ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

জগন্নাথ থেকে বরগুনা একই প্রেক্ষাপট

প্রকাশিত : ২০:৪৪, ২৯ জুন ২০১৯ | আপডেট: ২০:৫৬, ২৯ জুন ২০১৯

নিহত রিফাত ও তার স্ত্রীকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একরকম যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। অনেকেই তার অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার। হত্যার বিচার চাওয়ার পরিবর্তে অনেকেই মিন্নির চরিত্র হরণেরও চেষ্টা করছে। কেউ কাবিননামা বের করছে, কেউ ডিভোর্স নামা খোঁজছে।

তবে মিন্নিও অপরাধী হতে পারে। কিন্তু একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার না চেয়ে মিন্নিকে নিয়ে তুমুল আলোচনা বখাটে নয়ন বন্ডকে বাঁচানোর চেষ্টা বলেই মনে হয়।

এসব দেখে আমার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল, তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। সবাই নিয়মিত ক্লাস করতাম। এর মধ্যে হঠাৎ একটি মেয়ে ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিল। অনেকে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার দিক থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। কিছুদিন পর এই মেয়ে বোরখা পড়ে ক্লাসে হাজির। সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। সে কিন্তু একেবারে চুপ। পরে সে তার মর্ম বেদনার কথা জানালো। এক প্রভাবশালী বখাটে তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। সবাই বিষয়টা অনুধাবন করল কিন্তু বখাটের হাত থেকে তাকে বাঁচানোর অন্য কোন উপায় বের করতে পারলো না। ফলে সে বাঁচার জন্য বোরখা পরেই ক্লাস করতে থাকলো।

একদিন গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখে বখাটে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইশারা দিল বাইকে উঠতে। তারপর তাকে নিয়ে নানা জায়গায় গেল। আইসক্রিম খাওয়ালো, ফুচকা খেলো, সব শেষে তাকে বলে দিল- কোন চালাকি করার চেষ্টা করলে পরিণতি খুব খারাপ হবে। এরপর থেকে নিয়মিত তাকে সময় দিতে হতো। তার বাইকে করে তার সঙ্গে ঘোরা লাগতো। সে যা বলবে তাই করতে হবে। আমাদের এক বন্ধু এ ঘটনায় প্রতিবাদী হয়ে উঠলে কালো পিস্তলের নল তাকে ঠাণ্ডা করে দেয়...

আমি এ ঘটনার সঙ্গে রিফাতের স্ত্রীর মতো হাজারো ঘটনার মিল খুঁজে পাই। বখাটেদের চরিত্র সব জায়গায় এক। হোক সেটা জগন্নাথ নয়ত বরগুনা। মিন্নির ক্ষেত্রে ঘটনা ভিন্নও হতে পারে। সেও বড় ধরনের অপরাধী হতে পারে। তবে এই মুহুর্তে নৃশংস হত্যার বিরুদ্ধে যেখানে সোচ্চার হওয়া দরকার সেখানে এক শ্রেণীর মানুষ বখাটেদের পক্ষ নিয়ে মূল ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। কেউ জেনে, কেউ না বোঝে, হত্যাকারীদের পক্ষ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া ছবি, গল্প, অজান্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস ঘটনার পরিবর্তে মিন্নির চরিত্র হয়ে উঠেছে মুখ্য। আমি মনে করি মিন্নি অপরাধী হলে তার বিচার করার সুযোগ আছে। সে চাইলেও পালিয়ে যেতে পারবে না। এ জন্য প্রয়োজন প্রকৃত ঘটনাটি জানা।

আমি জগন্নাথের ঘটনাটি উল্লেখ করেছি এ জন্য যে, বিষয়টি আমরা জানি। বখাটে চাইলে রিলেশন নিয়ে মেয়েটির সঙ্গে তোলা অসংখ্য ছবি দেখাতে পারে। কিন্তু আমরা জানি মূল ঘটনাটি কি ছিল।

আমার আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমি তখন ফেনী কলেজে পড়তাম। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা গল্প সবকিছুই আমাদের নিয়মিত চলত। এর মাঝে একটি মেয়েকে সব সময় চুপচাপ ক্লাসে এসে বসে থাকতে দেখতাম। সে কারও সঙ্গে কথা বলত না, একাকী আসতো একাকী চলে যেত। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি সব সময় চুপচাপ থাক, কারও সঙ্গেই কথা বলো না, কোনো সমস্যায় আছ বা কেউ ডিস্টার্ব করছে। সে কিছুই বলে না।

এর কিছুদিন পর তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে জানতে পারি প্রকৃত ঘটনা। এক বখাটের পাল্লায় পড়ে তার জীবনটাই শেষ হওয়ার পথে। সে জানায়, রাস্তায় আসা যাওয়ার পথে এক বখাটের নজর পড়ে তার উপর। প্রতিদিন বাসার সামনে এসে বসে থাকে। কখনো কখনো বাসায় চলে আসে। প্রতিনিয়ত ডিস্টার্ব হুমকি-ধমকি দিতে দিতে পরিবারের কথা চিন্তা করে ভয়ে এক সময় সে বখাটের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
ছেলেটা ওয়াদা করে অস্ত্রবাজি, মদ, গাঁজা এসব ছেড়ে দেবে। পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে। তারপর তাদের বিয়ে হয়, কিন্তু বিয়ের পরেও ছেলেটার অভ্যাসের পরিবর্তন হয়নি। ফলে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। এর মাঝে তাদের একটি সন্তান হয় কিন্তু মেয়েটির উপর নিয়মিত অত্যাচারে একসময় সে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ছেলেটিকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে সে নিজেকে সবকিছু থেকে আলাদা করে নেয়-

উদাহরণ দেওয়ার কারণ হলো সব জায়গার বখাটেরা এক। তাদের কোনো চরিত্র নেই, ধর্ম নেই, রাজনৈতিক পরিচয় নেই, তাদের পরিচয় তারা বখাটে।

তাই মিন্নিকে নিয়ে যারা আওয়াজ তুলছে তাদেরকে বলবো কৌশলে একজন হত্যাকারীর পক্ষ না নিয়ে বরং আওয়াজ তুলুন নৃশংস ঘটনায় যারা জড়িত তাদের শাস্তি হোক। সেটা মিন্নি হলেও। আর প্রশাসন আসল সত্য বের করবেই।

অতএব হত্যাকারীদের বাঁচানোর চেষ্টা করলে একদিন আপনিও এমন শিকারে পরিণত হতে পারেন। অন্যের চরিত্র নিয়ে যেভাবে তুলোধোনা করছেন আপনার চরিত্র নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যাবে এক সময়।

তাই বর্তমানে যে ঘটনা ঘটেছে, প্রকাশ্য দিবালোকে যে বিষয়টি আমরা দেখেছি, সেটি নিয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত, যাতে পুনরায় এমন ঘটনা আর ঘটতে না পারে। ঘটনা ঘটাবার আগে দশবার ভাববে কিছু করলে আমিও রক্ষা পাবো না।

লেখক: সাংবাদিক।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি