মুস্তাফিজুর রহমান আমার প্রথম সম্পাদক : কানাই চক্রবর্তী
প্রকাশিত : ২২:৩৫, ১৪ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ২২:৫২, ২০ নভেম্বর ২০১৭
আমি যাদের সম্পাদক হিসাবে পেয়েছি, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রদ্ধাভাজন এ বি এম মূসা (প্রয়াত), গোলাম সারোয়ার, আবেদ খান, হারুন হাবিব, ইহসানুল করিম হেলাল (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব), আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া এবং আবুল কালাম আজাদ (প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রেস সচিব)। কিন্তু আমার সাংবাদিক পেশার জীবনের প্রথম সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান।
সম্পাদক হিসেবে আমি অন্য যাদের নাম উল্লেখ করেছি, তারা সবাই সংবাদ জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। একেকজন একেকটি ধ্রুবতারা। সবাই সাংবাদিক হিসেবে পেশায় যোগ দিয়েছিলেন| নিজ যোগ্যতা ও অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষার পর সম্পাদক হয়েছিলেন। আমার উপরের তালিকায় আরেকজন সম্পাদকের নাম যোগ করা যায়। তিনি আমানউল্ল্যা কবির। যদিও উনার স্বাক্ষরে আমাকে এবং অনেককে একসময় (২০০২) ‘বাসস’ থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। তারপরেও বলবো তিনিও প্রথিতযশা সাংবাদিক এবং সম্পাদক ছিলেন।
আমার প্রথম সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান তাদের মতো সাংবাদিক থেকে সম্পাদক ছিলেন না । দৈনিক রুপালী নামের পত্রিকার তিনি ছিলেন প্রকাশক ও মালিক। পত্রিকার ভাষায় আমরা যাকে বলি মালিক সম্পাদক। স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিক সম্পাদকরা তার চেয়ে এগিয়ে থাকবেন- এটাই সত্য এবং বাস্তব। কিন্তু তাই বলে সম্পাদকের কোন গুণাবলী তার মধ্যে ছিলো না এমনটি কিন্তু মোটেও বলা যাবে না। সাংবাদিক, গণমাধ্যম এবং সংবাদ- এসব বিষয়ে তিনি যে যথেষ্ট ধারণা নিয়ে প্রত্রিকা প্রকাশনায় নিয়োজিত ছিলেন, পরবর্তী সময়ে তার কর্মকান্ডে এবং চিন্তা-ভাবনায় প্রকাশ পেয়েছিলো অনেকবার।
ব্যক্তিগত জীবনে মুস্তাফিজুর রহমান শুধু সম্পাদক ছিলেন না| তার বহুমাত্রিক স্বত্তাও ছিল। তার কর্মযজ্ঞ ছিলো বিশাল। তিনি ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক, সমাজসেবক, দানবীর, রাজনীতিবিদ এবং সন্দ্বীপ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য (সাংসদ লিখলাম না। এ শব্দটি তিনি পছন্দ করতেন না)। সারাদেশে বিশেষ করে সন্দ্বীপে আকাশসম জনপ্রিয়তা ছিলো তার। আমি সেদিকে যাবো না। শুধু সম্পাদক হিসেবেই আলোচনা সীমিত রাখবো এ লেখায়।
পরম মমত্ব এবং ভালোবাসা দিয়ে দৈনিক রুপালী প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এর আগে সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ, স্বদেশ খবর এবং মাসিক ব্যাংকার প্রকাশ করেন। পরে সিনে এবং ক্রীড়া বিষয়ক পত্রিকাও বের করেন। রাজনীতি এবং মিডিয়া দুটোই ছিলো তার প্রধান স্বত্ত্বা। কখনো কখনো আমার মনে হয়েছে রাজনীতি থেকেও মিডিয়াই ছিলো তার ধ্যান-প্রাণ। এর মাধ্যমে অমরত্বও পেতে চেয়েছিলেন তিনি। স্বপ্ন দেখতেন মৃত্যুর পরও তার সৃষ্ট পত্রিকার মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন। যদিও তার সেই স্বপ্ন বাস্তবতা পায়নি- সে অন্য কথা।
