সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে সংলাপ
প্রকাশিত : ২০:০১, ৮ নভেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ২১:০২, ৮ নভেম্বর ২০১৮
অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস
বাংলাদেশ এখন তাকিয়ে আছে রাজনীতিবিদদের দিকে। গত ১০ বছরে এ দেশে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রয়েছে, তা যেন অব্যাহত থাকে এ প্রত্যাশা জন্মেছে চলতি মাসে (১ নভেম্বর ২০১৮ থেকে শুরু হয়ে সব মিলিয়ে ৮৫টির মতো রাজনৈতিক দল সংলাপ চেয়েছে) অনুষ্ঠিত সংলাপের উত্তাপ থেকে। আমরা দেখছি রাজনীতিবিদরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে আন্তরিক পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলছেন। সবাইকে নিয়ে দেশের জন্য কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই সংলাপের মাধ্যমে রাজনীতিতে সুবাতাসের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের উদার মানসিকতার পরিচয় পাচ্ছে সবাই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সংলাপে বসেন প্রধানমন্ত্রী। সাংবিধানিক পন্থায় নির্বাচনের অন্যতম বিষয় হচ্ছে এই সংলাপ।
বলা যায়, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সব দলের সঙ্গে সংলাপ প্রয়োজন, যা প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। সংলাপের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনীতির ময়দানে অন্যকে ছাড় দেওয়ার ইতিবাচক মনোভাবের পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে। সংলাপে দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতার বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। উভয় পক্ষের চাওয়া যেহেতু অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, সুতরাং সংলাপ অবশ্যই ফলপ্রসূ হওয়ার দিকেই এগোচ্ছে।
এই সংলাপ গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে যাচ্ছে। আমরা মনে করি, জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের অন্যতম পাথেয় এই সংলাপ। এই সংলাপ শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে সবুজ সংকেত। রাজনীতিতে সংঘাত-সংঘর্ষের পথে না চলে বরং সুস্থধারার অনস্বীকার্য উপায় হচ্ছে এই সংলাপ। এ জন্য বলা হচ্ছে রাজনীতিতে এই সংলাপ নতুন দিনের সূচনা করবে। উন্নয়নের ধারা ও গণতন্ত্রের ফল পেতে এই সংলাপ ইতোমধ্যে কার্যকর হয়ে উঠেছে। সংলাপ যে ফলপ্রসূ হচ্ছে, তা বিকল্পধারাসহ অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তির মুখের কথায় প্রমাণিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, তিনি সংবাদ সম্মেলন করে সংলাপের ফলাফল সম্পর্কে জাতিকে অবগত করবেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ৭ নভেম্বরের পর আর সংলাপ হবে না। এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন ‘সংলাপে কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে’। আলোচনা সন্তোষজনক হচ্ছে এবং বিরোধীদের সমস্যাগুলো সমাধানের পথে এগোচ্ছে। যদিও রাজনৈতিকভাবে এখনো বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থান দুই মেরুতে।
১ নভেম্বরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সংলাপে অংশ নিয়েছেন এবং শীর্ষনেতা ড. কামাল হোসেন সংলাপ সম্পর্কে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাত দফা দাবির ভিত্তিতে আলোচনা হয়েছে। আমাদের কথাগুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলেছি। সবকিছু তুলে ধরেছি। আমাদের নেতারা সবাই তাদের কথা বলেছেন।
তাদের অভিযোগ, উদ্বেগের কথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছেন। তবু পুনরায় সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা ওই নেতা ব্যক্ত করেছেন। কারণ প্রথম দিনই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ভবিষ্যতে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলও প্রথম দিনের পর বলেছেন, ভবিষ্যতে আরও আলোচনা হবে। সবকিছু একবারে অর্জন হয় না।
অবশ্য একদিকে সংলাপ করা আবার অন্যদিকে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের এই দ্বিমুখী আচরণ সরকারকে হতবাক করে দিয়েছে। সংলাপের উদ্যোগ যে ভালোÑ এ সম্পর্কে দেশ-বিদেশের সব বিশ্লেষক একমত পোষণ করেছেন। কারণ এর মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সরকার ঐক্যফ্রন্টকে সড়ক ছাড়া যে কোনো জায়গায় সভা করার অনুমতি দিয়েছে। রাজনৈতিক মামলার তালিকা চেয়েছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে সরকার আইনি প্রক্রিয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আসলে সংলাপ নিয়ে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা এখনো অনেক উঁচুতে। আমাদের আশা ধূলিসাৎ যেন না হয়, সেদিকে রাজনীতিবিদরা দৃষ্টি দেবেন নিশ্চয়।
ঐক্যফ্রন্টের দাবি অনুসারে প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙে দেবেন না কিংবা নির্বাচনে সেনাবাহিনীও নিযুক্ত করার সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে ৮ নভেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে। ৬ নভেম্বর ‘ইসি’ অবশ্য জানিয়েছে, সব দল চাইলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ পেছানো হতে পারে।
অনেকেই মনে করেন, সরকার সংবিধানের বাইরে যাবে না বললেও এটাও বলেছে যে, এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আলোচনা ও সহিংসতা একত্রে চলবে না, এটাই স্বাভাবিক। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলন যে সহিংস রূপ নিয়েছিল, সেই দায় এখনো বিএনপিকে বইতে হচ্ছে। দলটি এবার সে ধরনের পরিস্থিতিতে যেতে চায় না। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে চেয়েছে বলেই সংলাপে জোর দিচ্ছে, এটাই লেখাবাহুল্য।
সংলাপ যা হোক না কেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারা দেশের অগ্রগতির জন্য যে জরুরি, এ কথা এখন সাধারণ ও নিরক্ষর মানুষও বুঝতে পারে কিংবা উপলব্ধি করে। তা ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা রক্ষার জন্য সরকারের ভালো কাজের প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানানো এবং খারাপ কাজের সমালোচনা করা বিরোধী দলের দায়িত্বরূপে গণ্য করা হয়।
সেদিক থেকে সরকার ও বিরোধী দলের দেশপ্রেমিক নাগরিকদের মতো ভূমিকা জনতার কাছে প্রত্যাশিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছরে পদার্পণ, অর্থাৎ বয়সের মাপে আমাদের দেশ ধনী কিংবা গরিব হওয়ার বিষয়ে অথবা কতদূর এগিয়ে গেল সে সম্পর্কে মূল্যায়নে খুব বেশি কঠোর হওয়ার দরকার নেই। কারণ ভারত অথবা মিসরের দুই হাজার বছরের রাষ্ট্রীয় ইতিহাস এবং স্বাধীনতার অনেক দিন অতিবাহিত হলেও তারাও খুব বেশি এগিয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের মূল সমস্যা কী? আসলে বর্তমান বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের মৌল পার্থক্য চেতনা ও আচরণের। আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সেভাবে গড়ে তোলা হয়নি। ফলে নিজের দেশের সম্পদ বিনষ্টিতে আমরা আনন্দ লাভ করি। মনে করি দেশের সম্পদ আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি নামক দলের।
আসলে এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে দেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। আজ বড় বেশি দরকার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর আত্মসচেতনতা। সেই চেতনাকে লালন করে চলেছেন বর্তমান সরকার দলীয় রাজনীতিবিদরা। এ জন্যই সংলাপে তাদের অবদান স্পষ্ট রেখায় চিহ্নিত হচ্ছে জাতীয় ইতিহাসে।
সরকার ও বিরোধী জোট, দুই পক্ষেরই রাজনৈতিক কারণে সংলাপ প্রয়োজন ছিল। নির্বাচনের আগে দুপক্ষই দেখাতে চেয়েছে যে, তারা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায়। আমরা মনে করি নির্বাচনের দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সংলাপের ফলাফল ইতিবাচক হবে।
সহিংসতার পথে কোনো সমাধান যে আসে না, সে কথা বিশ্বের সবাই স্বীকার করে। অতীতে অবশ্য একমাত্র জামায়াত-বিএনপি তাতে বিশ^াস করত না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব গতিপথে চলতে দিতে হবে। সম্ভবত এ জন্যই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে সংলাপের মাধ্যমে সংকট উত্তরণের পথ খোঁজার জন্য দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো।
সে সময় শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি ভারত-রাশিয়ার সমর্থন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিজয় হিসেবে গণ্য হয়েছিল। অতীতে শেখ হাসিনার প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল এবং নতুন সরকার গঠিত হওয়ায় বিশ্বের অনেক নেতা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, বেলারুশ, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, লাওসসহ বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে যে অভিনন্দন বার্তা সে সময় এসেছিল, তার মূলে ছিল শেখ হাসিনা সরকারের ইতিবাচক কূটনৈতিক তৎপরতা। এই তৎপরতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অব্যাহত থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
নির্বাচনের আগে বলা যায়, বর্তমান সরকার বেশ ভালোভাবেই বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এটা শেখ হাসিনা সরকারের অর্জন, বাংলাদেশের অর্জন। বাংলাদেশের এই অর্জনকে ধরে রাখতে নতুন প্রজন্মকে জেগে উঠতে হবে। একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন পূর্ণতা পাবে শেখ
হাসিনার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে। গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে যে রাজনীতি প্রত্যাশিত, সেই প্রত্যাশাকে সামনে রেখে সংলাপের মাধ্যমে শেখ হাসিনা এগিয়ে যাচ্ছেন। তার প্রচেষ্টা সার্থক হলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত হবে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।