কাশ্মীর আবারো অশান্ত হবে
প্রকাশিত : ২১:১২, ৫ আগস্ট ২০১৯
ভারত অবশেষে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খারিজ করে দিলো। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা মতে জন্মু-কাশ্মীরের যে বিশেষ মর্যাদা ছিলো সে অনুযায়ী প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থ এবং যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে জম্মু কাশ্মীরে হস্তক্ষেপের অধিকার ছিল না কেন্দ্রের। এমনকি, কোনও আইন প্রণয়ন করতে গেলেও জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের সহমত নিতে হত।
ভারতীয় সংবিধানের ৩৬০ ধারায় আর্থিক জরুরি অবস্থার সংস্থান রয়েছে। কিন্তু জম্মু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব ছিল না। তাদের আলাদা পতাকা ছিল। অন্যদের যেখানে মূখ্যমন্ত্রী ছিলো, জম্মু-কাশ্মীরের সেখানে ছিলো প্রধানমন্ত্রী, ছিলো সংবিধান। তারা ক্রমান্বয়ে সেসব মর্যাদা হারায়। অবশেষে ছিলো সাংবিধানিক ধারা ও কিছু বিশেষ ক্ষমতা। ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্দেশ জারির মধ্য দিয়ে কাশ্মীর এবার সে মর্যাদাও খুইয়েছে।
৩৭০ ধারা নিয়ে কাশ্মীর এবং ভারতের একটি ইতিহাস আছে। তার আগে শুধু কাশ্মীরের ইতিহাসটি জেনে নিই। মূল কাশ্মীর উপত্যকাটি বর্তমানে ভারত,পাকিস্তান এবং চীন, এই তিনটি দেশের মাঝে অবস্থিত। পঞ্চম শতাব্দীর আগে কাশ্মীর প্রথমে হিন্দুধর্ম, তারপরে বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিলো। নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শৈব মতবাদের উত্থান ঘটে এবং ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝে বিস্তার ঘটে ইসলামের।
১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তারপর পাঁচশত বছর কাশ্মীরে মুসলিম শাসন বজায় থাকে। তার ভিতরে মুঘল সম্রাটরা ১৫৮৬ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত, তারপর আফগান দুররানী সম্রাটরা কাশ্মীর শাসন করে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ শিখ যুদ্ধে ইংরেজদের নিকট শিখরা পরাজিত হয়। তারপর অমৃতসর চুক্তি অনুসারে জম্মুর রাজা গুলাব সিংহ অঞ্চলটি ব্রিটিশদের কাছে থেকে ক্রয় করেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তাঁর বংশধরগণ কাশ্মীর শাসন করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়। ভারত-বিভাজনের অন্যতম শর্ত ছিল, ভারতের দেশীয় রাজ্যের রাজারা ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবেন, অথবা তাঁরা স্বাধীনতা বজায় রেখে শাসনকাজ চালাতে পারবেন। ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তান-সমর্থিত পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার বিদ্রোহী নাগরিক এবং পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পশতুন উপজাতিরা কাশ্মীর রাজ্য আক্রমণ করে।
কাশ্মীরের রাজা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন এবং গভর্নর-জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মাধ্যমে ভারতের সাহায্য চাইলেন। কাশ্মীরের রাজা ভারতভুক্তির পক্ষে স্বাক্ষর করবেন, এই শর্তে মাউন্টব্যাটেন তাঁকে সাহায্য করতে রাজি হলেন। তারপর ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর হরি সিং কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই করেন। তারপর ভারতীয় সেনা কাশ্মীরে প্রবেশ করে অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এইভাবে জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
ভারতের সংবিধান প্রণয়নকালে ভারত সংযুক্ত পূর্বতন প্রিন্সলি স্টেটগুলোকে প্রতিনিধি প্রেরণের অনুরোধ করা হলেও কাশ্মীরের মহারাজা তাতে কোনো প্রতিনিধি প্রেরণ করেননি। স্থানীয় ন্যাশনাল কনফারেন্স দল তাতে চারজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিল। কাশ্মীরের মহারাজা প্রতিনিধি প্রেরণ না করার রাষ্ট্রনৈতিক ভিত্তি ছিল এই যে ভারতভুক্তি বিষয়ে তিনি দিল্লির শাসকদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিলেন, তাতে (ধারা ৭) কাশ্মীরের ভারতীয় সংবিধান মেনে চলার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না, বরং নিজস্ব সংবিধান প্রণয়নের এখতিয়ার ছিল। এ রকম ঐতিহাসিক পটভূমিতেই ভারতীয় সংবিধান প্রণয়নকালে তাতে কাশ্মীর বিষয়ে ৩৭০ নম্বর ধারাটি যুক্ত হয়।
১৯৫৪ সালের ১৪ মে ভারতের প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্র প্রসাদ অধ্যাদেশের মাধ্যমে কাশ্মীরের এই মর্যাদা নির্ধারণ করেছিলেন। কাশ্মীরিরা যাতে সার্বভৌমত্বের বোধ নিয়ে, সুখী মনোভাবের সঙ্গে ‘ভারত ইউনিয়ন’-এ থেকে যায়, সেই লক্ষ্যে নেহেরু সরকারের সুপারিশে প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশটি জারি করেন সে সময়। প্রায় সম্পূরক আরেকটি সাংবিধানিক ধারা হলো ‘৩৫-এ।
৩৫এ ধারা অনুযায়ী কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া অন্য রাজ্যের কেউ সেখানে স্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারতেন না। কিনতে হলে অন্তত ১০ বছর জম্মু-কাশ্মীরে থাকতে হত। স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া জম্মু কাশ্মীরে অন্য রাজ্যের কেউ সেখানে চাকরির আবেদন করতে পারতেন না। দিতে পারতেন না ভোটও। কে স্থায়ী বাসিন্দা এবং কে নয়, তা নির্ধারণ করার অধিকার ছিল রাজ্য বিধানসভার। জম্মু-কাশ্মীরের কোনও মহিলা রাজ্যের বাইরে কাউকে বিয়ে করলে তিনি সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। এমনকি, তাঁর উত্তরাধিকারীরাও ওই সম্পত্তির মালিকানা পেতেন না। এখন থেকে সেসব বিশেষ সুবিধা কাশ্মীর আর পাবেনা।
এখানেই শেষ নয়। জম্মু-কাশ্মীরকে দু’ভাগ করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। লাদাখকে জম্মু-কাশ্মীর থেকে বের করে নতুন আরেকটি অঞ্চল সৃষ্টি করা হলো, যা শাসিত হবে কেন্দ্র থেকে এবং যেখানে কোন বিধানসভা থাকবেনা। তারমানে জম্মু-কাশ্মীর এখন থেকে আর পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা পাবেনা। দু’খন্ডে খন্ডিত কাশ্মীর শাসিত হবে কেন্দ্র থেকে যা পরিচালনা করবেন লেফটেন্যান্ট পদ মর্যাদার দু’জন গভর্নর।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদের স্বপ্ন বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির একটি। আরও দুটি দ্বন্ধমূলক প্রতিশ্রুতি বিজেপির নির্বাচনী অঙ্গীকারে ছিলো। তার একটি হলো সারা ভারতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রচলন এবং অন্যটি চরম কম্পঙ্কের সেই অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন।
