ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: কয়ায় শেকড়

রকিবুল হাসান

প্রকাশিত : ২২:০১, ৬ নভেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ১১:৪৩, ৭ নভেম্বর ২০১৯

উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যাধ্যায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে। বিখ্যাত চ্যাটার্জি পরিবারের সন্তান তিনি। চ্যাটার্জি পরিবারের প্রধান ছিলেন মধুসূদন চ্যাটার্জি। তিনি এলাকার সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। ভূপতি হিসেবে তিনি বিখ্যাত ছিলেন। মধুসূদন চট্টোপাধ্যাধ্যায়ের প্রপৌত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। 

মধুসূদন চ্যাটার্জির কনিষ্ঠ পুত্র ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতামহ। ললিতকুমার চ্যাটার্জির পুত্র মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতা। ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাগ্নে বিপ্লবী বাঘা যতীন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যয় বিপ্লবী বাঘা যতীনের আপন মামাতো ভাই। সে হিসেবে বিপ্লবী বাঘা যতীন সৌমিত্র চট্টোাপাধ্যায়ের কাকাবাবু।

বাঘা যতীনের জীবনের সাথে মামারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর বিপ্লবী জীবনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ছোটমামা ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়। ব্রিটিশবাহিনী বিখ্যাত এই মামা-ভাগ্নেকে গ্রেফতারের জন্য বহুবার ললিতকুমারের কৃষ্ণনগরের বাড়ি এবং বাঘা যতীনের কয়ার বাড়ি তল্লাস চালিয়েছেন। আর একটি বিষয় উল্লেখ্য, বাঘা যতীনের মা কবি শরৎশশী দেবী মৃত্যু পর্যন্ত কয়া গ্রামেই বসবাস করেছেন। ১৮৯৯ সালে তিনি এ গ্রামেই মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় তাঁর বিখ্যাত সন্তান বাঘা যতীন ও কন্যা বিনোদবালা দেবী মায়ের পাশেই ছিলেন। বাঘা যতীনের কোলে মাথা রেখেই তিনি মারা যান। শরৎশশী দেবী সৌমিত্র চ্যাটার্জির পিতামহের বড় বোন ছিলেন। ফলে সৌমিত্র চ্যাটার্জি আর তাঁর পূর্বপুরুষের- এই মাঝখানের কয়া গ্রামের দূরত্বটা খুব বেশি নয়। যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, তাঁর বাবার জন্ম এ গ্রামেই-এটি সত্য হওয়ার। এ বিষয়ে পরে আসছি।

মধুসূদনের সব সন্তানের জন্মই কয়া গ্রামে। তাঁরা এ গ্রামেই বড় হয়েছেন এবং এ গ্রামে থেকেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এ পরিবারের ভ’মিকা সম্পর্কে সুধারকুমার মিত্র তাঁর বাঘা যতীন গ্রন্থে বলেছেন, ‘এ গ্রাম থেকে বাঘা যতীনের সম্পাদনায় ‘সত্যাগ্রহ’ নামে একটি পত্রিকা বের হতো। সেই পত্রিকাতে তাঁর মামারা লিখতেন। ছোট মামা ললিতকুমার বেশি লিখতেন। গল্প কবিতা এসবই পত্রিকাটিতে গুরুত্ব পেতো। বাঘা যতীন নিজেও লিখতেন।। চ্যাটার্জি পরিবারের উদ্যোগেই এ গ্রামে থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ থিয়েটার থেকে নাটক মঞ্চস্থ করা হতো। চ্যাটার্জি পরিবারের সদস্যরা এসব নাটকে অভিনয় করতেন। ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় ও বাঘা যতীন এসব কর্মকা-ের মধ্যমণি ছিলেন। দুজন মামা-ভাগ্নে হলেও সম্পর্ক ছিল বন্ধুসুলভ। এর কারণও ছিল-বাঘা যতীনের থেকে মাত্র এক বছরের বড় ছিলেন ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়। বাঘা যতীন তাঁর ছোট মামা ললিতকুমারের কাছ থেকেই সুন্দরভাবে সাঁতার কাটা ও নৌকা চালানো শিখেছিলেন। 

ললিতকুমার চ্যাটার্জি বিপ্লবী হলেও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অন্তপ্রাণ ছিলেন। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিবেদিত থাকতেন। তিনি সুসাহিত্যিক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ভাগ্নে বাঘা যতীনের জীবনীভিত্তিক ‘বাঘা যতীন’ গ্রন্থটি সবচেয়ে তথ্যনির্ভর গ্রন্থ বলে স্বীকৃত। ‘পারিবারিক স্মৃতি’ নামেও তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে। যে গ্রন্থটি থেকে জানা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে এই পরিবারের গভীরতম সম্পর্কের কথা। বাবার কাছ থেকে এটা পেয়েছিলেন পুত্র মোহিতকুমার চ্যাটার্জি। তিনিও বাবার মতো অভিনয় করতে ভালোবাসতেন এবং অসাধারণ কবিতা আবৃত্তি করতেন। পুত্র সৌমিত্র পিতার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন এসবের হাতেখড়ি। চ্যাটার্জি পরিবারে রক্তধারায় যে সাংস্কৃতিক-প্রীতি ও চর্চাপ্রবাহ বয়ে আসছিল দীর্ঘকাল থেকে-প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে-সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ে এসে তা চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করে ও সাফল্যের আকাশ ছোঁয়। ভারতবর্ষের কিংবদন্তি অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। যাঁর শেকড় পোতা রয়েছে কয়া গ্রামে। 

কয়ায় যে জায়গাটিতে বর্তমানে বাঘা যতীন কলেজ, ঠিক এই জায়গাটিতে বিশাল এলাকা জুড়ে চ্যাটার্জি পরিবারের বসতিভিটা ছিল। কয়ার চাটুর্জে বাড়ির পরিচিতি শুধু কুষ্টিয়া নয়, ভারতবর্ষেও এ পরিবারের বিশেষ একটি পরিচিতি আছে। কারণ এ বাড়ির সন্তান বাঘা যতীন। তাঁর কারণেই এ বাড়ির পরিচিতি গোটা ভারত জুড়েই। এ পরিবার সম্পর্কে সুধীরকুমার মিত্র তাঁর ‘বাঘা যতীন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘তাঁহার (বাঘা যতীন) মাতুল-বংশ কয়ার চট্টোপাধ্যায় পরিবার ঐ অঞ্চলে উদার মনেবৃত্তির জন্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ; অধিকন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে স্বদেশী আন্দোলনে এই চট্টোপাধ্যায় পরিবার ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এবং তাঁহাদের বাড়ির চন্ডীমন্ডপের পার্শ্বস্থিত গ্রামসমূহের যুবক ও মহিলাগণের যে কত শত সভার অনুষ্ঠান হইয়া গিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই।’

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম এ গ্রামে না হলেও তাঁর শেকড় এখানেই গাঁথা-এ গ্রামেই। তাঁর পূবপুরুষরা এ গ্রামের দাপুটে ক্ষমতাশীল ছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি, কৃষ্ণনগরে। তাঁর পিতামহরা এ গ্রাম থেকে গিয়ে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তবে, সৌমিত্রের পিতামহ একসময় কয়া ইউনিয়নের ‘প্রেসিডেন্ট’ (বর্তমানে চেয়ারম্যান বলা হয়) ছিলেন। এরকম একটা কথা চালু আছে। এ ব্যাপারে সৌমিত্র চ্যাটার্জির সাথে আমার বন্ধু কলকাতার সৌগত চট্টোপাধ্যায় কথা বলেন। তাঁদের কথপোকথনের রেকর্ডটি আমাকে পাঠিয়েছেন। সেখানে সৌমিত্র চ্যাটার্জি বলেছেন, তাঁর পিতামহ কয়া ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। তাঁর পিতামহের বড় ভাই বা অন্য কোন ভাই কয়া ইনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এ ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করলে বসন্তকুমার চ্যাটার্জিরই প্রেসিডেন্ট থাকার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ তিনি কৃষ্ণনগর পৌরসভার চেয়ারম্যান সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। সেদিক থেকে অনুমান করা যেতে পারে কৃষ্ণনগরে চলে যাবার আগে তিনি কয়া ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট থেকে থাকতে পারেন। চাটুর্জে পরিবারের আর এক সদস্য মানিক চ্যাটার্জি দীর্ঘ বাইশ বছর কয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিও কৃষ্ণনগরে চলে যান। 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম কয়া গ্রামে কিনা সে বিষয়ে পরিষ্কার কোন তথ্য বা বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি পিতার সাথে ছোটবয়সে কয়া গ্রাম ত্যাগ করেন-সে সম্ভাবনাও একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ সম্ভাবনা সত্য হলে তাঁর জন্ম কয়ায়। ললিতকুমারের বড় ভাইদেও সন্তানদেও জন্ম কয়াতে। নিমাই ও ফণী ললিতকুমার ভাতিজা। এরা দুজনেই বাঘা যতীনের বাঘ মারার সঙ্গী ছিলেন। বাঘা যতীন বাঘ মারেন ১৯০৬ সালের ১১ এপ্রিল। এ সময় তাঁর বয়স প্রায় ২৭ বছর। তাহলে সেসময় ললিতকুমার চ্যাটার্জির বয়স ছিল প্রায় ২৮ বছর। এই সময়কালে ললিতকুমাররা কয়াতেই বসবাস করতেন। ২৮ বছর বয়সে ললিতকুমারের বিবাহ-সন্তান-এসব তো হিসেবের ভেতরেই চলে আসে। আবার এটাও ঠিক, এরও আগে থেকেই ললিতকুমারের মেজো ভাই ডাক্তার হেমন্তকুমার চ্যাটার্জি শোভাবাজারে চিকিৎসা করতেন এবং সেখানেই থাকতেন। ফলে কৃষ্ণনগরেও তাঁদের বসতি সেসময়ে থাকলেও থাকতে পারে-তবে কয়াতেও তাঁরা সেসময় বাস করতেন। হতে পারে, কয়া-কৃষ্ণনগর মিলেই তাঁদের বসবাস ছিল। পরবর্তীতে তাঁরা একেবারেই এখান থেকে কৃষ্ণনগরে চলে যান। 

সৌমিত্রের মাতা আশালতা চট্টোপাধ্যায়। পিতা মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় আইনজীবী ছিলেন। তিনি কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করতেন এবং প্রতি সপ্তাহে কৃষ্ণনগরের বাড়িতে আসতেন। সৌমিত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পডাশোনা করেন কৃষ্ণনগরের সেন্ট জনস বিদ্যালয়ে। তারপর পিতার চাকরি বদলের কারণে তাঁর বিদ্যালয়ও বদল হতে থাকে এবং তিনি বিদ্যালয়ের পডাশোনা শেষ করেন হাওডা জেলা স্কুল থেকে। তারপর কলকাতার সিটি কলেজ থেকে প্রথমে আইএসসি ও পরে বিএ অনার্স (বাংলা) পাশ করার পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ অফ আর্টস এ দু’বছর পডাশোনা করেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়। পুত্র সৌগত চট্টোপাধ্যায় ও কন্যা আশালতা চট্টোপাধ্যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বিখ্যাত অভিনেতা, আবৃত্তিকার এবং কবি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার ভিতর ১৪টিতে অভিনয় করেছেন । 

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যখন জন্ম, ভারত তখনো স্বাধীন হয়নি। স্বাধীনতা লাভের ১২ বছর আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মের ২০ বছর আগে তাঁদের কয়ার চাটুর্জে পরিবারের বিখ্যাত সন্তান বাঘা যতীন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দেন। কৃষ্ণনগওে থিয়েটার খুব সমৃদ্ধ ছিল। সেখানে সৌমিত্র বিভিন্ন দলের সাথে নিয়মিত অভিনয় করতেন। এটা তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। তাঁর পিতাও মঞ্চঅভিনয় করতেন।

