মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সমকালীন রাজনীতি
প্রকাশিত : ২২:৫৭, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২৩:০৫, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের অভিযোগ সবাই (বিশেষত: মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা) বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ৩০ লক্ষ শহীদের সঙ্গে, তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে এবং সর্বোপরি সকল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। শুধু ডিসেম্বর কিংবা মার্চ এলেই স্মরণ করা হয় জাতির ওই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
আবার কখনও কখনও গানের পঙ্কক্তি ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না’ এ গানের মধ্যেই আটকে ফেলা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। সত্যি বলতে কি খুব কম লোকই তাঁদের মনে রেখেছেন। বাস্তবে তাঁরা বেঁছে আছেন কেবল তাঁদের স্বজনদের মধ্যে।
লাল-সবুজের পতাকা ছিনিয়ে আনতে স্বাধীনতার জন্য যারা সেদিন নিজের জীবনকে বাজি রেখেছিলেন-তাঁদের কেউ শহীদ হয়েছেন, যুদ্ধাহত হয়েছেন, কেউবা পঙ্গু হয়েছেন আবার অনেকেই স্বজন হারিয়েছেন। শুধু তাই নয় রক্তেভেজা পতাকা সমুন্নত রাখতে গিয়ে অনেকে হয়েছেন সহায়হীন-সম্বলহীন। আবার এদের কেউ জীবিত আছেন এক বুক দুঃখ নিয়ে, কষ্ট নিয়ে। একে ছোট করে বলতে গেলে বলতে হয়, দেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে সেদিন দেশপাগল মুক্তিযোদ্ধারা নিজের জীবনকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন।
অন্যদিকে দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা যখন লড়াই করছিল, তখন অনেকেই ঘরে বসে এয়ার কন্ডিশনের (এসি- রূপক অর্থে) বাতাসে আরামে ছিল। অথচ তাঁরাই আজ বহাল তবিয়তে রাজার হালে আছেন। বিপরীতে দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা এত বড় ভূমিকা রাখলো, তারা কি পেল? তাদের সম্মান চাওয়া কি অন্যায় ? দেশ ও দেশের মানুষ হতে কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া কি তাদের ন্যায্য অধিকার নয়? যদি অন্যায় না হয়ে থাকে, তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে
অন্যদের মেলানো ঠিক হবে না।
মুক্তিযোদ্ধারাতো বেশি কিছু চায়নি। তাঁরা কেবল চেয়েছে একটু সম্মান। কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে একটু সম্মান কি আমরা তাদের দিতে পারি না! কিন্তু আমরা কি দিতে পারছি? হয়তো পারছি না। তবে সুযোগ সুবিধা কি থেমে আছে। সেটা আজ ভোগ করছে ওইসব এসির বাতাস খাওয়া, সোফায় পা দোলানো আরামপ্রিয় ব্যক্তিরা।
মুক্তিযোদ্ধাদের যদি যথাযথ সম্মান দিতে হয় তাহলে ওইসব ব্যক্তিদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। এদিকে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ, অধিকাংশ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা (শহীদ ও যুদ্ধাহত সহ) সুযোগের চেয়ে বঞ্চনাই বেশি পেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান- এ কথা আক্ষরিক অর্থেই কেবল সত্য; বাস্তবে নয়। এ কথা সকলকে মনে রাখতে হবে, কখনোই মুক্তি বিনামূল্যে মেলেনা- বিশেষত: বাংলাদেশের সেটাতো নয়-ই।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র কারো ইচ্ছায় সৃষ্টি নয়, বল প্রয়োগেও সৃষ্ট নয়। এই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র মানুষের নিতান্ত প্রয়োজনেই ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। আর এর ফলশ্রæতিতে, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছেন, অনেক মা-বোন নির্যাতিত-ধর্ষিত হয়েছেন। কিন্তু সেই মুক্তিযোদ্ধা বা তাঁদের স্বজনদের আমরা কতটুকু মূল্যায়ণ করতে পেরেছি।
কথায় আছে, ছেলে জন্মের পর বাবা-মার মুখখানা দেখেন। আর এর মাধ্যমে ছেলের কল্যাণ হয়। কিন্তু আমি-আমরা কি দেখেছি বাবার মুখ? দেখেনি। জন্মের আগেই এতিম হয়ে গেছি আমরা। শুধু আমি নয়, আমার মতো লাখ লাখ শিশু জন্ম নিয়েছি, বাবার মুখ না দেখেই। বাবার মুখ দেখেনি তাতে কি? আমরাতো লাল সবুজে মোড়া একটি পতাকা দেখেছি।
চেতনা হলো মানুষের মনের গভীরে লালিত সেই আদর্শ, যা কোন ব্যক্তিকে সকল কাজে অনুপ্রেরণা যোগায়। সঙ্গত কারণেই বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশিদের মধ্যে সবক্ষেত্রে (জাতীয়ভাবে) মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন তো দূরের কথা আমার বাবার মতো ৩০ লক্ষ শহীদের জীবন দিয়ে পাওয়া এই দেশে অনেকেই আজ আমাদের ওপর মাতব্বরি ফলান, জমিদারি মনোভাব দেখান- যা সত্যিই বড় কষ্টের, অবমাননার ও অমর্যাদার।
এরই মধ্যে লক্ষ্য করছি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের মধ্যে বৈরিতার ইতিহাস অতীতে না হলেও এখন তীব্র, দীর্ঘ এবং গভীর। আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির গোড়াটি নিহিত রয়েছে ১৯৭১-এর ঘটনায়। হতাশার কথা, বাংলাদেশ বিরোধী অনুভূতি এখনো দেশের একটি অংশের গভীরে প্রোত্থিত। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ বিরোধীদের সম্পর্কে আধুনিক কালের বৈরীতা শুরু হয় ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর থেকে।
সঙ্গত কারণে অনেক সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রান্তিকাল দেখা গেছে। এর কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কেন্দ্র করে সকল কার্যক্রমে এক ধরণের নৈরাজ্য বিরাজ করে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের, সুবিধাভোগী অমুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে অনেক সময় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কোনঠাসা হয়ে ছিলেন-আছেন। বস্তুত, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা পর থেকেই স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্টিত হয়। এরপর গোটা একটা প্রজন্ম বড় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস শুনে।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের তালিকা তৈরি নিয়েও রাজনীতি কম হয়নি। অনেক মুক্তিযোদ্ধার পক্ষ থেকে অভিযোগ আনা হয়, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হারিয়ে গেছেন। তাই, মুক্তিযুদ্ধের বীরদের তালিকা নিয়ে অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ হোক। লক্ষ-লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজও তাদের চাওয়া আমরা পুরোপুরি পূরণ করতে পারিনি। বরং স্বাধীনতার মূল্যবোধ এ দেশে ভূলুন্ঠিত হয়েছে। এ সুযোগে দেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা (অধুনা বাংলাদেশ বিরোধীরা) যে অবস্থান নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে নিবে, তা তারা নিশ্চিত করেছে। তাঁরা (স্বাধীনতাবিরোধীরা) অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠার কারণে তাঁদের শেকড় সমাজের এক শ্রেনীর মানুষের হৃদয়ে একেবারে ঢুকে গেছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের জন্য ভয়াল হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে কত লোক আছে, তার হিসাব করতে গেলে দেখি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীর সংখ্যা এখনো নেয়াহেত কম নয়। এর অন্যতম কারণ, একাত্তরের জঘণ্যতম গণহত্যার কাহিনী হৃদয়ে ধারণ না করা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিকৃত ইতিহাস প্রচার ও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ বিরোধী অব্যাহত ষড়যন্ত্র ইত্যাদি। দেশে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। তবে সব যুদ্ধাপরাধীর কি দণ্ড হয়েছে? হয়নি। তাই দেশের সব ইউনিয়ন- উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে গোয়েন্দাদের দিয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যাকারীদের চিহিৃতকরণ, তাঁদের গণকবর শনাক্তকরণ, শহীদদের স্মৃতি ও নির্যাতনের স্মারকগুলো চিহিৃতকরণসহ প্রকৃত যোদ্ধাপরাধীদেরও শনাক্ত করতে হবে। তাঁদের বিচারের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে।
