সহিংসতা : বরগুনা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্টাইল!
প্রকাশিত : ১৯:১২, ২৮ জুন ২০১৯
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আমি মওলানা ভাসানী হলের ১৩৩ নম্বর কক্ষে থাকতাম। সাধারণত আমার রুমে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চলতো তাই পড়ালেখার কোনও পরিবেশ ছিল না। আমি নৃবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্সে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাস করার একমাত্র কারণ আমি প্রায় সব ক্লাসে উপস্থিত থাকতাম । ক্লাসের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস ছিলাম । বই কিংবা নোট পড়ে জ্ঞান অর্জন করা আমার হয়ে উঠেনি। আড্ডাবাজরা বিদায় হলে কাকডাকা ভোরে রুমের দরজা খোলা রেখে আমি ঘুমাতাম। ভোর থেকে সকাল ছিল আমার ঘুমের উত্তম সময়। ওই সময়ে আমার রুমে কেউ আসতো না। আমি নাক ডেকে ঘুমাতাম। শাহীন নামের আমাদের ব্যাচের একটি ছেলে আমার পাশের রুমে থাকত । সে ভূগোলে পড়তো । আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার কয়েক বছর পর সে মারা যায়। শাহীন ছিল খুব ফাজিল, মানে ফাজলামো করা ছাড়া সে থাকতে পারতো না। আমাদের ত্যক্ত বিরক্ত করতো। তবে সে কোনও দিন ভোরে আমাকে ডিস্টার্ব করতো না। কারণ সে জানতো ভোরবেলায় আমি ঘুমাই।
শাহীন তার অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটিয়ে একদিন ভোরে আমার রুমে এসে আমাকে ডাকতে শুরু করলো।
সে বললো, তাড়াতাড়ি উঠ, আমাদের হল শিবির দখল করে নিয়েছে। আমি তখন বেঘোর ঘুমে। আমি ঘুমের ঘোরে ধমক দিয়ে বললাম, আমি এখন ঘুমুচ্ছি, তুই যা, ঘুমের সময় ফাজলামি করবি না।
শাহীন নাছোড়বান্দা। দোস্ত উঠ। সবাই পালিয়ে গেছে । হলে তুই আর আমি ছাড়া নেতাগোছের কেউ নেই। শাহীনের পীড়াপীড়িতে ঘুম থেকে উঠার পর জানলাম, মীর মোশাররফ হোসেন হল এবং মেয়েদের হলগুলো ছাড়া সব হল ইসলামী ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা দখল করে নিয়েছে। ভাসানী হল থেকে বের হবার একটাই গেট। হল থেকে বের হওয়ার আর কোনও পথ নেই। আমরা পালাব কীভাবে !
আমি আর শাহীন অনেক আলাপ করার পর সিদ্ধান্ত নিলাম হল থেকে বের হব। যা হবার হবে ! আমি আর শাহীন ভীরু পায়ে বের হলাম। দেখি হলের সামনে বটতলায় শিবিরের ক্যাডাররা অস্ত্রসহ দাড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। আমরা তাদের সামনে দিয়ে হেটে চলে গেলাম । তারা আমাদের কিছু বলল না। আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম। সামনে গিয়ে দেখি, শিবিরের দখলে চলে যাওয়া হলগুলোর ছাদে গেটে সশস্ত্র শিবির ক্যাডাররা পাহাড়া দিচ্ছে। যারা হল দখল করেছে তাদের সবাইকে আমরা চিনি। কেউ ছাত্রদল আবার কেউ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ছিল। আগে ছাত্রদল, ছাত্রলীগের মিছিল করেছে । এখন শিবির । সব হলের ছাত্ররা মীর মোশাররফ হোসেন হলে জড়ো হয়েছে। সবাই শিবির বিরোধী মিছিল বের করেছে। আমি আর শাহীন শিবির বিরোধী মিছিলে যোগ দিলাম ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই সময়ে ছাত্র শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক সবাই একমত। তাই শিবির এভাবে ঘাপটি মেরে থেকে হল দখল করবে সেটা ছিল আমাদের কল্পনারও বাইরে । এম এইচ হল থেকে সব ছাত্র মিছিল নিয়ে ভিসির অফিসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। শিবিরের হাতে গোনা কয়েকজন ক্যাডার বাদে সব ছাত্র মিছিলে যোগ দিলো। পুলিশ আটকে দিল। কারণ কবির সরণিতে শিবিরের ক্যাডাররা অবস্থান নিয়েছিল । শিবিরের ক্যাডার হাতেগুনা হলেও তাদের হাতে ছিল অস্ত্র। তাই আমাদের হাজার হাজার ছাত্রের মিছিল তারা ভয় পায়নি। কিন্তু ততক্ষণে ছাত্রীদের বিভিন্ন হল থেকে মেয়েরা মিছিল করে ভিসি অফিস ঘেরাও করে ফেলেছে। আমাদের মিছিলও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ভিসি ভবন ঘেরাও করল। আমরা হলগুলিকে মুক্ত করতে সশস্ত্র শিবির ক্যাডারদের গ্রেফতারের দাবি করলাম। এক পর্যায়ে ভিসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করলে ঢাকা থেকে পুলিশ এল। তখন অনেক শিবির ক্যাডার পালিয়ে গেল। অবশিষ্টদের পুলিশ আটক করে কিছুক্ষণ কামাল উদ্দিন হলের গেস্ট রুমে আটকে রেখে পরে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় । কিন্তু আমাদের ভয় কাটে না। আবার শিবির অ্যাটাক করতে পারে । আমার তাই হলে হলে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের কমিটি করে পালাক্রমে হল পাহারা দেই ।
ওই সময়ে ছাত্ররা শিবিরের খোাঁজে হলে হলে চিরুনি অভিযান চালায়। যারা হল ছেড়ে পালিয়ে ছিল তাদের বিছানা পুড়িয়ে দেওয়া হয় । অনেকে ভয়ে পালিয়ে যায় । এম এইচ হলের একটা ছেলে দু তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যায়। তার নাম মামুন। ইউএনবির বিশ্ববিদ্যালয় করেসপনডেন্ট ছিল । আমার ধারণা ছিল, ছেলেটা তাবলিগ করে। শিবির করে না। ভয়ে পালিয়ে গেছে । আমার খুব মায়া লাগল । আমি অনেককে বলেছি, এভাবে তল্লাশি ঠিক হচ্ছে না, যারা নামাজ পড়ে, শিবির করে না, তারাও ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে । তার উল্টো পরিস্থিতিও আছে । শিবিরের পোলাপান ক্যাম্পাসের বাইরে শিবির বিরোধীদের খোঁজ করছে । তাই শিবির বিরোধী ছাত্র নেতাদের কেউ তখন ঢাকায় যেত না । অনেক সময় সাভারে কিংবা অন্য কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থামিয়ে শিবির বিরোধী সক্রিয় নেতা আছে কিনা তার খোঁজ খবর নিয়েছে ।
আমার ঢাকায় না গিয়ে উপায় নাই। কারণ আমি তখন মিডিয়া সিন্ডিকেট নামের একটি সংবাদ সংস্থার স্টাফ রিপোর্টার । ১৯৯৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা । আমি তখন নির্বাচন কমিশন বিট কাভার করি । প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি সাদেকের একান্ত সাক্ষাতকার নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ফিরেছি । মিডিয়া সিন্ডিকেটের অফিস ছিল বায়তুল মোকাররমের উত্তরে আজাদ প্রোডাক্টের পাশের ভবনের পাঁচ তলায় । প্রেস ক্লাবে চা খেয়ে অফিসে রওনা হলাম সাক্ষাৎকার লেখার জন্য । প্রেস ক্লাবের গেটে দেখি জাহাঙ্গীরনগর থেকে গ্রেফতার হওয়া শিবির ক্যাডারদের সম্বর্ধনা চলছে। তারা এক মাস জেল খেটে মুক্তি পেয়েছে। সবার গায়ে নতুন পাঞ্জাবি। সম্বর্ধনার চারদিকে গজারি কাঠের লাঠি নিয়ে সমাবেশ পাহাড়া দিচ্ছে ক্যাডাররা। আমাকে প্রেস ক্লাব থেকে বের হতে দেখে মামুন এগিয়ে এল, যে মামুন এম এইচ হল থেকে লাফিয়ে পালিয়ে ছিল, যাকে আমি তবলিগ বলে মনে করেছিলাম, সেই মামুন ।
মামুন আমার সঙ্গে হ্যান্ডসেক করলো। আমি তাকে বললাম, আপনি এখানে কেন ? আপনি তবলিগের মানুষ ! মামুন আমাকে বলে, সে শিবির করে । এ সময় আমাকে অনুরোধ করে শিবিরের সবাইকে ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য । আমি তাকে বললাম, আমার পক্ষে এ ব্যবস্থা করা সম্ভব না। মামুন রেগে গেল। সে বলে, তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও । তার কথায় আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। আমি দ্রুত অফিসের দিকে হাটতে থাকলাম । পিছনে অনেক আমাকে অনুসরণ করছে বলে মনে হল । প্রেস ক্লাবের দিকটায় সচিবালয়ের যে কোনে পেপারস্টল আছে, সেখানে গিয়ে আমি পিছনে তাকালাম । দেখি, শিবিরের