সমাজে নারীর অর্জনকে অনন্য উচ্চতায় এনে দিয়েছে জয়িতা পুরস্কার
প্রকাশিত : ১৮:২১, ২ জানুয়ারি ২০২৪
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। কবি কাজী নজরুলের এই বহুল উচ্চারিত কবিতার চরণেই উঠে এসেছে সমাজে নারীর গুরুত্ব। নারীর উন্নয়নে বর্তমান সরকার নিয়েছে নানামুখী উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০ বিশেষ উদ্যোগে স্থান পেয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন। গত কয়েক দশকের বাংলাদেশে নারীর অর্জনকে এক অনন্য উচ্চতায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জয়িতা পুরস্কার। ২০২৩ সালে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নারীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের অবদানকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন উন্নয়নমুখী কাজে এসব নারী পেয়েছেন গৌরবগাথা স্বীকৃতি। বাংলাদেশে নারীর গৌরবগাথা বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করে পালন করা হয় রোকেয়া দিবস। সেই রোকেয়া দিবসে ২০২৩ সালে জয়িতা পুরস্কার পেলেন পটুয়াখালী জেলার পাংগাশিয়া ইউনিয়নের মমতাজ উদ্দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসিমা বেগম। এ শিক্ষকের মতো সারা দেশেই স্বীকৃতি পেয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক কাজে অবদান রাখা নারীরা।
২০২৩ সালেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানমন্ডিতে ১২ তলা জয়িতা ফাউন্ডেশনের উদ্্বোধন করেছেন। ২০২১ সালে এ ফাউন্ডেশনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত জয়িতা ফাউন্ডেশন আজ সমাজের নারীর ক্ষমতায়নে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এতদিন সমাজে নারীদের অর্জনগুলো অনেক পিছিয়ে ছিল। পিছিয়ে থাকা নারীদের এগিয়ে আসতে জয়িতা ফাউন্ডেশন যেন আবারও সবাইকে নতুন করে পথ দেখাল।
পটুয়াখালীর শিক্ষক নাসিমা বেগমের অর্জন সমাজ অগ্রগতির গুরত্বপূর্ণ চিত্রের ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়ন প্রকাশিত হয় তাঁর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, অবনমিত মাতৃমৃত্যু ও বাল্যবিবাহের হার দিয়ে। আবার সমাজ অগ্রগতির গুরত্বপূর্ণ সূচক শিক্ষার হার। বাংলাদেশে সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন এখন উল্লেখ করার মতো। বিগত দশকগুলোয় নারী জীবনমান উন্নয়নে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ২০০০ সালের পর থেকে শিশু মৃত্যুহার দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পাশাপাশি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনায় ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে।
জেন্ডার সমতায় সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বিশ্বের মধ্যে নবম। অন্যদিকে বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে বিগত ৫০ বছরে নারী সরকারপ্রধান সবচেয়ে বেশি ক্ষমতায় ছিলেন। জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত্ব নির্বাচনে নারীর জন্য আলাদা আসন বরাদ্দ রয়েছে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে সমান গতিতে। দেশের তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকার নানামুখী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে চলেছে। এসব কিছুরই দৃষ্টান্ত জয়িতা পুরস্কারের মধ্যে দেখা যায়।
জয়িতা পুরস্কার যেন বাস্তবে নারীর মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার শ্রমে গড়া অনন্য স্বীকৃতি। যে স্বীকৃতিতে বদলে গেছে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। তৃণমূলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের সর্বস্তরে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। সেসময় নারীর সমান অধিকারের বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ ২০৪১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে। বাস্তবায়িত হবে ডেল্টা প্ল্যান ২১০০। ডব্লিউএফ-এর হিসাবে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৪৮তম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী উন্নয়নে সার্বিক সূচকে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাভুক্ত ২৪টি দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পরই দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থান আজকের বাংলাদেশের। আজকের বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে নতুন আইন ও নীতি এবং বিধিমালা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে মানবাধিকার কমিশন, প্রেস কাউন্সিলের মতো গুরত্বপূর্ণ স্থানে নারী দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশের নারীর সাফল্য আজ বিজ্ঞান ও গবেষণাক্ষেত্রেও। রয়েছে নারীর ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য। নারী উন্নয়ন সূচকে কর্মক্ষেত্রে শুধু পোশাক খাতেই রয়েছে শতকরা ৮০ ভাগ নারী। এছাড়া প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক নারী আজ বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। অন্যদিকে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যাপক কর্মসূচি গৃহীত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। শান্তিরক্ষা মিশনসহ সব ক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে এখন রোল মডেল।
জয়িতা পুরস্কার আজ সমাজ উন্নয়নে ৫টি ক্যাটাগরিতে দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনকারী নারী, শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী, সফল জননী নারী, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যেসব নারী এবং সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখছেন যেসব নারী। জয়িতা পুরস্কার নারীর সাফল্যের স্বীকৃতি। এ পুরস্কারে উদ্বুদ্ধ হয়ে নারী সমাজের সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করে সফলতা লাভ করলে তা দেশ ও সমাজ উন্নয়নে আরও ভুমিকা রাখবে এটাই প্রত্যাশা সবার।
লেখক: মোস্তাকিম স্বাধীন, নির্বাহী প্রযোজক, একুশে টেলিভিশন।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।