাঁরা তাদের কর্মের মাধ্যমে অনাদিকাল বেঁচে থাকেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী এমনই একজন। তাঁর মৃত্যু নেই, তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে চির অমর হয়ে থাকবেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘মোর লাগি করিও না শোক আমার রয়েছে কর্ম আমার রয়েছে বিশ্বলোক।’
বিনম্র শ্রদ্ধা।পরপারে ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় গাফফার ভাই।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এসবি/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।