ঘূর্ণিপাকে ডাচ বাংলা ব্যাংকের সেবা
প্রকাশিত : ১৯:২৯, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | আপডেট: ১০:১০, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
মিলটন রহমান
আমাদের দেশের কিছু কিছু ব্যাংকের সেবা নিয়ে অভিযোগ অনুযোগের অন্ত নেই। তুলনামূলকভাবে প্রশংসার পাল্লা একেবারে হালকা। এর কারণগুলোর বিষদ বর্ণনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কেননা এসব কারণ সর্বজনবিদিত। এসব নিয়ে মাঝে মধ্যে যেসব কথা হয় তাও একেবারে উচ্চকন্ঠে হয় না। হলেও কর্তৃপক্ষের কর্ণক’হরে তা প্রবেশ করে কিনা সে প্রশ্ন করতেই পারি। কারণ কোন অনিয়মেরই বিহিত ব্যবস্থা তেমন হয় না। আমি নিজেও বহু বছরের পুঞ্জিবুত যাতনার কথাই বলবো এখন। একসময় কিন্তু আপনাদের ব্যাংকিং সেবা বেশ প্রশংসিত ছিল। তখন ব্যাংক কম থাকলেও সেবা পৌঁছে যেতো গ্রাহকের দোরগোড়ায়। এখনও অনেক ব্যাংকের সেবা খুবই ভালো।
ডাচ বাংলা ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় আমি একটি একাউন্ট করি প্রায় ২০ বছর আগে। শুরুর দিকে সেবা ততটা খারাপ ছিলো না। গত কয়েক বছর ধরে বিপুল অভিযোগের ভান্ডার তৈরি করেছে এ ব্যাংকটি। হয়তো আমার যে অভিযোগ তা অন্যসব অভিযোগের কাছে কিছুই না। তারপরও নিজের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত বেদনা কথায় প্রকাশ করলে বুঝতে সহজ হবে। ২০১৮ সালের দিকে আমি একটি ভিসা কার্ডের জন্য আবেদন করি ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখা, মতিঝিলে। কার্ডটি যখন তুলতে যাই, বলা হলো আমার কার্ড রয়েছে বনানী শাখায়। কেনো সে শাখায় গেলো তার কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছ থেকে পাওয়া গেলো না। জ্যাম ঠেলে বনানীতে গিয়ে সেবার কার্ড উদ্ধার করি। আমার সে কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৩ অগাস্ট। তার আগেই আমি মাস্টার কার্ডের জন্য আবেদন করি।
গতকাল ৪ ফেব্রুয়ারি ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় কার্ডটি তুলতে যাই। নির্দিষ্ট ডেস্কে বসা কর্মকর্তা অনেক্ষণ খোঁজাখুঁজি করলেন। এক পর্যায়ে বললেন তিন ঘন্টা পরে যেতে, তিনি খুঁজে বের করবেন। তাই করলাম। আবার গেলাম ঠিক সাড়ে তিনটায়। তিনি বললেন, আমার কার্ড আছে বনানী শাখায়। আবারো জিজ্ঞেস করলাম, কেনো সে ব্রাঞ্চে গেলো। বললেন, সিস্টেমে বনানী ব্রাঞ্চের কথাই আছে। আমি বললাম, সেখানে কার্ড দেয়ার জন্য আমি আবেদন উল্লেখ করিনি। কি আর করা দিন শেষ। ঠিক করলাম পরের দিন বনানী শাখায় যাবো। আজ যেটুকু সময় হাতে আছে দেখি অনলাইন ব্যাংকিং সেটাপ করা যায় কিনা। কোন যে কর্মকর্তা কার্ড ডেস্কে বসেছেন তিনি পাশে দেখিয়ে বললেন, উনি এ কাজটি করেন। ত্রিশোর্ধ্ব একজন নারী কর্মকর্তা, ওনার কাছে জিজ্ঞেস করতেই ভীষণ ভাব নিয়ে বললেন তিনি করেন না যাতে ওই পাশের ডেস্কে যাই। গেলাম আরেকটি ডেস্কে, সেখানে আবার আমাকে দেখিয়ে দেয়া সেই নারী কর্মকর্তাকে।
অবশেষে আরেক কর্মকর্তা এসে আমাকে একটা ফর্ম দিলেন, সেটি পুরণ করে দিয়ে আসলাম। তবে ইউজার নেম এবং পাসওয়ার্ড মিলেনি। আবার যেতে হবে। তবে এর জন্য তারা দায়ী নন। আবার ফোন নাম্বার আপডেট করতে দিয়েছি। সেটি আপডেট হলেই ইউজার নেম এবং পাসওয়ার্ড পাওয়া যাবে। যাক তারপরও তো হলো। অনলাইন ব্যাংকিং একাউন্ট করার জন্য গত বছরের মে মাসে দু’বার গিয়েছিলেন ফরেন এক্সচেঞ্জ ব্রাঞ্চে। তখন বলেছিলেন তাদের সিস্টেম কাজ করছিলো না। সে যাই হোক আজ আবার জেম ঠেলে বনানী শাখায় গিয়ে মাস্টার কার্ডটি হাতে নিতে সক্ষম হলাম। যে কর্মকর্তা কার্ডটি দিলেন, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেনো কার্ড বনানীতে? তিনি বললেন, সিস্টেমে বনানী ব্রাঞ্চের কথাই বলা আছে। আমি বুঝতে পারলাম না কেনো সেখানে যায় আমার কার্ড। আমি কখনো বনানীর ঠিকানা দেয়নি ব্যাংকের কাছে। আমি বননীতে কখনো কাজ কিংবা বসবাস করিনি। তারপরও কেনো এ পরিস্থিতি তৈরী হলো কারো জানা নেই। তবে ওই কর্মকর্তা একটা কথা বলেছেন, বললেন, এ বিষয়ে বোঝে তেমন প্রশিক্ষিত মানুষ কাজ না করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে। তার কথাটি আমার খুব মন:পুত হলো। ঠিক তাই।
ডাচ বাংলা ব্যাংক নিয়ে আমি নিজের যে অভিজ্ঞতার কথা জানালাম তা প্রায় সব গ্রাহকের বেলায় সত্য। আমি কয়েকদিন ব্যাংকে ঘুরে যেটুকু বুঝলাম, ডিজিটাল পদ্ধতির কথা বললেও তার ব্যবহার এ ব্যাংকটি যথাযথভাবে করতে পারছে না। তাছাড়া প্রায় সব কর্মকর্তারই যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই বলেই আমার মনে হয়েছে। গ্রাহকদের সাথে কথা বলার বা সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে তারা অপটুতা দৃশ্যমান। কেনো একজন গ্রাহককে অনলাইন ব্যাংকিং চালু করার জন্য ব্যাংকে আসতে হবে? কেনো কার্ড আবেদন করার জন্য একজন গ্রাহককে ব্যাংকে আসতে হবে? এসব অনলাইনেই করতে পারার কথা। এখন সবার হাতে স্মার্ট ফোন। এই ফোনেই সব কাজ সারতে পারার কথা। ব্যাংকের একটা শাখায় এতো কর্মকর্তা কর্মচারীর অধিক্য আমি অন্য দেশের ব্যাংকে দেখিনি। ইংল্যান্ডের ব্যাংগুলোর শাখায় গেলে দেখা যায় সব মিলিয়ে আট থেকে দশজন কাজ করছেন।
যাই হোক ডাচ বাংলা ব্যাংক কিংবা অন্যান্য ব্যাংকে যেসব হয়রানি চলছে তা আম জনতা মুখ খুলে বলতেও পারে না। তাই আমি মনে করি কর্তৃপক্ষ একটু সুদৃষ্টি দিলে এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অনেকে মনে করে ব্যাংক সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে তার একাউন্টের সমস্যা হতে পারে। এর মানে গ্রাহকদের সাথে ব্যাংকের সেবামূলক কোন মানসিকতার পরিচয় নেই। গ্রাহকরা ব্যাংককে নির্ভরতা মনে করতে পারে না। ব্যাংক ভরসা জায়গা না হয়ে, পরিণত হয়েছে আতংকের জায়গা হিসেবে। আমাদের ব্যাংকগুলোর মানসিকতা সেবার চেয়ে মুনাফা বেশি প্রকাশ করে। কেউ দশ কোটি টাকা ঋণ চাইলে তার পেছেনেই সময় ব্যয় করে বেশি। যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এক লক্ষ টাকা ঋণ চায় তাকে আমলে নেয় না। যদিও কোটি টাকা ঋণ নেয়া ব্যক্তিটি আর্থ পরিশোধ না করার বিষয়ে সমস্ত অজুহাত আগে থেকেই তৈরি করে রাখে। আর এক লক্ষ টাকা ঋণ গ্রহীতা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী টাকা পরিশোধে আন্তরিক থাকে। কারণ কোটিপতি ঋণ গ্রহীতার মতো তার ক্ষমতা নেই। তারপরও তার কদর ব্যাংকে নেই। আমাদের ব্যাংকগুলোর এমন মানসিকতা পরিহার না করা পর্যন্ত অর্থনীতির গতি সচল হবে না। সৎ ইতিবাচক ব্যাংকিং না থাকলে একটি দেশের সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থা বিপাকে পড়বেই। আমারতো মনে হয় আমরা সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছি।
সবশেষে আমি বলবো ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন। পাশাপাশি ব্যাংকের ইমেজ বাড়বে, মুনাফাও বাড়বে। আবার ব্যাংক সেবা ভালো হলে মানুষ ব্যাংকমুখি হবে, কমবে প্রতারণা। নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। দেশে এখন যতো ব্যাংক আছে তারা যদি নিম্নআয়ের সাধারণ মানুষের প্রতি নজর দেয় তাহলে ছোট ছোট ব্যবসা গড়ে উঠতেও সহায়ক হবে। বদলে যাবে দেশের অর্থনীতি।
লেখক- কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।