সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা
প্রকাশিত : ০০:১৪, ৮ জুন ২০১৮ | আপডেট: ২৩:২০, ২১ জুন ২০১৮
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা ভালোভাবে শেষ হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া প্রায় নিয়মিত একটা ঘটনা হয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা খুব দুর্ভাবনায় ছিলাম। কিন্তু এবারে মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে খুব কঠিনভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, হাইকোর্ট থেকে একটা কমিটি করে দিয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রনালয় শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছিল যে, আগে প্রশ ফাঁস হয়েছে, আর যেন না হয়। সেজন্য বেশ কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আইন শৃংখলা বাহিনীও যথেষ্ট সতর্ক ছিল। সব মিলিয়ে সবার সবরকম উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কাজে লেগেছে, পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। বলা যেতে পারে আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির ওপর বিশ্বাস আবার ফিরে আসা শুরু হয়েছে।
পরীক্ষা শেষ হয়েছে, পৃথিবীর সবদেশেই যখন ছেলে মেয়েদের পরীক্ষা শেষ তারা লেখাপড়ার চাপ থেকে মুক্তি পায়। নূতন করে লেখাপড়া শুরু করার আগে তারা তাদের সখের কাজকর্ম করে, ঘুরতে বের হয়, বই পড়ে, নাটক সিনেমা দেখে। আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের সেই সৌভাগ্য হয় না। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথে এই দুর্ভাগা ছেলেমেয়েগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেবার জন্য “কোচিং” শুরু করে দিতে হয়। কী ভয়ংকর সেই কোচিং সেন্টার, কী তাদের দাপট। কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছিল বলে সেই কোচিং সেন্টারগুলো মিলে কী হম্বিতম্বি!
যাই হোক, এই বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকে ছেলে মেয়েরা একটুখানি বিভ্রান্ত হয়ে আছে। তারা সবাই দেখেছে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সব কয়টি ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরদের ডেকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। আমরা সবাই জানি তার অনুরোধটি আসলে অলিখিত একটা আইনের মতো, এটি সবাইকে মানতে হবে। কাজেই সবাই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে আছে যে এই বছর সমন্বিত একটি ভর্তি পরীক্ষা হবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করতে চেয়েছেন সাথে সাথে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হয়েছে। আমরা তো আশা করতেই পারি যে, তিনি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চেয়েছেন তাই এবারে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হবে। কাজেই যদি এই দেশের ছেলেমেয়েরা এই বছর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার একটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করে তাদেরকে মোটেও দোষ দেওয়া যাবে না। কিন্তু যে বিষয়টা নিয়ে সবাই বিভ্রান্ত, সেটা হচ্ছে সমন্বিত নিতে হলে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যে একটি প্রক্রিয়া শুরু করবে আমরা কেউ সেই প্রক্রিয়াটি এখনো শুরু হতে দেখছি না।
আমরা সবাই জানি দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় আগ্রহী নয়, তাই তারা নিজেরা উদ্যোগ নিবে সেটি আমরা কেউ আশা করি না। আমি যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের মাঝে থাকি আমি জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই দেশের ছেলেমেয়েদের জন্যে বিন্দুমাত্র মায়া নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিলে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকেরা যে পরিমাণ বাড়তি টাকা উপার্জন করেন তার জন্য তাদের এক ধরণের লোভ আছে কাজেই তাদেরকে যদি বাধ্য করা না হয় তাহলে এই প্রক্রিয়াটি শুরু হবে না। এতোদিন আমি সব সময়েই ভেবে এসেছি কে তাদের বাধ্য করবে? বিড়ালের গলায় ঘন্টাটি কে বাঁধবে? শেষ পর্যন্ত যখন মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে এগিয়ে আসতে দেখেছি আমি প্রথমবার আশায় বুক বেধেছি। গত বছরই এটি হওয়ার কথা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কূট কৌশলে সেটি হয়নি। এই বছরও সময় চলে যাচ্ছে কেউ মুখ ফুটে কথা বলছে না, কাল ক্ষেপন করে যাচ্ছে, এক সময় অজুহাত দেখানো হবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্যে এখন আর যথেষ্ট সময় নেই!
এই দেশের ছেলেমেয়েদের জীবনটাকে একটা অসহায় বিপর্যয়ের মাঝে ঠেলে দেয়া হবে। শুধুমাত্র অল্প কয়টি বাড়তি টাকার জন্য!
২)
সমন্বতি ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হলে সেটি নেওয়ার কথা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে। ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয় একটা ছেলে বা মেয়ের ইণ্টারমিডিয়েট সিলেবাসের ওপর। সদ্য পরীক্ষা দিয়ে শেষ করার পর এই বিষয়ের ওপর পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে তাদের পুরোপুরি প্রস্তুতি থাকে। যত দেরী করা হয় ছেলেমেয়েদের জীবন ততো কঠিন হয়ে পড়ে কারন ভর্তি পরীক্ষাওর জন্যে তাদের আবার নতুন করে লেখাপড়া করতে হয়। শুধু তাই নয় তখন এই দেশের যত কোচিং সেন্টার আছে তারা এই ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটা ভয়ংকর ব্যবসা করার সুযোগ পায়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে যদি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাটি নিয়ে নেয়া যেতো তাহলে এই কোচিং সেন্টারগুলোর ব্যবসা রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়া যেতো। এই দেশের অসংখ্য মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত সন্তানদের সময় বাঁচতো, টাকা বাঁচতো। সেই সময় এবং টাকা দিয়ে তারা অন্যকিছু করতে পারতো যেটি দিয়ে তাদের জীবনটাকে আরো একটু আনন্দময় করা যেতো!
৩)
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্যে কাউকে না কাউকে উদ্যোগ নিতে হবে। কে উদ্যোগ নেবে আমি জানি না, তবে বেশ কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন একবার আলাপ আলোচনা শুরু করেছি তাই আমার ধারণা এই উদ্যোগ নেওয়ার জন্যে তারাই সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠান। বেশ কিছুদিন আগে কোনো একটি অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন তাদের সাফল্যের তালিকাটি তুলে ধরেছিল। ঘটনাক্রমে আমাকেও সেখানে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তখন আমি এই সাফল্যের তালিকায় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাটিও দেখার আগ্রহ দেখিয়েছিলাম। সেখানে উপস্থিত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাবিদ, ভাইস চ্যান্সেলর এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন এই দেশের ছেলেমেয়েদের অমানবিক নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে এই বছর অবশ্যই এটি করা হবে। সেই থেকে আমি আশা করে বসে আছি, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি এই বছরও দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে। এখনও উদ্যোগটি শুরু হচ্ছে না।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্য কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। যেহেতু সব বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয় তাই কী কী করতে হবে সবাই যানে। এর মাঝে রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপার আছে, ছাত্র বা ছাত্রীদের পছন্দের বিষয় ঠিক করার ব্যাপার আছে, প্রশ্নপত্র রেডি করে ছাপানোর ব্যাপার আছে, কে কোথায় পরীক্ষা দেবে সেটা ঠিক করার ব্যাপার আছে, পরীক্ষা নেবার পর ফল প্রকাশের ব্যাপার আছে – এক কোথায় বলে দেয়া যায় সব মিলিয়ে একটা বিশাল দজ্ঞযজ্ঞ। তবে এর কোনোটিই অসাধ্য কোন ব্যাপার নয়। প্রথমে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে একটা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে। সিদ্ধান্তটি নেয়ার পর কোন কোন কাজ করতে হবে নিজ থেকে নির্ধারিত হয়ে যাবে, তখন একটি একটি করে সেই কাজগুলো করতে হবে। আমি খুব জোর দিয়ে এই কথাগুলো বলি কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একবার সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। শুনে অবিশ্বাস মনে হতে পারে, কিন্তু আমাদের দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার কারণে একেবারে শেষ মুহুর্তে আমরা পরীক্ষাটি নিতে পারিনি। সোজা ভাষায় আমি ঘরপোড়া গরু তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাই। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত সত্যি সত্যি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া না হচ্ছে আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকব।
৪)
এটি নির্বাচনের বছর তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার দেশের মানুষকে খুশি রাখার জন্য নানা পরিকল্পনা করছে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা হয়েছে, বাজেটে নূতন কোনো ট্যাক্স বসানো হচ্ছে না, দেখতে দেখতএ পদ্মা ব্রীজ দাড়িয়ে যাচ্ছে। কাজেই আমার ধারণা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাটি খুব সহজেই আগামী নির্বাচনের জন্য সরকারের একটি মাইল ফলক হতে পারে। আমাদের দেশের মানুষজন শেষ পর্যন্ত লেখাপড়ার গুরুত্বটি ধরতে পেরেছে, একেবারে খুব সাধারণ মানুষও চেষ্টা করে তার ছেলে বা মেয়েটি যেন লেখাপড়া করে। কাজেই লেখাপড়ার ব্যাপারে যে কোনো উদ্যোগ সাধারণ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করতে পারে। দেশের প্রায় প্রতিটী পরিবারের পরিচিত কেউ এস.এস.সি নাহয় এইচ.এস.সি পরীক্ষার্থী থাকে কাজেই এই পরীক্ষার্থীদের জীবনটা যদি একটুখানি সহজ করে দেওয়া হয়, যদি ভবিষ্যতটুকু একটু খানি নিশ্চিত করে দেওয়া হয় থাওলে সেটি একটা পদ্মা ব্রীজ কিংবা একটা মেট্রোরেল থেকে কোনো অংশে কম হবে না। জীবনকে আনন্দময় করার উন্নয়ন অবকাঠামো উন্নয়ন থেকেও বড় উন্নয়ন।
৫)
এই দেশে প্রায় চল্লিশটা পাবলিক ইউনিভার্সিটি এবং সবাই ভর্তি পরীক্ষা নেয় তাহি সবাইকে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হয়। কেউ কী এই প্রশ্নগুলো যাচাই বাছাই করে দেখেছে? প্রশ্নপত্র তৈরি করার জন্য একটি দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সবাই একটা গতানুগতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে যে কারণে খুবই নিম্নমানের বিদঘুটে কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়। এই প্রশ্নগুলো নানা কোচিং সেন্টারে গাইড বইয়ে পাওয়া যায়। আমাকে একবার হাইকোর্ট থেকে দায়িত্ব দেওয়ার কারণে আমি আবিষ্কার করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ইউনিটের প্রশ্নপত্রের প্রত্যেকটা প্রশ্ন কোনো না কোনো গাইড বই থেকে নেয়া হয়েছে। যদি ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এতো বড় একটা বিশ্ববিদ্যালয়েই এটা ঘটে তাহলে দেশের ছোটখাটো বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হতে পারে সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। শুধু যে নিম্নমানের প্রশ্ন হয় তা নয়, ভুল প্রশ্ন হয় এবং দেখিয়ে দেওয়ার পরও ভুল প্রশ্নের ভুল উত্তর দিয়ে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। কোথাও কোন স্বচ্ছতা নেই। আমার কাছে মাঝে মাঝে মনে হয় এরকম নিম্নমানের ভুলে ভরা অস্বচ্চ একটা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া থেকে লটারী করে ছেলেমেয়ের ভর্তি করা সম্ভবত বেশি মানবিক একটা ব্যাপার।
এই বছর এইচ.এস.সি পরীক্ষাটি ভালোভাবে শেষ হয়েছে। আমার ধারণা, যদি আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে এই এইচ.এস.সি পরীক্ষার ফলাফলকে ব্যবহার করে ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় সেটি গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে কোনো অংশেই খারাপ একটি প্রক্রিয়া হবে না। কলেজগুলোতে এই পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করা হয় এবং আমার ধারণা সেখানে চমৎকার একটি পদ্ধতি দাঁড়িয়ে গেছে। সেটাকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত সহজ একটি সমাধান হতে পারে।
শেষ পর্যন্ত কী হবে আমরা জানি না। যারা সিদ্ধান্ত নেবেন এখন তাদের কাছে প্রচুর তথ্য উপাত্ত আছে, আধুনিক প্রযুক্তি আছে আমি বিশ্বাস করি দেশের তরুণ ছেলেমেয়েদের জন্যে তাদের এক ধরণের স্নেহ এবং মমতাও আছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সবাই মিলে আমরা কী আমাদের ছেলেমেয়েদের একটি সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারি না?
প্রয়োজন শুধু একটি সিদ্ধান্তের।
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।