আমি দৈনিক রুপালীতে যোগ দিই ১৯৯১ সালের অক্টোবরে। এর তিন মাস আগে পত্রিকাটি বাজারে আসে। আমার যোগদান পর্বটিও ছিলো একটু অন্য ধরনের। এ সময় আমি ঢাকায় আমার বোনের বাড়িতে বেড়াতে আসি। সে সময় ফিরোজ ভাইও ঢাকায় ছিলেন। ফিরোজ ভাই (দিদারুল ইসলাম ফিরোজ) তখন মুস্তাফিজুর রহমানের খুবই কাছের মানুষ। তিনি আমাকে একদিন ফকিরাপুলের রুপালী অফিসে নিয়ে যান। সেখানে রাজিব হুমায়ুন স্যারও ছিলেন। ফিরোজ ভাই আমাকে মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার নাম বলার আগেই উনি আমাকে চিনেন বলে জানান। অনুযোগ করলেন সেই যে একবার উনার কাছে এসেছিলাম আর কোন যোগাযোগ রাখিনি। আমার নাটকের খোঁজ-খবরও নিলেন তিনি।
এ সময় তিনি আক্ষেপ করে রাজিব স্যারকে বলেন, উনার কাছে যারা আসেন বেশির ভাগ পিওন অথবা অন্যান্য পদের চাকরির জন্য। কিন্তু লেখালেখি কিংবা সাংবাদিক হওয়ার জন্য কেউ আসে না। সাংবাদিক হিসেবে তিনি সন্দ্বীপের ছেলে-মেয়েদেরও দেখতে চান বলে জানান। রাজিব স্যার সাথে সাথে আমাকে দেখিয়ে বলেন, ‘ওকে নিয়ে নিন।’ মুস্তাফিজুর রহমান আমার দিকে তাকালেন এবং সন্দ্বীপের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘হেতে আঁর ইয়ানে চাকরি কইরতো ন।’ পাল্টা রাজিব স্যার বলেন, কেনো করবে না? অবশ্যই করবে। তাহলে এখনই জয়েন করতে হবে মুস্তাফিজুর রহমানের ঘোষণা।
পাল্টা রাজিব স্যার বললেন, এখনই করবে?
আমি একদম দর্শক হিসেবে বসা। কিছুটা অপ্রস্তুতও। এর মধ্যে দরখাস্তের কাগজও আমার সামনে এসে গেলো। আমি অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে জানালাম, আমাকে সন্দ্বীপ যেতে হবে। সামনে আমার পারিবারিক (দাদুর বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান) অনুষ্ঠান আছে। আমি এখনই জয়েন করতে পারবো না। অনুষ্ঠান শেষ করে এসে যোগ দিতে বললেন তিনি। সাথে এটিও বললেন নিয়োগপত্র নিয়ে যাতে কেটে না পড়ি। এর মধ্যে নিয়োগপত্রেও স্বাক্ষর করে ফেলেন তিনি।
বেতন ২ হাজার ৫শ টাকা। শিক্ষানবীশ প্রতিবেদকের জন্য তখন বরাদ্ধ ছিলো ১৮শ টাকা। আমার জন্য ৭শ টাকা বেশি। ছয় মাস পর ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী আমাকে তৃতীয় গ্রেডে বেতন দেয়া হবে। তখন তৃতীয় ওয়েজ বোর্ডের থার্ড গ্রেডে বেতন ছিলো তিন হাজার আটশ টাকার মতো। অষ্টম ওয়েজ বোর্ডে যা এখন ৩৯ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে।
যাহোক, নিয়োগপত্র নিয়ে আমি সন্দ্বীপ চলে আসি এবং বাবার অনুমতি নিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে আমি দৈনিক রুপালীতে পেশাগত জীবন শুরু করি। তবে শুরুর দিনেই আমার জন্য যে আরো চমক অপেক্ষা করছিল তাকি আমি জানতাম?
