ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রশান্তি ও দীর্ঘ জীবনের জন্য মেডিটেশন করুন

ডা. হাসনাইন নান্না

প্রকাশিত : ১৯:০৮, ২০ মে ২০২২ | আপডেট: ১৯:১১, ২০ মে ২০২২

২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। সারা বিশ্বে এ দিবসটি পালিত হয়। বাংলাদেশেও সাড়ম্বরে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ভালো মানুষ ভালো দেশ স্বর্গভূমি বাংলাদেশ’।

বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে প্রথম সারির একটি দেশে উন্নীত হতে হলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন সুস্থ দীর্ঘ ও প্রশান্তচিত্তের নৈতিক মানবিক ইতিবাচক ভালো মানুষ হওয়া। এরকম ভালো মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে তত এদেশ পরিণত হবে ভালো দেশে। আর এজন্যে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে মেডিটেশন। 

আজকে যে বেপরোয়া বিচ্ছু/ শান্ত সুবোধ হবে কাল সে,/ চোখের সঙ্গী হবে চশমা/ চল্লিশ পেরোলেই চালশে। শান্ত সুবোধ হতে কিছুমাত্র দোষ নেই, কিন্তু চল্লিশ পেরোতেই চালশে? এ-ই কি নিয়তি? আধুনিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এটা অবধারিত নয়। নিয়মিত মেডিটেশনের মাধ্যমে প্রশান্ত জীবনযাপন, ব্যায়াম, বিজ্ঞানসম্মত খাদ্যাভ্যাস এবং আশাবাদী ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বার্ধক্যগতিকে বিলম্বিত করে। অর্থাৎ আয়ু বাড়ায়। দীর্ঘদিন যাবৎ একজন মানুষ থাকতে পারেন মনোদৈহিকভাবে সজীব, উচ্ছল, কর্মময়।

বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, আপনার মুড, অনুভূতি, চিন্তাভাবনা সবকিছুই প্রভাবিত করে আপনার শরীর ও শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমকে। তাই স্বাস্থ্যগবেষকদের পরামর্শ হলো, দেহ-মনে শিথিল হতে শিখুন। তাতে আপনার রক্তচাপ থাকবে স্বাভাবিক, বিষণ্ণতা-হতাশার মতো নেতিবাচক অনুভূতিগুলো হ্রাস পাবে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা হয়ে উঠবে আরো সংহত ও কার্যকর।

তা-ই নয় শুধু, হাড়ের গঠন মজবুত ও হাড় সুরক্ষা, করোনারি হৃদরোগ নিরাময় এবং বয়সজনিত নিউরোন-ক্ষয় প্রতিরোধেও মনের আছে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। গবেষকরা তাই বলছেন, আপনি আসলে ততটাই বৃদ্ধ, যতটা আপনি নিজেকে মনে করেন। 

মেডিটেশন ও ইতিবাচকতা দেবে দীর্ঘজীবন
মেডিটেশনের উপকারিতা বিস্তৃত জীবনের সর্বক্ষেত্রজুড়েই, এ বিষয়টি আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী ও গবেষক মহলেই শুধু স্বীকৃত নয়, বরং সর্বসাধারণ্যে ব্যাপকভাবে গৃহীত ও নানাভাবে পরীক্ষিত একটি সত্য। তাই এ নিয়ে উত্তরোত্তর গবেষণার অন্ত নেই সারা পৃথিবীজুড়েই। ফলে প্রতিনিয়তই আমরা জানতে পারছি মেডিটেশনের আরো নতুন নতুন কার্যকারিতা ও উপযোগিতার আশাপ্রদ খবর।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির প্রফেসর এলেন ল্যাঙ্গার। গত প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি বার্ধক্যের সাথে মনের সংযোগ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, যখন আমরা আমাদের মনের যত্ন নিই তখন মূলত শরীরেরই যত্ন নিই। কারণ শরীর চলে মনকে অনুসরণ করেই। এ দুটো আলাদা কোনো সত্তা নয়। আর এটা যখন আপনি উপলব্ধি করবেন তখন মেডিটেশন, আশাবাদ, সহিষ্ণুতা ও সামাজিক যোগাযোগের মতো জীবন-অভ্যাসগুলো অনুসরণ করা আপনার জন্যে হবে অনেক সহজ, যা শেষপর্যন্ত আপনাকে নিয়ে যাবে দীর্ঘ জীবনের পথে।

এমনকি দেখা গেছে, কেবল একবেলার মেডিটেশন চর্চাও দেহে প্রদাহের জন্যে দায়ী জিনগুলোকে স্তিমিত করে রাখতে সক্ষম, বার্ধক্য রোধে যা গুরুত্বপূর্ণ। আর মেডিটেশনের প্রথম উপকার হলো স্ট্রেসমুক্তি, যা দেহে ফ্রি-র‌্যাডিকেল্সের (দেহকোষ-ধ্বংসী উপাদান) বিনাশ ঘটায়। 

‘তাই মেডিটেশন হওয়া চাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি নিয়মিত অভ্যাস। কারণ বিশ্বজুড়ে পরিচালিত একাধিক গবেষণার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি, একজন মানুষ কখন বার্ধক্যে উপনীত হবে তা শুধুই তার জিনগত বৈশিষ্ট্য নয়, বরং আমাদের জীবনযাপনও এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।’ বলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সানফ্রান্সিসকো-র সাইকিয়াট্রিস্ট প্রফেসর এলিসা এপেল।

মনই সকল পরিবর্তনের উৎস
মনোবিজ্ঞানী প্রফেসর এলেন ল্যাঙ্গার যখন সত্তরের দশকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে শিক্ষকতা শুরু করলেন, তখন তিনি বিভিন্ন হলোদ্দীপক গবেষণা পরিচালনা করেন। যার একটিতে তিনি আট জনের একটি দল তৈরি করলেন, যাদের সবাই ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব পুরুষ এবং তাদের স্বাস্থ্যও ছিল ভালো-মন্দ মিলিয়ে মোটামুটি ধরনের।

পাঁচ দিনব্যাপী গবেষণায় তাদেরকে শোনানো হয় সেসব সঙ্গীত ও রেডিও অনুষ্ঠান, যা তারা তাদের যৌবনে শুনতেন। এ-ছাড়াও তখন তারা সমসাময়িক কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে বরং তারুণ্যে যেসব বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন তেমন প্রসঙ্গ তুলে কথাবার্তা বলতেন। এবং এ বয়সের লোকজন যেভাবে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন, যেমন : কষ্ট হবে ভেবে হাত থেকে ব্যাগ তুলে নেয়া, কম্বল গায়ে চড়িয়ে দেয়া ইত্যাদি তাদের সাথে করা হয় নি। সবকিছু করেছেন তারা নিজেরাই।

পাঁচ দিন পর কিছু অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করা গেল। তাদের প্রত্যেকের শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা বেড়েছে নাটকীয়ভাবে। বয়সজনিত অনেক ধরনের অক্ষমতার বৃত্ত থেকেও তারা বেরিয়ে আসতে পেরেছেন কারো সাহায্য ছাড়াই।

প্রফেসর ল্যাঙ্গার আরেকটি গবেষণা পরিচালনা করেন একদল হোটেল পরিচারিকাদের নিয়ে, যারা নিজেদের ওজন কমাতে চাইছিলেন। তাদেরকে দুটো দলে ভাগ করে একদলকে বলা হয় যে, তারা প্রতিদিন হোটেলে তাদের কাজকর্মের মধ্য দিয়ে যে পরিশ্রমটুকু করছেন তাতে পর্যাপ্ত  ক্যালরি-ক্ষয় হচ্ছে এবং ওটাই তাদের ওজন কমানোর জন্যে যথেষ্ট। অন্যদলকে এমন কিছুই বলা হয় নি।

এ গবেষণা শেষেও দেখা গেল চমকপ্রদ ঘটনা। হোটেল পরিচারিকাদের মধ্যে যারা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্য দিয়ে নিজেদের ওজন কমছে, তাদের ওজন সত্যিই কমেছে। অন্যদিকে একই ধরনের কাজ ও শারীরিক পরিশ্রম করেও অন্যদের কারোরই কোনো পরিবর্তন ঘটে নি।

গবেষণালব্ধ এসব ফলাফলের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, মন ও শরীর যখন একসাথে এক বিন্দুতে এসে মিলে যায়, এমন ঘটনা কেবল তখনই সম্ভব। তারা বলছেন, এভাবেই সম্ভব হতে পারে দেহকোষের অভ্যন্তরে টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য নিয়ন্ত্রণ করা, যা বার্র্ধক্যগতি শ্লথ করতে অনেকাংশে সক্ষম।

টেলোমেয়ার\দীর্ঘায়ুর প্রাণভোমরা
দেহকোষের অভ্যন্তরে আছে ক্রোমোজোম, যার দুপ্রান্তে থাকে ‘টেলোমেয়ার’ নামক একটি উপাদান। জন্মের পর থেকে প্রতিনিয়ত কোষ বিভাজনের সময় টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্য ক্রমান্বয়ে ছোট হতে থাকে। জ্বলন্ত মোমবাতির সলতের মতো এর দৈর্ঘ্য যত কমতে থাকে, বার্ধক্য তত ত্বরান্বিত হয়।

টেলোমেয়ার নিয়ে প্রথম গবেষণা শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। এর সূত্রপাত করেন বিজ্ঞানী এলিজাবেথ ব্ল্যাকবার্ন, সাথে ছিলেন হার্ভার্ডের বিজ্ঞানী জ্যাক জোস্টাক। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে ব্ল্যাকবার্ন ও তার ছাত্র বিজ্ঞানী ক্যারল গ্রাইডার দেহকোষে ‘টেলোমেরেজ’ এনজাইমের অস্তিত্ব খুঁজে পান, যা টেলোমেয়ারের ক্ষয়পূরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ এ উদ্ভাবনের জন্যে এই তিন জন বিজ্ঞানীই ২০০৯-এ যৌথভাবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

তারা বলেন, টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্যহ্রাস ঘটার সাথে সাথে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও নিউরোন-ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ে এবং দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হতে থাকে। তাহলে কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়? বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্ট্রেসমুক্তি এ-ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

চাই স্ট্রেসমুক্ত প্রশান্ত জীবন ও সুস্থ জীবনাচার
২০১৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সানফ্রান্সিসকো-তে ২৩৯ জন নারীর ওপর পরিচালিত বছরব্যাপী একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা মেডিটেশনের মাধ্যমে স্ট্রেসমুক্ত জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম, বিজ্ঞানসম্মত খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম ইত্যাদি সুস্থ জীবনাচার অনুসরণ করেছেন তাদের টেলোমেয়ারের দৈর্ঘ্যহ্রাস ততটা ঘটে নি, যতটা ঘটেছে স্ট্রেস-আক্রান্ত ও পরিশ্রমহীন জীবনযাপনকারীদের ক্ষেত্রে।

এ ফলাফলের প্রেক্ষিতে প্রফেসর এলিসা এপেল ও তার সঙ্গীরা জানিয়েছেন, স্ট্রেস ও ভুল জীবনধারার কারণে জন্মের পর তো বটেই, জন্মের আগে মাতৃগর্ভেই শিশুর টেলোমেয়ার-দৈর্ঘ্য দ্রুত হ্রাস পেতে পারে, মা যদি স্ট্রেস-আক্রান্ত হন। তারা বলেন, জীবনে নানা কারণে ঘুরেফিরে স্ট্রেস আসতেই পারে; কিন্তু কথা হচ্ছে, আপনি কি হাল ছেড়ে দিয়ে পরাজয় বরণ করে বসবেন, নাকি মেডিটেশন এবং সুস্থ জীবনাচারের মধ্য দিয়ে একে সচেতনভাবে মোকাবেলা করবেন?

২০১৩ সালে মেডিসনের ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-এ পরিচালিত একটি গবেষণার ভিত্তিতে নিউরোসায়েন্টিস্ট রিচার্ড ডেভিডসন বলেন, স্ট্রেসমুক্তির জন্যে অন্যান্য যে-কোনো পদ্ধতির চেয়ে মেডিটেশন নিশ্চিতভাবেই অধিকতর কার্যকরী।

মেডিটেশন-চর্চাকারীদের মস্তিষ্কের এমআরআই করে তিনি রায় দিয়েছেন, যারা নিয়মিত মেডিটেশন করেন তাদের মস্তিষ্কের গ্রে-ম্যাটারের বয়সজনিত ক্ষয় অন্যান্যদের চেয়ে তুলনামূলক কম। এমনকি হার্টের বাইপাস অপারেশনের পরও যারা ক্রমাগত চেষ্টায় মেডিটেশন ও সুস্থ জীবনাচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেন, পরবর্তী জীবনে যে-কোনো হৃৎ-জটিলতায় আক্রান্ত হওয়া কিংবা পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আশঙ্কা তাদের কমে যায় অনেকখানি।

জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে করোনারি হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ ব্যবস্থার পথিকৃৎ ডা. ডীন অরনিশ এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান চিকিৎসাবিদ ও মনোবিজ্ঞানীরা সকলেই একবাক্যে রায় দিচ্ছেন যে, এ এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন। 

আর এ ধারাবাহিকতায় বিশ্বের প্রথমসারির স্বাস্থ্য-গবেষক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, চিকিৎসক হিসেবে আমাদের উচিত রোগীদের সামনে এ বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা, যাতে শরীর ও মনের পারস্পরিক সম্পর্কটি তাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং বিষয়টি তারা ভালোভাবে বুঝতে ও উপলব্ধি করতে পারেন। সেইসাথে রোগীদের প্রতি আমাদের আশ্বাসবাণীটা হচ্ছে, সময়ের সাথে সাথে আপনার বয়স বাড়বে, একথা সত্য; কিন্তু সচেতন প্রচেষ্টায় সুস্থ জীবনচর্চার মাধ্যমে আপনি যাপন করতে পারেন এক কর্মানন্দময় সুখী জীবন।

লেখক: হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিরাজগঞ্জ।

এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি