ফেসবুক সীমানা মানে না
প্রকাশিত : ১১:১১, ২৪ নভেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১৩:৪০, ২৭ নভেম্বর ২০১৮
ইন্টারনেট প্রযুক্তির যুগে ও ফেসবুকের কারণে পৃথিবীর মানুষ পরস্পরের মুখোমুখি হতে পারে, ভাবের আদান-প্রদানে অংশগ্রহণ করতে পারে। এ সুবিধা থেকে বাংলাদেশের মানুষও দূরে নয়, সেও তথ্যপ্রযুক্তির সুপার হাইওয়ের যাত্রী।
দীর্ঘদিন ধরে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বসবাসের কারণে একই ধরনের সামাজিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ায় ভিন্ন রুচি, ভিন্ন সামাজিক জীবনের মুখোমুখি হতে আমাদের অস্বস্তি হয়; কেমন যেন বিসাদৃশ লাগে।
কিন্তু এসবকে অতিক্রম করে প্রেমের টানে আমেরিকা থেকে বরিশালে এসে প্রেমিককে সম্প্রতি বিয়ে করলেন সমাজকর্মী সারা মেরিয়ান। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা। বর বরিশাল নগরীর কাউনিয়া প্রধান সড়কের খ্রিস্টান কলোনির মাইকেল অপু মণ্ডল, পেশায় রঙমিস্ত্রি। ২১ নভেম্বর তারা বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাও শেষ করেন।
২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর ফেসবুকে একটি বিতর্ক (ডিবেট) গ্রুপের মাধ্যমে সারার সঙ্গে অপুর পরিচয় ঘটে। এরপর থেকে ফেসবুকে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের দু`জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে; তা পারিবারিক সম্পর্কে রূপ নেয়।
যদিও তারা একই ধর্মাবলম্বী; তারপরও ভালোবেসে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সারা বরিশালে অপুর কাছে এসেছেন। তারা ভৌগোলিকভাবে বা সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন দুটি দেশের কৃষ্টি, রীতিনীতি, সামাজিক বাধা, নানা অবিশ্বাসকে অতিক্রম করে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে পেরেছেন, তা মানবিক সম্পর্কের শক্তির কথাই বলে।
বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে অন্তরের আলো নিয়ে পরস্পরকে দেখেছেন, তা বর্তমানের অসহিষুষ্ণ সমাজের জন্য আশাবাদ। প্রাযুক্তিক সুবিধার কারণে ২-৩ বছরে এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। গত বছরই ভিন্ন দুটি দেশের দুই নারী শত শত মাইল পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন তাদের মনের মানুষের কাছে। তাদের পরিচয় হয়েছিল অনলাইনে। একজন এসেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার রাখালগাছি গ্রামে।
এই তরুণী এলিজাবেথ গ্র্যাজুয়েশন করেছেন; সম্প্রতি ওয়ালমার্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। গ্রামেরই নির্মল বিশ্বাসের ছেলে মিঠুন বিশ্বাসের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়েছিল। আরেকজন ব্রাজিলের ৪৭ বছর বয়সী নারী সেওমা বিজেরা ছুটে এসেছিলেন সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার হালিতলা বারৈইকান্দি গ্রামে।
এই দুই নারী বাংলাদেশের দুই পুরুষকে ভালোবেসে কাছাকাছি এসেছেন এবং ঘর বেঁধেছেন। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে- সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে নয়, পরিবার-পরিজনের সবাইকে নিয়ে, সমাজকে নিয়ে। এগুলো আমাদের সমাজের নমনীয় দিকটির বিকাশের কথাই বলছে। ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন সামাজিক আচরণকে নিয়েই আমরা সমাজকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছি।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক মানবিক বিশ্বের দিকেই এগিয়ে চলেছে, ভিন্নতাকে নিয়ে বাঁচতে শিখছে। যদিও রাজনীতির ক্ষেত্রে সে ধরনের সহনশীলতা এবং ভিন্নতাকে গ্রহণ করে একসঙ্গে চলার কৌশল রপ্ত করার প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে না আমাদের। সার্বিকভাবে একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে আমাদের সমাজ জীবন এক ধরনের অসহিষুষ্ণতার মুখোমুখি।
আমরা নানাভাবে আতঙ্কিত। নানাভাবে নিজেদের নিরাপদ করার চেষ্টা করছি। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সতর্কতার সঙ্গে নজর রাখছি; তাদের উপস্থিতি ঠিক আছে কিনা, তারা কোথায় যাচ্ছে, না যাচ্ছে ইত্যাদি।
কিন্তু এই যে পৃথিবীটা খুলে গেছে, প্রত্যেক মানুষের চোখের সামনে চলে আসছে পৃথিবীর বিভিন্ন সামাজিক আচার-আচরণ থেকে খাদ্যাভ্যাস, পরিচিত হচ্ছি ভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে, কখনও কখনও তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অনলাইনে অংশগ্রহণ করছি এবং প্রবলভাবে প্রভাবিত হচ্ছি।
তার জন্য যে উপযোগিতা দরকার, মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা দরকার, সে ব্যাপারে আমরা এখনও উদ্যোগ নিতে সামর্থ্য হইনি। আমাদের দীর্ঘদিনের বিশ্বাস, আদর্শ রীতি সামাজিক আচরণকে চূড়ান্ত হিসেবে নিয়েছে- এটাই শেষ কথা ও সর্বোত্তম।
ভিন্ন বিশ্বাস, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পাশাপাশি অবস্থান করে একে অপরকে ক্ষতি না করে বরং সমৃদ্ধ করে সমাজ এগিয়ে যেতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সময় ও সহনশীলতার পরিবেশ সৃষ্টি করা; যাতে রাজনীতিকরাই বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।
লেখক: আসিফ
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।