দুই
গত লেখায় রুপালীতে যোগদানের দিন চমকের কথা বলেছিলাম। আসলে এটাকে চমক না বলে প্রথম অভিজ্ঞতা বলাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল বেশি। দৈনিক রুপালীর সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি সন্দ্বীপের নির্বাচিত সংসদ সদস্যও । স্বভাবতো কারনে পত্রিকার সাংবাদিক এবং অন্যান্যরা আমাকে বেশ সাদরেই বরন করে নিচ্ছিলেন। সবাইর সাথে পরিচিত হচ্ছি। হাত মিলাচ্ছি। টুক টাক কথা বলছি। হঠাৎ করে চোখ গেলো চার দিক থেকে বসা বড় টেবিলটায় । পত্রিকার ভাষায় এটাকে বলে সেন্ট্রাল ডেস্ক। এই সেন্ট্রাল ডেস্কে কাজ করেন সিনিয়র এবং অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা। পদবি সাব এডিটর , সিনিয়র সাব এডিটর , শিপট ইন চার্জ ইত্যাদি। স্বভাবতই তারা রিপোর্টারদের রিপোর্ট এডিট করেন , ভুলভ্রান্তি ধরেন। তো আমার চোখ সিনিয়র দের কাটিয়ে যার উপর স্থির হলো তিনি কোন সিনিয়র নন।
তারুন্যে ভরপুর সদাহাস্য-উজ্জ্বল এবং প্রানবন্ত এক তরুণ। আমাকে দেখে তার দেয়া হাসির মধ্যেই যেন আমি বার্তাটা পেয়ে গেলাম। আমার কোন সমস্যা হবেনা। তার উপর নির্ভর করতে পারি। এতদিন পরে স্বীকার করছি আমি তার অভিব্যাক্তিতে ভরসা করার মত কিছু পেয়েছিলাম। সাংবাদিক হিসেবে আমার অভিষেকের দিনেই উপলব্দি করলাম এই অফিসে আপাতত সেই আমার সবচেয়ে শুভকাঙ্খি আপনজন-আত্নীয়ও বটে । তার বাড়ি সন্দ্বীপের বাউরিয়া ইউনিয়নে । নাম সোহেল মাহমুদ ।
যাহোক আমার অভিষেকের এ দিনেই রাতে সন্দ্বীপ নিয়ে একটি রিপোর্ট করি। রিপোর্ট করার আগে সন্দ্বীপে আমি যথেষ্ট হোমওর্য়াক করে আসি। আমার রিপোর্টের বিষয়বস্তু ছিলো সন্দ্বীপ শহর নদী ভাঙ্গন রোধে পদক্ষেপ নেয়া হলে তার জন্য যা ব্যয় হবে তার কয়েক গুণ টাকার সম্পদ রক্ষা হবে। টাকার অঙ্কে আমি তা বিশ্লেষণ করি। রাতে রিপোর্টটি জমা দিয়ে আমি বোনের বাসায় চলে যাই। সারারাত উত্তেজনায় ঘুম আসে না, কখন ছাপার অক্ষরে দেখতে পাবো জীবনের প্রথম রিপোর্টটি। পরের দিন দুপুরের পর অফিসে ঢুকেই পরিবেশ অন্যরকম আবিষ্কার করি। কেমন একটা থমথমে ভাব।
সবাই চিন্তিত। শাহজাহান ভাই (শাজাহান সর্দার) অথবা ফজলু ভাই আমাকে আস্তে করে ডেকে নিয়ে জানতে চান আমি রিপোর্টটি সম্পাদক সাহেবকে দেখিয়েছিলাম কি-না? আমি ‘না’ বলার পর সবার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। কারণ, সন্দ্বীপের কোন নিউজ রুপালীতে প্রকাশের আগে মুস্তাফিজুর রহমানকে দেখানোর একটা কৌশলগত নির্দেশনা ছিলো, আমার তো তা জানার কথা নয়। আর উনারা ভেবেছিলেন আমি সম্পাদক সাহেবকে দেখিয়েই জমা দিয়েছি। সেদিন মুস্তাফিজুর রহমান অফিসে আসার আগ পর্যন্ত এক ধরনের অস্থিরতা সবার মধ্যে দেখতে পাই। যাহোক, বিকেলে মুস্তাফিজুর রহমান অফিসে এসেই প্রথমে আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমিতো ভয়ে অস্থির। তবে সেটা আমার জন্য যতটুকু নয় যারা আমার রিপোর্টটি ছেড়েছে তাদের জন্য বেশি। ভেতরে যাওয়ার পর আমার রিপোর্টটি নিয়ে তিনি (মুস্তাফিজুর রহমান) যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন, তা আমি ভাবতেও পারিনি। আমার জন্য রুপালীতে সাময়িক জমে থাকা মেঘ কেটে যাওয়ায় পুরো অফিস জুড়েই স্বস্তির ভাবটা ফিরে এলো।
সুধাময় করদা (প্রয়াত, উনার অধীনেই আমি কাজ শুরু করি ) খুশীতে এবং বিপদমুক্ত হওয়ায় বলেন, বিয়ের রাতেই আমি বিড়াল মারতে পেরেছি । মুস্তাফিজুর রহমান কয়েকবার পিঠ চাপড়ে দিয়ে রিপোর্টটির উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করলেন। তিনি বলেন, সন্দ্বীপ নিয়ে তিনি এ ধরনের রিপোর্ট চান। শুধু তাই নয়, সবাইকে ডেকে নিয়ে রিপোর্টটির প্রশংসা করলেন এবং এখন থেকে সন্দ্বীপ সম্পর্কিত কোন নিউজ যাবে কি যাবে না তা বিবেচনার দায়িত্ব তিনি আমাকে অর্পণ করেন। এটি ছিলো একটা কঠিন দায়িত্ব। একদিন আমাকে ডেকে সন্দ্বীপ থেকে আসা কয়েকটি নিউজ আমাকে ধরিয়ে দেন। তখন উনার কক্ষে অনেক লোক বসা। নিউজগুলো দেখে আমি খুবই বিরক্ত। এগুলো কোনো জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হতে পারে না। উনি মনে হয় আমার মনোভাবটা বুঝতে পেরেছিলেন। সন্দ্বীপের লোকজন চলে যাওয়ার পর আবার আমাকে ডাকলেন।
সবার সামনে বিশেষ করে সন্দ্বীপের লোকজনের সামনে আমাকে তিনি ‘আপনি’ করে সম্বোধন করতেন। একা যখন-তখন ‘তুমি’ বলেন। আমাকে বলেন, উনি সন্দ্বীপের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তাই অনেককে খুশি রাখতে হয়। সন্দ্বীপের নিউজ আসলেই দিতে হবে এমন কথা নয়। যেটি যাওয়ার মতো হবে, সেটি যেন দিই। এতে করে আমার বিপদ কিন্তু আরে বাড়ে । যাদের বা যে প্রতিষ্ঠানের নিউজ ছাপা হতোনা তাদের একটা ক্ষোভ আমার উপর জন্মাতো । তবে বলতে কি, আমি যতদিন রুপালীতে ছিলাম এ স্বাধীনতাটুকু আমি পুরোপুরি ভোগ করতে পেরেছিলাম। আর তা পেরেছিলাম বলেই তিনি যে সন্দ্বীপকে কতটা ভালোবাসতেন তা অনুভব করতে পেরেছি।
অবশ্য সন্দ্বীপের প্রতি তার আন্তরিকতা এবং ভালোবাসা আমি এর আগেও একবার টের পেয়েছি এবং মুগ্ধ হয়েছিলাম। ১৯৮৯ সালে সন্দ্বীপে সন্দ্বীপ থিয়েটার থেকে নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছিলাম। উৎসবের আগে আমি এবং সন্দ্বীপ থিয়েটারের সচিব সিরাজ (সিরাজুল মাওলা, বর্তমানে মুস্তাফিজুর রহমান কলেজের বাংলার শিক্ষক) ঢাকায় আসি রাজিব স্যারের পরামর্শ নেয়া ও উপস্থিতি নিশ্চিত করাসহ মুস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেয়ার জন্য।