প্রকত মুক্তিযোদ্ধাসহ (শহীদ ও যুদ্ধাহতসহ) সাধারণ জনগণের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না ঘটাতে পারলে জনগণ শুধু রাজনীতিবিদদের স্বপ্নের জিকিরে আর ভুলবে বলে মনে হয় না। কারণ বিগত ৪৬ বছরে দেশে সংগঠিত সেই মহানাটক আজও মঞ্চায়িত হচ্ছে। জনগণের চাই-অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসহ অন্যান্য চাহিদা মেটানোর মত সক্ষমতা। দেশ উন্নত হচ্ছে, দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু মানুষের মৌলিক চাহিদা কি পূরণ করতে পারছে? এরই মধ্যে অনেকেই মনে করছেন, দেশে আবারও রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন। তাদের সেই সক্ষমতা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সাধারণ জনগনের জন্য নতুন সমাজ গঠনোপযোগী যে সংস্কারের পরিকল্পনা হাতে নেয়া দরকার ছিল-তা নেয়া হয়নি ( যদিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার কিছু-কিছু কাজ করেছে)।। অন্যদিকে দেশে অনেক আগে থেকে চলে আসছে- অব্যাহত সন্ত্রাস, লুটপাট ইত্যাদি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নতো এই লুটপাট ছিলনা। দেশ স্বাধীন হলে জনগণ শান্তিতে থাকবে, এই আশায়, কেবল এই আশায় অনেকে নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও অস্থিতিশীল রাজনীতির কারণে দেশে পরিপূর্ণ শান্তি আসেনি। এ দেশের জনগণের দাবি খুব বেশি নয়। কিন্তু রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন ইস্যুতে লক্ষ্য বদলে ফেলেছে (সব রাজনীতিবিদ নয়)। সংবিধানে সকলের সমান অধিকারের কথা বলা থাকলেও-বাস্তবে তার বাস্তবায়ন পরিপূর্ণভাবে হচ্ছেনা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশই দুরবস্থার দিকে যাচ্ছে। তবে এত কিছুর পরেও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে আমাদের দেশে। আমার বিশ্বাষ জনগণ পরিবর্তন আনবে। সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির আসল সমস্যা নিহিত রাজনৈতিক দলগুলোর সংকীর্ণতা ও ক্ষমতালিপ্সার মধ্যে। এ কারণে যে আদর্শে বলীয়ান হয়ে আমরা চরম ক্ষমতাধর ঔপনিবেশিক শক্তিকে ভেঙ্গে খানখান করে দিয়েছিলাম, সে আদর্শ, ঐক্য তারা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। অনেকেই আজ বলে থাকে, বর্তমানে রাজনীতি এক জঘন্য কৌশল।
তাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশ গঠন করতে হলে, দরকার রাজনৈতিক ঐক্যের। তাই ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে এবং আলোচনার ভিত্তিতে করতে হবে। আগেকার দিনের মত গণ বা সেনা অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করা যাবে না। কিন্তু দেশের বড় দুই দলের মধ্যে ক্ষমতা দখলের যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে, তা সুখকর নয়। তাই দেশের জনগণের স্বার্থে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে এখনই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে সাবধান হতে হবে। তাহলেই সুখী- সমৃদ্ধ বাংলাদেশ পাব আমরা-নচেৎ নয়। ইতিহাস বলে, ভালো কাজ না করলে কোনো কূটচাল, প্ল্যান-পায়তারাই কাজে লাগেনা। এগুলো বাদ দিয়ে জনসেবা করুন সবাই। রাজনীতি করতে হলে-এটা লাগবেই। অন্য কোন কিছুই কাজে দিবে না।
লেখক
এ.টি.এম. মোফাজ্জেল হোসেন (স্বাধীন)
লেখক-মানবাধিকার কর্মী ও একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।