বিজেপি প্রথমবার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতাকাল শেষ করলেও উক্ত তিনটি অঙ্গীকার পূরণ করতে পারেনি। এবার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার বাতিল করে দিয়ে তিন অঙ্গীকারের একটি পূরণ করলো। তবে তাদের এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বিজেপির শরিক সংযুক্ত জনতা দল এই সিদ্ধান্তে শরিক হয়নি। বিরোধীদল কংগ্রেসও বিরোধীতায় আছেন।
বিজেপির চিন্তা হলো কাশ্মীরে অমুসলমানদের হিস্যা বাড়ানো। ভারতে এ মুহূর্তে যে আটটি প্রদেশে হিন্দুরা সংখ্যালঘু, তার একটি জম্মু ও কাশ্মীর। প্রদেশের জম্মুতে হিন্দু রয়েছে ৬৩ ভাগ, লাদাখে ১২ এবং কাশ্মীরে ২ ভাগ। গড়ে পুরো রাজ্যে ৩৬ ভাগ। বিজেপি চাইতেছে কাশ্মীরে অমুসলমানদের সংখ্যা বাড়াতে পারলে রাজ্যটি ক্রমান্বয়ে ভারতীয় রূপ নিয়ে নেবে।
কাশ্মীরের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক্। রাজ্যটি পূর্ণভারতীয় রূপ নিলে ভারতের যেমন লাভ, কাশ্মীরীদেরও তেমন লাভ। কাশ্মীর নিয়ে ভারত তেমন শান্তিতেও নেই যুগ যুগ ধরে। কাশ্মীরে প্রতি ৮ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন নিরাপত্তা কর্মী আছে, যেখানে সমগ্র ভারতে প্রায় ৮০০ নাগরিকের বিপরীতে একজন নিরাপত্তাকর্মী। এই মুহূর্তে কাশ্মীর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সামরিকায়িত এলাকা।
এটা ঠিক যে, কাশ্মীর যে মর্যাদা ভোগ করে এসেছিলো এতকাল, তা অন্য ভারতীয়দের অসম্মানই করারই নামান্তর। কারণ একটি দেশের সবার মর্যাদা সমানই হওয়া উচিত এই আধুনিক যুগে। রাজ্যটির অর্থনীতির তেমন কোন উৎসও নেই। সে হিসেবে কাশ্মীর মনেপ্রাণে ভারতের অংশীজন হতে পারলে কাশ্মীরীদেরই লাভ। কিন্তু যে জাতি নিজে লাভ চায় না তাদের জোর করে লাভ চাপিয়ে দেওয়া যায় না। সেটা দিলে কি হতে পারে, বাংলাদেশ তার একটি ভালো উদাহরণ। সামরিক শক্তি দিয়ে কোন জাতিকে আপন করে নেওয়া যায়না। তাতে করে রাষ্ট্র ভেংগে টুকরো টুকরো হয়।
ভারত কাশ্মীরীদের সাথে এখন কি আচরণ করতেছে আমরা একটু দেখি। এই মুহূর্তে কাশ্মীর পুরো বিশ্ব থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন। ওমর আবদুল্লা, মেহবুবা মুখতি, সাজ্জাদ লোনসহ উপত্যকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গৃহবন্দী। বন্ধ রয়েছে স্কুল-কলেজ, ফোন ও ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা। জায়গায় জায়গায় জারি করা হয় ১৪৪ ধারা ও কারফিউ। গত দুই সপ্তাহে সেখানে প্রায় ২০ হাজার ভারতীয় সৈন্য প্রবেশ করেছে বিদ্যমান সামরিক উপস্থিতির অতিরিক্ত হিসেবে।
এই অবস্থা ভারতে জন্যও সুখকর নয়। বিজেপি বাবরী মসজিদের সেই স্থানে রামমন্দির নির্মাণের দিকেও এগুচ্ছে। আবার এমন ভয়ের পরিবেশ সুষ্টি করছে যে ৩০-৪০ লাখ আসামের জনগণ রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়ার ভয়ে আছে।
একটি দেশের মূল শক্তি হলো তার জনগণ। জনগণ যদি দ্বিধাবিভক্ত হয়, তবে রাষ্ট্রটি শক্তিশালী হতে পারে না। যে রাষ্ট্রের জনগণ ভয়ে থাকে, শাসকদলকে বিশ্বাসে নেয় না, সে রাষ্ট্রের ভবিষ্যত ভালো নয়। তাই বিজেপিকে বুঝতে হবে, তারা নিছক একটি ধর্মীয় দল নয় এখন, বরং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশের শাসক। সে দেশ, যে দেশ হাজার বছর ধরে বহুমতের, বহুপথের তীর্থভূমি। সুতরাং যেকোন সিদ্ধান্তে তাদের সাবধানে যেতে হবে, খুব ধৈর্য্যের সাথে সাবধানে।
লেখক পরিচিতি- গোলাম সারোয়ার,গবেষক ও কলামিস্ট।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।