আমরা নাট্যোৎসবটি মুস্তাফিজুর রহমানকে দিয়েই উদ্বোধন করাতে চেয়েছিলাম। নাট্যোৎসবের কথা শুনে স্যার তৎক্ষণাৎ মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের কাছে ফোন দিয়ে আমাদের অভিপ্রায়ের কথা জানান। তিনি আরো বলেন, উনার কাছে অনেকেই যে কারণে দেখা করতে যান আমরা তা নই। টেলিফোনে স্যারের ভাষা ছিলো উনি সন্দ্বীপের দুÕজন ক্রিমকে পাঠাচ্ছেন। মুস্তাফিজুর রহমান তাৎক্ষণিকভাবেই আমাদের পাঠিয়ে দিতে বললেন। স্যারের আহ্বানে তিনি যে এভাবে সাড়া দিবেন তা আমাদের কল্পনাতেও ছিলো না।
আমরা মতিঝিলে মুস্তাফিজুর রহমানের বিসিআই কর্মস্থলে হাজির হওয়ার পরেই তা যেনো টের পাই। গেটে আমাদের পরিচয় দেয়ার সাথে সাথেই আমাদের দ্বীপবন্ধুর কক্ষে পৌঁছে দেয়া হয়। মনে হয় যেন সবাই আমাদের আসার অপেক্ষায় ছিলেন। যাহোক, মুস্তাফিজুর রহমানকে আমাদের আসার উদ্দেশ্য জানাতেই তিনি অবাক বিস্ময়ে আমাদের মুখপানে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।
অনেকক্ষণ পরে পাশে বসা একজনকে (পরে জেনেছি মন্ত্রী) খুবই আবেগতাড়িত কন্ঠে সন্দ্বীপের আঞ্চলিক ভাষায় বলে ওঠেন, দেখেন দেখেন, ওরা আমার সন্দ্বীপের ছেলে। সন্দ্বীপের মতো জায়গায় নাট্যোৎসব করছে। মন্ত্রীও খুব অবাক হলেন সন্দ্বীপের সংস্কৃতির উর্বরতা দেখে।
মুস্তাফিজুর রহমানের সেদিনের উচ্ছ্বসিত মুখায়ব এখনো ভোলার নয়। প্রকৃতপক্ষে এ উচ্ছ্বাস দিয়ে তিনি মন্ত্রীকে সন্দ্বীপের মর্যাদাই তুলে ধরেছিলেন। মুস্তাফিজুর রহমানও বুঝাতে চেয়েছিলেন সন্দ্বীপ কোন অবস্থাতেই চরাঞ্চল নয়। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অনেক এগিয়ে। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের পাঠানোর জন্য রাজীব স্যারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন দেন। একই সাথে উৎসবে উপস্থিত থাকার কথাও বলেন। যদিও পরে উৎসবের তারিখ পরিবর্তন হওয়ার কারণে উনার আসা সম্ভব হয়নি।
তিন
আমি দৈনিক রুপালীতে যত বছর ছিলাম (১৯৯১-৯৭) সন্দ্বীপ সংশ্লিষ্ট সংবাদ ছাড়া কোন সংবাদেই মুস্তাফিজুর রহমানকে হস্তক্ষেপ করতে দেখিনি। সাংবাদিকদের স্বাধীনতায় তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই তিনি সবকিছু বিবেচনা করতেন। রিপোর্টারদের রিপোর্টে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। প্রকাশিত রিপোর্ট নিয়ে কোন বিতর্ক হলে তিনি সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের পক্ষ অবলম্বন করতেন। আমি একবার একটা রিপোর্ট নিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে যাই। আমি সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যাক্তি দুর্নীতির নিউজ করতাম না। পক্ষে অনেক ডকুমেন্ট থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নিয়ে একবার (’৯৪-এর মার্চ হতে পারে) একটি নিউজ করে ফেলি। এতে সে সময়ের অনেক রাঘব বোয়াল সংশ্লিষ্ট হয়ে যান। এদের মধ্যে অনেকেই সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের হোমরা-চোমড়া ব্যবসায়ী ছিলেন।
খুব সম্ভবত তারা চিনি আমদানিকারক ছিলেন। রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর তারা সরাসরি মুস্তাফিজুর রহমানের কাছে চলে আসেন এবং প্রকাশিত সংবাদটির প্রতিবাদ প্রকাশের অনুরোধ জানান। এদের মধ্যে দু’একজন মুস্তাফিজুর রহমানের পরিচিতও ছিলেন। এদের অনেক আবেদন-নিবেদনের পরও মুস্তাফিজুর রহমান তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। উনার বক্তব্য হচ্ছে, যিনি রিপোর্টটি করেছেন এটা তার ব্যাপার। তিনি এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। তবে তিনি তাদের বলেন, যদি তারা আমাকে রাজি করাতে পারে তাহলে উনার আপত্তি নেই। উনি কোনভাবেই আমাকে আদেশ বা অনুরোধ জানাতে পারবেন না। ব্যর্থ হওয়ার পর তারা এবার সরাসরি আমার কাছে আসে। এর আগে মুস্তাফিজুর রহমান আমারে কাছে সাপোর্টিং পেপার যথেষ্ট রয়েছে কি-না জানতে চান। যদিও উনার বিশ্বাস ছিলো কোন কাগজপত্র ছাড়া এবং ব্যক্তিগত লাভে এ নিউজ করেনি। আমি উনাকে বলি, আমার কাছে আরো যা ডকুমেন্ট রয়েছে তা দিয়ে দু’তিনটা নিউজ করতে পারবো। ব্যাস! এ পর্যন্তই। তখন সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদকদের একটি সংগঠন ছিলো।
মুস্তাফিজুর রহমান সেই সংগঠনের সভাপতিও ছিলেন। একদিন সবাই দলবেধে আবার উনাকে প্রতিবাদপত্র ছাপার অনুরোধ জানাতে থাকেন। মুস্তাফিজুর রহমানের একই কথা সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলেন। এদের মধ্যে একজন খুবই সিরিয়াস ছিলেন। নানাভাবে আমাকে প্রলুব্ধ করতে থাকেন। যাতে আমি রাজি হই। আমার কেনো জানি মনে হলো, উনি ওই পক্ষ থেকে কোন সুবিধা নিয়েছেন, এখন আমাকেও তা দিতে চাইছেন। আমি উনাকেও একই কথা বলি। প্রতিবাদ ছাপাবো এবং সাথে প্রতিবেদকের বক্তব্যও যাবে। কিন্তু উনাদের আবদার প্রতিবেদকের বক্তব্য ছাড়াই প্রতিবাদ ছাপাতে হবে। আমার সম্পাদক যখন আমার পাশেই আছেন, তখন তাদের হুমকি-ধামকি কোন কাজেই লাগবে না আমি জানি। এর মধ্যে অনেক দিন চলে গেছে। তাদের চেষ্টা-তদবির আপতত নেই। কিন্তু আমি কি জানতাম, তারা অন্য পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে?
এপ্রিলের প্রথম দিকে সম্পাদক এবং আমার বরাবরে হঠাৎ একটি উকিল নোটিস আসে । প্রকাশিত মিথ্যা (তাদের ভাষায়) সংবাদের প্রতিবাদ প্রথম পৃষ্ঠায় না ছাপালে তারা সম্পাদক এবং আমার বিরুদ্ধে মামলা করবে। সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান আমাকে ডেকে উকিল নোটিসটি ধরিয়ে দিলেন। কিন্তু কোন কিছুই বললেন না। কেনো জানি না, এ উকিল নোটিস দেখে আমার কোনো ভয়ই অনুভূত হলো না। সময় এবং বয়স বলেই কথা। আর সবচেয়ে বড় কথা উনি (সম্পাদক) নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিবাদপত্রটি প্রকাশের ব্যবস্থা নিতে পারতেন। আমার মতো নবীন সাংবাদিকের সিদ্ধান্তে তিনি আমল না দিলেও পারতেন। এতোদিন পরে বুঝতে পারি উনি মালিক সম্পাদক হলেও উনার ভেতরে ছিলো পেশাধারী সম্পাদকের মন।
যাহোক, মুস্তাফিজুর রহমান কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে প্রতিবাদপত্রটি প্রকাশের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে সেটি মালিক সম্পাদক বা পেশাধারী সম্পাদক, কোনটি থেকেই নয়। তার সেই প্রস্তাবে আমি উনার মধ্যে পিতৃত্বের একটা ঘ্রাণ পেয়েছিলাম। সন্তানের প্রতি পিতাদের যে অনুভূতি থাকে অনেকটা সে রকম।
এরই মধ্যে আমার বিয়ের তারিখ ঠিক হয়। বিয়ে করতে চট্রগ্রামে যাবো। যাওয়ার আগে উনার কাছ থেকে আশির্বাদ চাইতে গেলাম। উনি খুব খুশি। শুভ কামনা জানানো শেষে আমাকে হঠাৎ করে বলেন, ‘প্রতিবাদপত্রটি ছাপিয়ে গেলে ভালো হতো না?’ আমিতো হতচকিত। কিন্তু আরো আবেগাপ্লুত হওয়ার পালা পরের সংলাপে। উনার বক্তব্য হচ্ছে মাথার ওপর মামলার হুমকি নিয়ে আমি একটা শুভ কাজে কেন যাচ্ছি।
এতে উনার ভালো লাগছে না। যদি এর ভেতর মামলা-টামলা হয়ে যায়? আমাকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন, মামলা হলেতো উনার বিরুদ্ধেও হবে কিন্তু তিনি মামলা-টামলাকে ভয় করেন না। কিছুদিন আগেইতো জেল খেটে এসেছেন। উনার ভাবনা আমাকে নিয়ে। আমি যেনো কোন ঝামেলাতে না পড়ি। আপনারাই বলুন, এটা কি পিতৃমন থেকে উৎসরিত নয়? যাহোক, আমি উনাকে দৃঢতার সাথে জানালাম, মামলা করার সাহস ওরা পাবে না। ওরা জানে আমার কাছে কি আছে। এতে তাদের আরো ক্ষতি হয়ে যাবে। বললাম, ওরা জাস্ট ভয় দেখানোর জন্য নোটিস পাঠিয়েছে। আসলে পরে আর মামলা হয়নি বা সাহস করেনি। আসলে তিনি শুধু রুপালীতে আমার সম্পাদক ছিলেন না, অভিভাবকও ছিলেন। পরবর্তি কিস্তি সেই সময়ের (’৯৬) তথ্যমন্ত্রীকে নিয়ে আমার একটি লেখার প্রতিক্রিয়া এবং সম্পাদকের অবস্থান।
চার
১৯৯৭ সালের ঘটনা। তখন মুস্তাফিজুর রহমান দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য। তার দলও ক্ষমতায়। কিন্তু দৈনিক রুপালীর অবস্থা তখনও প্রায় নাজুক। মাত্র দল সরকারে এসেছে। ডিএফপির বিজ্ঞাপনই একমাত্র সম্বল। এদিয়েই সাংবাদিকদের বেতন। কিন্তু আমার এক লেখায় সেটিও হারাবার উপক্রম। এবারের সংকটের সাথে রুপালীর সবার স্বার্থ জড়িত। তখন তথ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদ ভাই। আমার খুব প্রিয় লোক। বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষক ছিলেন । বাকশালের তরুন গভর্নর ছিলেন। লেখালেখিতেও ভালো । উনি একটা বক্তৃতায় বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্রদের হাতে অতীতের সরকারগুলোর মতো অস্ত্র তুলে দেবে না। সবার হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেবে। আমি এর জবাবে, ‘প্রিয় তথ্যমন্ত্রী আপনি কতজনকে নিয়োগপত্র তুলে দিবেন?’ শিরোনামে একটি কলাম লিখি। এটি প্রকাশের পর তথ্যমন্ত্রী কেনো জানি ভয়ংকরভাবে ক্ষেপে যান। তিনি সকাল থেকেই টেলিফোনের পর টেলিফোন করতে থাকেন মুস্তাফিজুর রহমানকে।
