বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ
প্রকাশিত : ১৮:৩৪, ৩০ আগস্ট ২০১৯
"নির্বোধ ঘাতকরা জানেনা
মৃত্যুতে থামেনা জীবন!
বাংলাদেশের আরেক নাম
শেখ মুজিবুর রহমান"।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়ায় পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের ঘর আলোকিত করে জন্মেছিল এক শিশুপুত্র- নাম শেখ মুজিবুর রহমান। এই বংশের পূর্বপুরুষ শেখ বোরহানুদ্দিন দুইশ’ বছর আগে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে সুদূর ইরাক থেকে বাংলায় এসে টুঙ্গিপাড়ায় আবাস গেড়েছিলেন। কঠিন ধর্মীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী শেখ পরিবারের নিজস্ব মাদ্রাসায় আমপাড়ার মাধ্যমেই শেখ মুজিবের হাতেখড়ি। ছয় বছর বয়সে মৌলিক শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে তাকে স্থানীয় গিমাডাঙ্গা স্কুলে ভর্তি করা হয়।
এই গিমাডাঙ্গা স্কুলে সেই সময়ে এক সংস্কৃতের শিক্ষক জ্যোতিষ শাস্ত্রের ওপর ভালো জ্ঞান রাখতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা শেখ লুৎফর রহমানের সঙ্গে ছিল তার সখ্য এবং শেখবাড়িতে ছিল তার যাতায়াত। একদিন স্রেফ কৌতূহলবশত ওই জ্যোতিষী শিশু শেখ মুজিবের হস্তরেখা পড়তে গিয়ে কপাল কুচকে ফেলেন। তিনি শেখ লুৎফর রহমানকে এই বলে সতর্ক করেন যে, এই শিশু বেঁচে থাকলে বড় একটা কিছু হবে; শুধু তাই নয় বংশের নাম ও গৌরব আলোকিত করবে। তবে প্রতি পদে পদে তার বাধা থাকবে, এমনকি তার অপঘাতে মৃত্যুযোগ রয়েছে।
কিশোর বয়স থেকেই তিনি প্রতিবাদী ছিলেন। সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছেন। সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে তিনি কখনও দূরে সরে যাননি এবং অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করেননি। ভীতি ও অত্যাচারের মুখেও সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে শোষিত মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। শোষিত মানুষের পক্ষে নির্ভীক অবস্থানের কারণে তিনি কেবল বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান।
১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলনে জাতির জনকের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন- ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, এক পক্ষে শোষক, আরেক পক্ষে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে শোষিত মানুষের পক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর এই অবস্থান বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। বিশ্বের শোষিত-নির্যাতিত মানুষ বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করে নেয় নিজেদের নেতা হিসেবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন গণতন্ত্রের অতন্দ্র সৈনিক। কৈশোর থেকেই তিনি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায় একজন বলিষ্ঠ নেতা। তাই কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো যথার্থ বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, আমি মুজিবকে দেখেছি।
বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রধান শক্তির উৎস ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে তিনি ছিলেন সর্বদা বজ্র কণ্ঠের। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে তার ভাষণ গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে, স্বাধিকারের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক দলিল। ওই ভাষণ একটি জাতিকে জাগ্রত করেছে, একবিন্দুতে মিলিত করেছে। এমন ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল বললেই চলে।
বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির জনকের নাম চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এ কথাই যেন ব্যক্ত হয়েছে অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই শব্দগুচ্ছে- ‘যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা গৌরী-মেঘনা বহমান/ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
একটি স্বাধীন দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু তার জীবন ও যৌবনের ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বছরের পর বছর তাকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। দেশের প্রতি, দেশের মাটির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল বলেই তিনি এটা করতে পেরেছেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেন। চরম বিপদের মুখে সেখানেও তিনি দেশের মাটির কথা, দেশের মানুষের কথা নির্ভীকচিত্তে উচ্চারণ করেন।
হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করেন। তিনি ছিলেন রাজনীতির কবি। রাজনীতিকে তিনি সৃষ্টিশীল চেতনা দিয়ে নিজের হাতে আকার দিয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আজীবন স্বপ্ন ছিল একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তার সেই স্বপ্ন আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
তাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে দেশপ্রেম নিয়ে সচেতনতার সঙ্গে আমাদের সবাইকে এগিয়ে যেতে হবে।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।