 ১৯৫৯ সালে তিনি প্রথম সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায ‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিনয করেন। পরবর্তীকালে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয করের মতো পরিচালকদের সাথেও কাজ করেছেন। সৌমিত্র স্ক্রিপ্ট পছন্দ না হলে ছবি করেননি। সত্যজিৎ রায়ের ছবির স্ক্রিপ্টও পড়ে নিতেন অভিনয়ে সম্মতি প্রকাশের পূর্বে। সত্যজিৎ রায় যেমন সৌমিত্রকে গড়ে তুলেছেন, তেমনি সৌমিত্রও সত্যজিৎকে প্রকাশিত হতে সাহায্য করেছেন। চলচ্চিত্র ছাডাও তিনি বহু নাটক, যাত্রা, এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় ছাডা তিনি নাটক ও কবিতা লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন। তিনি একজন খুব উঁচুদরের আবৃত্তিকার। তাঁর পিতাও ভালো আবৃত্তি করতেন। পরিবারে সাংস্কৃতিক আবহ ছিল পুরোপুরি। তাঁর পিতা ভালো কবিতা আবৃত্তি করতেন। ওকালতির কাজকর্ম শেষ করে সন্ধ্যেবেলায় ঘরের বারান্দায় বসে কবিতা আবৃত্তি করতেন। শব্দ বাক্য যেন প্রাণ পেতো তাঁর সেই মধুময় কণ্ঠের উচ্চারণে। সৌমিত্র আর তাঁর ভাইয়েরা বাবার আবৃত্তি গভীর মনোযোগে শুনতেন। মোহিতকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর সন্তানদেরও কবিতা আবৃত্তি করতে দিতেন-শিখিয়ে দিতেন বাক্যেও অনুভ’তি বুঝে কিভাবে আবেগকে ঢেলে দিতে হয়-বোঝাতেন আবেগকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সৌমিত্র বাবার সান্নিধ্যে প্রেরণায় ও সরাসরি তত্বাবধানে শৈশবেই নাটক ও আবৃত্তির পাঠ ভালোভাবেই শিখে নিয়েছিলেন। বিখ্যাত এই মানুষটি একবার টাইফয়েড হয়েছিল। ৬৩ দিন উচ্চ তাপমাত্রার জ্বও নিয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী চিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও চিকিৎসক আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। মৃত্যুকে স্পর্শ করেই যেনো তিনি আবার নতুন জীবন পেয়েছিলেন। 

এ প্রসঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যয়ের নিজের বক্তব্য:  সৃষ্টিকর্তার ইশারায় আমি কিভাবে কিভাবে যেন টাইফয়েডের হাত থেকে রক্ষা পেলাম। সুস্থ স্বাভাবিক জ্ঞান ফিওে দেখলাম আমার স্বাস্থ্য ভেঙে একাকার। চেহারা কুৎসিত। দেহ শক্তিহীন। মনের সাথে লড়তে লাগলাম। যা এখন আছি তার উপর অঅমি নতুন চরিত্র আরোপ করবো। কুৎসিত আমি সুশ্রী হব। ভগ্ন স্বাস্থ্যেও বিপরীতে স্বাস্থ্যবান হব। কর্মহীনের বিপরীতে কর্মে সক্ষম হবো। আমি ব্যক্তি চরিত্রের উপর আরাধ্য চরিত্র উপস্থাপন করবো। আর তার জন্য আমাকে কর্মক্ষম হতে হবে। লড়তে হবে। প্রতিক’ল পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই, অনুক’ল পরিবেশ গড়ে তুলতে চাই।

এই দৃঢ় সংগ্রামই তাঁকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় করে তুলেছিল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর সর্বপ্রথম কাজ প্রখ্যাত চলচিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবিতে যা ১৯৫৯ সালে নির্মিত হয়। তিনি এর আগে রেডিওর ঘোষক ছিলেন এবং মঞ্চে ছোট চরিত্রে অভিনয় করতেন। তবে ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্র অভিনয়ের আগে সত্যজিৎ রায়ের কাছে তাঁর সম্পর্কে বলেছিল, ‘তাঁর মুখে বসস্ত রোগের দাগে তাঁর মুখে ছাপ পড়েছে’। প্রতিবন্ধকতা শুরুতেই। অবশ্য সত্যজিৎ রায় এ সবে গুরুত্ব দেননি। বরয়ং তিনি বলেছেন, ‘সবাই বলছে অনেক দাগ টাগ হয়েছে, কৈ কিছুইতো হয়নি।’ ‘অপুর সংসার’ সহ  তিনি সত্যজিৎ রায়ের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি সত্যজিৎ রায় নির্মিত বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে আবির্ভূত হন। তার অভিনীত কিছু কিছু চরিত্র দেখে ধারণা করা হয যে তাঁকে মাথায় রেখেই গল্প বা চিত্রনাট্যগুলো লেখা হয়। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির ভিতরে সব থেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। প্রথমে ফেলুদা চরিত্রে তার চেয়েও ভাল কাউকে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তাঁর অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি ‘সোনার কেল্লা’ মুক্তি পাওয়ার পর সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেন যে তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ ছবিটি করতে পারত না। তিনি সত্যজিৎ রায় ছাড়াও বাংলা ছবির প্রায় সমস্ত মননশীল পরিচালক -সেইসময় থেকে এই সময় যথা মৃণাল সেন. তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, কৌশিক গাঙ্গুলী, অতনু ঘোষ, সৃজিত মুখার্জির সাথে তিনি অভিনয় করেছেন।