অন্যদের কাছেও তিনি এ লেখা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করতে থাকেন। রুপালী সম্পাদক মন্ত্রীর ফোন না ধরে আমার অপেক্ষা করতে থাকেন। আগে উনি আমার সাথে কথা বলবেন, তারপর মন্ত্রীর সঙ্গে। যাহোক, যথারীতি দুপুরে আমি অফিসে এসেতো হতভম্ব। সবার দৃষ্টিতে মনে হয় আমি একজন আসামী এবং সে সময়ে তথ্যমন্ত্রী খ্যাপা মানে ভাগ্য-লক্ষ্মী বিমুখ হওয়া। আর সেটা আমার কারণেই হলো। আমার নিজেকেও খুব অপরাধী মনে হলো। নয়-ছয় ভাবতে ভাবতেই মুস্তাফিজুর রহমান দ্রুত অফিসে আসলেন এবং যথারীতি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি যেতেই উনি জানালেন, আজকের লেখাটি উনার পড়া হয়নি। মন্ত্রীকে কিছু বলতে পারবেন না, তাই উনার ফোন ধরেও নিজেকে রুপালীর সার্কুলেশন ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। পড়ার আগে আমার কাছে জানতে চাইলেন এ লেখাতে আমি কি বুঝাতে চেয়েছি?
আমি জানালাম, লেখাটি উনার বিরুদ্ধে নয়। বরঞ্চ আগের সরকারগুলোর বিরুদ্ধে। লেখাতে আমি বলতে চেয়েছি, আগের সরকারগুলো নিয়োগ বন্ধ রেখে দেশে প্রচুর শিক্ষিত বেকার রেখে গেছে। তাদের ব্যর্থতা এবং ভুলের কারনে সবাইকে নিয়োগপত্র দেয়া যাবে না। এরমধ্যে অনেকেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সও হারিয়ে ফেলেছে। আমি সেই সময়ে দেশে শিক্ষিত বেকারের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছিলাম, চাকরির সুযোগ সৃষ্টি না করে এতো বেকারদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেয়া সম্ভব হবে না। এতক্ষণে উনারও লেখাটি পড়া শেষ হয়ে গেছে। উনি লাফ দিয়ে উঠলেন এবং বললেন, এ লেখায় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছুই নেই। বর্তমান বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে। এ ধরনের লেখাই উনি চান।
আমাকে বার বার ভয় না পাওয়ার কথা বললেন এবং আরো লিখে যেতে বললেন। জানালেন, এখনই তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। আমি যতটুকু জানি মন্ত্রীর মন গলানো যায়নি। এটি উনার বিরুদ্ধে লেখা এ ধারণা মন্ত্রী অনেক দিন পর্যন্ত পোষণ করেছেন। তবে বিজ্ঞাপনে হাত দেননি।
এখানেই একজন মুস্তাফিজুর রহমান । যিনি আর্থিক ক্ষতির কথা না ভেবে মন্ত্রীর সঙ্গে জি হুজুর করেননি। বলেননি, ভুল হয়ে গেছে। এখনই ওই সাংবাদিককে আমি চাকরিচ্যুত করছি। তা না করে তার প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। এ ধরনের আরো লেখার জন্য উৎসাহিত করেছেন। এখন কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় অনেক সাংবাদিকের চাকুরীও যায় ।
লেখক পরিচিতি : কানাই চক্রবর্তী, উপপ্রধান প্রতিবেদক, বাসস।
/ডিডি/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।