ঢাকা মহানগর ও নারীর নিরাপত্তা
প্রকাশিত : ১৭:২৭, ১ অক্টোবর ২০২৩
নারী-একজন মা, মেয়ে, বোন কিংবা বধূ সর্বোপরি একজন মানুষ। একজন নারীর জীবনচলার পথ কতটা নিরাপদ? প্রশ্ন যখন সবার মনে উত্তরটাও জানা কিন্তু উত্তরণের উপায় নেই। শুধুই কি প্রতিবন্ধকতার পাহাড় রুদ্ধ করে রেখছে সেই পথ নাকি আমাদের মানসিকতাও এর পেছনে সমানভাবে দায়ী। প্রশ্ন থেকেই যায়।
নারী সময় ও পরিস্থিতির সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। নারীর চলার পথ কখনই মসৃন ছিলো না আজো নেই। অগ্রগন্য কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরতে চাই।
ঢাকা মহানগরের গণপরিবহন ব্যবস্থা ভালো নয়, চলাচলে অস্বস্তিকর অপমানজনক আচরণে প্রতিনিয়ত বির্পযস্ত হয় নারী। নারীদের জন্য পৃথক বাস অপ্রতুল। যাত্রীবোঝাই বাসে ধাক্কাধাক্কি করে উঠতে না পারায় কর্মক্ষেত্রে দেরীতে পৌঁছাতে হয়। যদিও বা উঠতে পারেন কোন নারী নেই বসার স্থান। নির্ধারিত আসনগুলো আগেই দখল হয়ে যায়। এতটুকু চক্ষুলজ্জা নেই কারো। সে বিষয়ে বলতে গেলে উল্টো কথা শুনিয়ে দেয় তথাকথিত পুরুষরা। সংরক্ষিত ও সাধারণ আসনের পার্থক্যটাই না বুঝে অযথা তর্ক করে চলেন। কিছু দুঃশ্চরিত্র সুযোগে থাকেন যৌন হয়রানির। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছেও অনেক নারী নীরবে সয়ে যান গণপরিবহনের হয়রানি।
শুধু কি গণপরিবহন, বিকৃত মস্তিষ্কের লোকজন রাস্তায় নারীদের দেখলেই অশ্লীল মন্তব্য কিংবা ইচ্ছে করে স্পর্শকাতর অংশ ছুঁয়ে দেয়ার পায়তারা প্রতিদিনকার চিত্র।
ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে। ভীড় ঠেলে একরকম ধাক্কাধাক্কি করে পথ চলতে হয়।
মহানগরের শৌচাগারগুলোর সবগুলো নারীর জন্য নিরাপদ নয়। প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করতে ভয় পান নারীরা নিরাপত্তার ভয়ে। অপরিচ্ছন্ন, অন্ধকার, পানির স্বল্পতা ছাড়াও দরজা জানালা ভাঙ্গা ও ছিটকিনিবিহীন শৌচাগার একজন নারীর জন্য ভীতি এবং বিড়ম্বনার। এই সমস্যা নারী স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরুপ।
শহরের উদ্যান কিংবা পার্কেও নেই নারীর চলাফেরার স্বাধীনতা। বেশিরভাগ পার্কগুলো মাদকাসক্তদের আঁখড়া। বিনোদনের জন্য সব সিনেমা হলে যাওয়ার পরিবেশও মানসম্মত নয়। কিশোরীদের জন্য নেই খেলার মাঠ।
শ্রমজীবী থেকে কর্পোরেট- কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য স্পষ্ট। সঠিক মূল্যায়ন হয় না নারীর কাজের। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হয়েও অনেক নারী মুখ খুলতে ভয় পান সামাজিক মর্যাদা ও চাকরী হারানোর ভয়ে।
কর্মজীবী মায়ের সন্তানের জন্য ডে কেয়ার সেন্টারের সুবিধা নেই বললেই চলে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মক্ষেত্রে স্যানেটারি প্যাড রাখার ব্যবস্থা না থাকায় অসহায় অবস্থায় পরতে হয় নারীদের।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নারীর জন্য নিরাপদ হয়। শিক্ষক কিংবা সহপাঠীদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে হরহামেশা।
চাকরি কিংবা লেখাপড়ার জন্য ঢাকায় থাকেন এমন অনেক নারীর জন্য আবাসন সংকট বড় অন্তরায়। কর্মজীবী হোস্টেল কিংবা ছাত্রী নিবাসের স্বল্পতায় বাসা ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধায় পরতে হয়। মেসে ও সাবলেট হয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হন অনেকেই।
গৃহকর্মী নেই রাজধানীতে এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু সেই বাড়িগুলোতে কাজ করেন যেসব নারীরা তাদের নিরাপত্তা কতটুকু? মারপিট থেকে শুরু করে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে।
উৎসবের দিনগুলোতে নিরাপত্তাহীনতায় অংশ নিতে ভয় পান নারীরা। উচ্ছৃঙ্খল বখাটেদের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে ধর্ষণ-গণধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের ঘটনা। রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্নভাবে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে সংহিসতার ধরণ হিসেবেঃ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা কিংবা আত্মহত্যা, কমিউনিটি ভায়োলেন্সে নির্যাতিত, এর বাইরে ফতোয়া, এসিড নিক্ষেপ, পাচার, অপহরণ, নিখোঁজ, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুক, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনাতো আছেই। অথচ এসব ঘটনায় সাজাভোগীর সংখ্যা অত্যন্ত নগন্য। যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের সমাজ ও বিচারব্যবস্থার দুর্বলতাকে।
অসংখ্য সমস্যা নারীর চলার পথে, যা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে নারীকে। এর বাইরে এমন অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে যায় যা খবরের কাগজে উঠে আসে না। এর কি সমাধান নেই?
নারীকে অবদমিত করে রাখলে চলবে না, পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় নারীর ভূমিকা পুরুষের অর্ধেক। নারীর নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে গড়ে তুলতে হবে নারীবান্ধব নিরাপদ ঢাকা, নিরাপদ বাংলাদেশ।
সমস্যার কথা বলেছি উত্তরণে কি কি করা যেতে পারে সে বিষয়েও বলতে চাই-
গণপরিবনে নারী আসন সংখ্যা বাড়াতে হবে। নারীদের জন্য পৃথক বাসের সংখ্যাও বাড়াতে হবে।
কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল, ছাত্রীনিবাস এবং কর্মজীবী মায়ের সন্তানের জন্য কর্মক্ষেত্রে শিশুর দেখভালের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কাজের জায়গায় স্যানেটারি ন্যাপকিন ও ওষুধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
শহরের গুরুত্বপূর্ন মোড়গুলোতে পর্যাপ্ত শৌচাগার স্থাপন করা এবং নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা।
শুধু গৃহের কাজে নয় প্রতিটি স্তরেই নারী নির্যাতনের চিত্র পাল্টে দিতে সচেতনতামূলক সভা ও প্রচারণামূলক কাজের উদ্যোগ নিতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে মজুরী-পদোন্নতিতে বৈষম্যের মনোভাব পাল্টাতে হবে।
যেকোন বিপদে নারী যাতে তাৎক্ষণিক সহায়তা পায় সেজন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে সহায়ক সেন্টার গড়ে তোলা যেতে পারে।
আইনী সহায়তায় নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে হতে আরো বেশি কার্যকরী বাস্তবমুখী।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সবাইকে নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করতে হবে। পাঠ্যসূচিতে নারী অধিকার ও সচেতনতা বিষয়ক বিষয়বস্তু অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
নারীদের বিনোদনের জন্য সিনেমা হলে উপযুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্যানগুলো থেকে বখাটে ও মাদকসেবীদের উচ্ছেদ করতে হবে। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন নিয়োগ করতে হবে।
নারীর অগ্রযাত্রায় নারীকেও হতে হবে সহযোগী।
নারীর সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় দায়বদ্ধ নগর পিতা হিসেবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মেয়র। নারীবান্ধব মহানগর গড়ে তুলতে লক্ষ্য স্থির করে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তাদের দৃঢ়প্রত্যয়ী হতে হবে।
বর্তমান সরকারের সময়ে নারী অগ্রযাত্রা উর্ধ্বমুখী। দেশের সরকারপ্রধান, জাতীয় সংসদের স্পিকার একজন নারী। শুধু তাই নয় দায়িত্বশীল প্রতিটি ক্ষেত্রেই আছে নারীর সরব অংশিদারিত্ব, অসামান্য ভূমিকা রেখে চলেছে নারী। তারপরেও নারীর চলার পথ কাঁটা বিছানো। সকল প্রতিবন্ধতা দূর হোউক। এই শহর হোউক নারীর। ভয়ভীতি, দ্বিধা, সংকোচ উপেক্ষা করে নারী এগিয়ে যাবে আপন স্বাধীনতায়। এটা কোন স্বপ্ন নয়, হতে পারে বাস্তব। শুধু প্রয়োজন আপনার, আমার সকলের সম্মিলিত আন্তরিক চাওয়া ও প্রচেষ্টা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।
এসবি/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।