ক্যাডাররা গজারি লাঠি নিয়ে আমার পিছু নিয়েছে। আমি ভয় পেয়ে সামনে না গিয়ে প্রেস ক্লাবের দিকে যেতে চাইলাম । এ সময় ক্যাডাররা আমাকে ধাক্কা মারে । তারপর সবাই গজারি কাঠের লাঠি দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে থাকে । আমি পিচের ওপর লুটিয়ে পড়ি । আমার রক্তে কালো পিচ লাল হয়ে পড়ে । এ সময় তারা আমার হাতের আঙুল কেটে নেয় । আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি । প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটেছে এ ঘটনা । আশেপাশে তখন প্রচুর মানুষ। সবার থমকে দাড়িয়েছে কিন্তু সন্ত্রাসীদের বিরত করতে এগিয়ে আসার সাহস পায়নি। আমার মারা গেছি এটা নিশ্চিত হয়ে শিবির ক্যাডাররা হেটে চলে যায় ।
শিবির ক্যাডাররা যাওয়ার পর পথচারিরা আমাকে টেনে তুলেন । ততক্ষণে আমার কিছুটা জ্ঞান ফিরে । রক্তাক্ত আমি প্রেস ক্লাবের দিকে যাই। প্রেস ক্লাবে তখন সাংবাদিকরা আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান । ঢাকায় আমার আত্মীয়দের খবর দেন। মিডিয়া সিন্ডিকেটের আমার কলিগ কবি সাযযাদ কাদির (বর্তমানে প্রয়াত), সম্পাদক শওকত মাহমুদসহ সাংবাদিকরা ছুটে আসেন । আমার ব্যান্ডেজসহ জরুরি চিকিৎসা চলতে থাকে। ওই সময়ে আমার মাথার পিছনে ১৪টি সেলাই করতে হয় । শরীর থেকে রক্ত মুছে দেওয়া হয় । আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন আমার সম্পাদক শওকত মাহমুদ । তিনি আমাকে বলেন, ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা ভালো হবে না। তোমাকে ধানমন্ডির একটা ক্লিনিকে নিয়ে যাই। তিনি আমাকে নাজ ক্লিনিক নামের একটি ক্লিনিকে ভর্তি করালেন । তার পাশে মেডিনোভা তাই এক্সরেসহ সব পরীক্ষা করা সহজ ।
নাজ ক্লিনিকে আমার চিকিৎসা ভালোভাবে চলছে। তবে ভিজিটর সাধারণ রোগীদের চেয়ে বেশি, সাংবাদিক, ছাত্র নেতা, রাজনীতিবিদ অনেক আমাকে দেখতে আসছেন । ডাক্তাররা বললেন, ভিজিটর এলাউ করবেন না । আপনার মাথায় আঘাত তাই কথা বলা নিষেধ । ভিজিটর এলে কথা বলা হয় । তাই তাদের এলাউ করবেন না। আমি রিসিপশনে বললাম, আমার কোনও গেস্ট এলে আমাকে না জানিয়ে কাউকে আমার কাছে পাঠাবেন না। একদিন দেখি, এক লোক আমাকে দেখতে এসেছেন, তার সঙ্গে হাসপাতালের সকল ডাক্তার ও নার্সও এলো ।
ভদ্রলোক আমাকে অনেকটা ধমকের সুরে বললেন, আপনার কি হয়েছে ।
আমি বললাম, শিবির হামলা করেছে ।
তিনি বললেন, শিবির আপনাকে মারল কেন? শিবিরকে আপনি কি করেছিলেন এসব প্রশ্ন । তিনি চলে যাওয়ার পর আমি রিসিপশনে ইন্টারকমে জানতে চাইলাম, আমাকে না জানিয়ে গেস্ট পাঠালেন কেন? রিসিপশনিস্ট বললেন, ভদ্রলোক ক্লিনিকের মালিক । তার নাম মীর কাশেম আলী। তার ঢাকায় অনেক ক্লিনিক আছে। ইসলামী ব্যাংকের মালিক তিনি । অনেক বড় বড় ব্যবসা তার আছে । তিনি জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা । আমি সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলাম, শিবিরের হাতে মার খেয়ে জামায়াত নেতার ক্লিনিকে ভর্তি হলাম ! আমি পরের দিনই ছাড়পত্র নিয়ে সোজা গ্রামের বাড়ি চলে গেলাম । আমার মা আমার পুরো মাথা ন্যাড়া ও ব্যান্ডেজ দেখে কয়েকবার অজ্ঞান হলেন । আমি তাকে বুঝালাম আমি সুস্থ । তেমন কিছু হয়নি ।
বরগুনায় স্ত্রীর সামনে স্বামী রিফাতকে নৃশংসভাবে হত্যা করতে দেখে আমার ওপর হামলার কথা মনে পড়ল। বরগুনা কিংবা জাহাঙ্গীরনগর সব খানে সহিংসতার স্টাইল অভিন্ন । বরগুনায় রিফাত মরে গেছে । আমি আল্লাহর রহমতে অলৌকিভাবে বেচে গেছি এটুকুই তফাৎ। আমার এ রক্তাত্ব ছবিটি তোলেছেন সিনিয়র ফটো সাংবাদিক আবু তাহের খোকন।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।