উত্তমকুমারের সাথে একসারিতে তার নাম নেয়া হয়। বাংলা ছবির দর্শক এক সময় দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল-এই দুই প্রবাদ প্রতীম অভিনেতার পক্ষে বিপক্ষে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শুধু যে আর্ট হাউজ সিনেমা করেছেন তা নয়, তিনি বাক্সবদল, বসন্ত বিলাপের মতো রোমান্টিক এবং কমেডি ছবিতেও অভিনয় করেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে কোনো নায়িকার সেরকম সফল জুটি নেই। তিনি তাঁর সময়ের প্রায় সব নায়িকার সাথেই অভিনয় করেছেন। তবে মাধবী মুখোপাধ্যায় ও তনুজার সাথে তাঁর রোমান্টিক ছবিগুলো চিরকালীন আবেদন তৈরি করেছে। মানুষের অন্তরে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফেলুদার চরিত্রে সব থেকে বেশি মানানসই হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ফেলুদা ছাড়াও ‘কোণি’ ছবিতে মাস্টার’দার চরিত্র এবং ‘আতঙ্ক’ ছবিতে মাস্টারমশাই চলচ্চিত্রপ্রেমিদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। বাস্তবচিত ও সাধারণ মানুষের চরিত্রেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান 'Officier des Arts et Metiers' পেয়েছেন। সত্তরের দশকে তিনি ‘পদ্মশ্রী’ পান কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরবর্তীকালে তিনি ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে পান সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। দু’ বার চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার পান, ২০০১ ও ২০০৮ সালে। ২০১২ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেছেন।

সৌমিত্র অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র: অপুর সংসার (১৯৫৯), ক্ষুদিত পাষাণ (১৯৬০), দেবী (১৯৬০), তিন কন্যা (১৯৬১), ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১), অতল জলের আহ্বান (১৯৬২), বেনারসী (১৯৬২), অভিজান (১৯৬২), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), চারুলতা (১৯৬৪), কিনু গোয়ালার গলি (১৯৬৪), বাক্স বদল (১৯৬৫), কাপুরুষ (১৯৬৫), একই অঙ্গে এত রূপ (১৯৬৫), আকাশ কুসুম (১৯৬৫), মণিহার (১৯৬৬), কাঁচ কাটা হীরে (১৯৬৬), হাটে বাজারে (১৯৬৭), অজানা শপথ (১৯৬৭), বাঘিনী (১৯৬৮), তিন ভুবনের পারে (১৯৬৯), পরিণীতা (১৯৬৯), অপরিচিত (১৯৬৯), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), প্রথম কদম ফুল (১৯৭০), মাল্যদান (১৯৭১), স্ত্রী (১৯৭২), বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩), অশনি সংকেত (১৯৭৩), সোনার কেল্লা (১৯৭৪), সংসার সীমান্তে (১৯৭৪), দত্তা (১৯৭৬), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮), দেবদাস (১৯৭৯), গণদেবতা (১৯৭৯), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), কোণি (১৯৮৪), ঘরে বাইরে (১৯৮৪), আতঙ্ক (১৯৮৬), গণশত্রু (১৯৮৯), শাখা প্রশাখা (১৯৯০), তাহাদের কথা (১৯৯২), মহাপৃথিবী (১৯৯২), হুইল চেয়ার (১৯৯৪), পারমিতার একদিন (২০০০), দেখা (২০০১), আবার অরণ্যে (২০০২), পাতালঘর (২০০৩), পদক্ষেপ (২০০৬), দ্য বং কানেকশন (২০০৬), চাঁদের বাড়ি (২০০৭), নোবেল চোর (২০১২), মাছ, মিষ্টি অ্যান্ড মোর (২০১২), অলীক সুখ (২০১৩), রূপকথা নয় (২০১৩), দূরবিন (২০১৪)।
সৌমিত্র অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য নাটক: তাপসী (১৯৬৩), নামজীবন (১৯৭৮), রাজকুমার (১৯৮৩), ফেরা (১৯৮৭), নীলকণ্ঠ (১৯৮৮), ঘটক বিদায় (১৯৯০), দর্পণে শরৎশশী (১৯৯২), চন্দনপুরের চোর (১৯৯৪), টিকটিকি (১৯৯৫)।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভালো কবিতা লেখেন। কাব্যগ্রন্থ আছে। বাংলা কবিতায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ কবি। কিন্তু তাঁর অভিনয়-খ্যাতির আড়ালে অনেকটাই ম্লান হয়ে আছে তাঁর কবিতাকর্ম। 

কবিতা লেখা বিষয়ে তিনি বলেছেন-বাঙালি তরুণদের বেলায় এটা ঘটেই থাকে। কাউকে ভালো লেগে গেল তাকে নিয়ে কবিতা লেখে। আমারও সেরকম একটা ব্যাপার ঘটেছিল। তখনকার দিনে প্রেমিকার হাত ধরতেও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হতো। প্রেমিকার মন পাবার জন্য কবিতা লেখা শুরু করি। কবি ও গদ্য লেখক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত। তাঁর অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো : হায় চিরজল, নির্বাচিত এক্ষণ: আখ্যান ও স্মৃতিকথা, মধ্যরাতের সংকেত, জন্ম যায় জন্ম যাবে, কবিতাসমগ্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যসংগ্রহ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লেখালেখির গুণটা জন্মগতভাবেই পেয়েছিলেন। তাঁর পিতামহ ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর অন্য ভাইয়েরাও লেখালেখি করতেন। বিশেষ কওে তাঁর পিতামহ ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত লেখক ছিলেন। তাঁর পিতামহের বোন শরৎশমী দেবীও কবি ছিলেন। এমনকি তাঁর বিখ্যাত কাকা বিপ্লবী বাঘা যতীন কবিতা ও গল্প লিখতেন। বাঘা যতীনের বোন বিনোদবালাও কবিতা লিখতেন। ফলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জন্মগতভাবেই সাহিত্য-সংস্কৃতির বিশাল এক ঐতিহ্য ও প্রেরণা পেয়েছিলেন।

কয়ার মাটির প্রসঙ্গ দিয়েই এ লেখাটির সমাপন টানতে চাই। বেশ কয়েক বছর আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যয় ঢাকায় এসেছিলেন। একটা নামি দৈনিকে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছিল। স্মৃতিতে যতোটুকু মনে পড়ে-সেখানে একটা প্রশ্ন ছিল এরকম-আপনাকে যদি লালন সাঁই চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেয় হয়, আপনি কি তা গ্রহণ করবেন?-তাঁর উত্তরে তিনি কয়া গ্রামকে নিজের গ্রাম বলে উল্লেখ করে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। উত্তরটাা এরকম ছিল--এরকম প্রস্তাব পেলে সেটা তো আমার জন্য সম্মানের। আমার শরীরে তো কয়া গ্রামের মাটি। আমার পূর্বপুরুষেরা কয়া গ্রামের মানুষ। কয়া আর ছেঁউড়িয়া তো পাশাপাশিই। আমি তো লালন চরিত্র  সবচেয়ে ভালো আত্মস্থ করতে পারবো। কিন্তু আমার যে বয়স, সেটাও তো ভাবতে হবে আমাকে।-এতেই তো অনুভূত হয় কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চেতনে মননে কয়া গ্রামের সন্তান-তাঁর শেকড় তো গ্রোথিত কয়ার মাটিতেই।

লেখক : ড. রকিবুল হাসান (কবি-কথাসাহিত্যিক-গবেষক। বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ)

আরকে//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি