ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪

খোকা না হলে বাংলাদেশ হতো না’ বই প্রসঙ্গ

শেখ রফিক

প্রকাশিত : ১৫:৪৮, ২৫ আগস্ট ২০২৩

প্রতিদিন বিকেল হলেই খোকাদের পুরোনো বাড়ির সামনে আঠারো-বিশজন তরুণ ভিড় করে। তারা বৃদ্ধ রহমান মাস্টারের কাছে গল্প শোনে- কি করে খোকা শেখ মুজিব হলো, ছাত্রলীগ হলো, আওয়ামী লীগ হলো, ভাষা আন্দোলন হলো, যুক্তফ্রন্ট হলো, ন্যাপ হলো, শিক্ষা আন্দোলন হলো, ৬ দফা হলো, ছাত্র-গণআন্দোলন হলো, বঙ্গবন্ধু হলো, সত্তরের নির্বাচন হলো, ৭ই মার্চ হলো, মুক্তিযুদ্ধ হলো ও বাংলাদেশ হলো ইত্যাদি।

রহমান মাস্টার হলো খোকার বন্ধু। শৈশব থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত রহমান তার বন্ধুর পাশে ছিলেন। একত্রে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, রাজনীতি করেছেন। তবে পাকিস্তান আমলে রহমান পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে চাকরির পাশাপাশি পরোক্ষভাবে খোকার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন। গোয়েন্দা বিভাগের চাকরির কথা খোকা জানতো না। খোকা জানতো তার বন্ধু রহমান পুলিশে চাকরি করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একথা জানতে পেরে খোকা বলল, রহমান তাহলে তুই বারবার আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিস? রহমান বলে, হ্যা। তবে তোর মঙ্গলের কথা ভেবেই আমি গোয়েন্দা চাকরি কথা তোকে বলিনি।

খোকা মানে টুঙ্গিপাড়ার খোকা। খোকা মানে শেখ মুজিব। শেখ মুজিব মানে বঙ্গবন্ধু। আর বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। এই সবকিছুর একটা ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস- গল্প, ঘটনা ও বর্ণনায় তুলে ধরেছেন খোকার বন্ধু রহমান মাস্টার। যা এই বইয়ের মূল্য প্রতিপাদ্য।

বইটি সম্পর্কে বিশিষ্ট শিশু-সাহিত্যিক আখতার হুসেন মন্তব্য করেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুর পরেও অমর। তাঁর এই অমরতার মূলে রয়েছে তাঁর শৈশব থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিংবদন্তিতুল্য সংগ্রামী জীবন। ‘খোকা না হলে বাংলাদেশ হতো না’ বইয়ের লেখক শেখ রফিক একজন নিষ্ঠাবান গবেষকের মতো তাঁর সেই সংগ্রামমুখর জীবনকে তুলে ধরেছেন গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে। এ বই শুধু হয়ে ওঠেনি তাঁর জীবনভিত্তিক একটি উপন্যাস। সেই সঙ্গে হয়ে ওঠেছে তাঁর লড়াকু জীবনের আদ্যোপান্ত ইতিহাসের নিখাদ দলিলও।’

বই প্রসঙ্গে লেখক শেখ রফিক ভূমিকায় লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলার প্রতিটি সচেতন ‘মানুষের’ লিডার। যিনি এই দেশটিকে জন্ম দিয়েছেন, তাকে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া প্রতিটি সচেতন মানুষের একান্ত দায়িত্ব। এ দায়িত্ব হাজারো মানুষ (লেখক, গবেষক, সম্পাদক) পালন করছেন বলেই তো তাকে নিয়ে এত বই প্রকাশিত হয়েছে। তাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ ও ভালোবাসা। কিন্তু তার পরও আগামী দিনের লিডার, অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যতটুকু শূন্যতা অনুভব করছি, তা পূরণের জন্যই খোকা না হলে বাংলাদেশ হতো না বইটি লেখার চেষ্টা করেছি। 

বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত তার বন্ধু রহমান মাস্টারের বয়ানে বইটি লেখা হয়েছে। শৈশবের গল্প, কলেজ-জীবনের রাজনৈতিক ঘটনা ও বাংলাদেশ নির্মাণের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন তিনি। 

ছোট্টবেলায় আমরা নানি-দাদির কাছে গল্প শুনতাম, মজার মজার ঘটনা শুনতাম এবং ইতিহাসের দারুণ দারুণ বর্ণনাও শুনতাম- যা এখনো হুবহু মনে আছে। নানি-দাদির মতো করেই রহমান মাস্টার তার ‘বন্ধু’ খোকার জীবন-ইতিহাস বর্ণনা করেছেন, যা এ দেশের স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীদের চেতনায় বঙ্গবন্ধুকে নির্মাণ করবে।’

বইটি সম্পর্কে অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম মন্তব্য করেন, বঙ্গবন্ধুর ওপরে প্রকাশিত হাজার বইয়ের মধ্য থেকে শেখ রফিকের বইটি সহজেই আলাদা করে নেয়া যাবে। তার লেখা ‘খোকা না হলে বাংলাদেশ হতো না’ এক অসাধারণ বই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এরকম কাজ বাংলাদেশে আর হয়নি।’ 
বইটি চার অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে খোকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল জীবনের নানা গল্প, সমাজসেবামূলক কাজ ও রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার গল্প রয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে খোকার কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ জীবন ও রাজনীতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশুনা ও গোটা পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক জীবনে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে খোকার স্বাধীন বাংলাদেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে সংক্ষিপ্ত উল্লেখ রয়েছে।
বইটি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার মন্তব্য করেন, শেখ রফিকের লিখিত ‘খোকা না হলে বাংলাদেশ হতো না’ শীর্ষক গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য অন্যরকম। তরুণপ্রজন্মের জন্য এ গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান প্রকাশনা হবে বলে আমার বিশ্বাস।

বইটির উৎসর্গ পাতায় লেখা রয়েছে- ভাষাশহিদ, ভাষাসংগ্রামী, খাপড়াওয়ার্ডেরশহিদ, খাপড়া ওয়ার্ডের বিপ্লবী, শিক্ষা আন্দোলনের শহিদ, ৬ দফা আন্দোলনের শহিদ, উনসত্তরের শহিদ, একাত্তরের উত্তাল মার্চের শহিদ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের শহি এবং ১৫ই আগস্টের সব শহিদ স্মরণে...।
বইটি প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের মূল্যায়ন, শেখ রফিক আমাদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ওপরে লেখা হাজার বই থেকে শ্রেষ্ঠগুলো তিনি পড়েছেন, গবেষণা করেছেন, আর রচনা করেছেন এদেশের তরুণদের জন্য একটি অনন্য অসাধারণ অনবদ্য বই ‘খোকা না হলে বাংলাদেশ হতো না’।এ বইটিবাংলাদেশের জন্ম ও বঙ্গবন্ধুকে জানার জন্য একটা মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

বইয়ের প্রথম ফ্লাপ লিখেছেন দুলাল হালদার। তিনি লিখেছেন- শেখ রফিকের লিখিত ‘খোকা না হলে বাংলাদেশ হতো না’ বইয়ের পান্ডুলিপি পড়েছি। পড়ার পরে ওকে ফোন দিয়ে বললাম, এই দারুণ আইডিয়া তোমার মাথায় আসলো কিভাবে? 

রফিক বলল, ‘দাদা, সোফির জগৎ ও যে গল্পের শেষ নেই’ বইসহ বেশ কিছু বই পড়েছিলাম। তাছাড়া ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ওপরে শত শত বই সংগ্রহ করে তা পড়ে একটা বই করার অবিরত চেষ্টার ধারাবাহিকতায় এই বইয়ের আইডিয়া তৈরি হয়েছে। তারপর লিখে ফেললাম।’
আমি শুধু ওকে বললাম, চমৎকার একটা কাজ হয়েছে। আ্সলেই অসাধারণ। এজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। সত্যিই অতুলনীয় একটা বই।

বইটি প্রসঙ্গে নাট্যকার শংকর সাওজাল মন্তব্য- আমাদের সংগ্রামে ও বিদ্রোহে, বাঙালি জাতিসত্তার আন্দোলনে, আমাদের দুঃখ-দুর্দিন ও বিপর্যয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই মহাকাব্যের পঙক্তিমালাঅনন্ত প্রেরণা জোগাবে। এক অসাধারণ অনবদ্য উপস্থাপনায় ‘খোকা না হলে বাংলাদেশ হতো না’ নামে যে বইটি শেখ রফিক লিখেছেন, তা বঙ্গবন্ধুকে জানার জন্য তরুণদের কাছে একটা অভিধান হিসেবে গণ্য হবে।

বইটি প্রসঙ্গে কথা-সাহিত্যিক দীপু মাহমুদ বলেন, শেখ রফিক অসম্ভব এক অসাধারণ কাজ করেছেন। সেই কাজ হলো তাঁর লেখা বই “খোকা না হলে বাংলাদেশ হতো না”। এখানে সমুদ্র মন্থন করে অমৃত উদ্ধার করা হয়েছে। বই শুরু হয়েছে দুর্দান্ত চমক দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা গল্পের মতো করে বর্ণনা করা হয়েছে। যে বর্ণনা অত্যধিক সহজ-সরল। কাহিনির বর্ণনা টেনে নিয়ে যায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আর আছে কাহিনির শিরোনাম। বঙ্গবন্ধুকে পরিপূর্ণভাবে জানতে “খোকা না হলে বাংলাদেশ হতো না” একটি প্রতিনিধিত্বশীল বই।
আসলেই বইটি অসাধারণ। বইয়ের কিছু সামান্য অংশ তুলে ধরা হলো- সবকিছু শুনে খোকা জিগ্যেস করল, ‘তাহলে অন্যায়-জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিততে হলে সবার আগে কী দরকার।’

শহীদ সাহেব বলেন, ‘একটি একতাবদ্ধ সংগঠন এবং একজন ত্যাগী ও সাহসী নেতা। এছাড়া দরকার তোমার মতো কিছু সাহসী যুবক, ত্যাগী কর্মী।’

খোকা বলল,‘এ দেশের মানুষ কি কোনো সংগঠন গড়ে তোলেনি?’

শহীদ সাহেব বললেন, ‘শিক্ষিত হিন্দুরা অনেক আগে থেকেই সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মুসলমানরা এতে যোগ দেয় নাই। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়। এতে হিন্দু-মুসলমান নেতারা যোগ দেন, তবে মুসলমান নেতা সংখ্যায় খুব কম ছিল। কংগ্রেসের কিছু নেতা মুসলমানদের খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না। মুসলমানরাও ধীরে ধীরে কংগ্রেসের ওপর বিশ্বাস হারাতে থাকে। এর ফলে ১৯০৬ সালে ঢাকায় বসে মুসলমান নেতারা একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের নাম হলো মুসলিম লীগ।...

... একবার শহীদ সাহেব কয়েকজন এমএলএকে পাহারা দেওয়ার জন্য খোকাকে দায়িত্ব দিলো, যাতে তারা দল ত্যাগ করে অন্য দলে যেতে না পারে, সেজন্য। খোকা ও আমরা কজন মুসলিম লীগ অফিসে একজন এমএলএকে আটক করলাম। তিনি বারবার চেষ্টা করছেন বাইরে যেতে, কিন্তু খোকার জন্য পারছেন না। কিছু সময় পরে তিনি বললেন, ‘আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি, তাহলে আপনাদের ক্ষতি কী? ভোট আমি মুসলিম লীগেই দেব।’ খোকা প্রচ- রাগ করে অগ্নিমূর্তি হয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল, আমরা আশ্চর্য!বৃদ্ধ লোক, কী সুন্দর নুরানি চেহারা, শিক্ষিত- কেমন করে এই কথা বললেন! টাকা নেবেন এক দলের আর ভোট দেবেন আরেক দলকে! কতটা অধঃপতন হলে রাজনীতিবিদের এই অবস্থা হয়!...

... খোকা সব কথা শুনল। পাইপ টানল। আর আমাদেরকে বলল, ‘তোমরা আমাকে খুব ভালোবাসো। বাঙালিরা সবাই আমাকে ভালোবাসে, হয়ত কমবেশি আছে। তারাই আমাকে নেতা, তাদের নেতা বানিয়েছে। আন্দোলন করে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনেছে। বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছে। জাতির পিতা বানিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি বানিয়েছে। আর যা-ই হোক, তারা আমাকে মারবে না, হত্যা করবে না। তোমরা আমাকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা না করে যার যার কাজে মনোযোগ দেও।

শোকাবহ আগস্ট মাসকে কেন্দ্র করে বইটি প্রকাশ করেছে- বিপ্লবীদের কথা প্রকাশনা। ৩০৪ পৃষ্ঠার এই বইয়ের দাম রাখা হয়েছে মাত্র ৫০০ টাকা।

এসবি/ 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি