ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ দেশপ্রেম

ডাক্তার একরাম চৌধুরী

প্রকাশিত : ২২:৪৩, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

২০০২ সাল,আমি তখন সদ্য বিসিএস করা নতুন ডাক্তার। সবাই জেলা সদরে পোস্টিং এর জন্য ডিভিশনাল অফিসে দৌঁড়ঝাপ করছে। আমি পোস্টিং চাইলাম মফস্বলে একেবারে নিজের এলাকায়। কাঠখড় পুড়িয়ে তা পেয়েও গেলাম, একেবারে নিজের উপজেলাতে। মহা আনন্দে যোগদান করলাম। 

আমি এলাকার পরিচিত জনের সন্তান। আব্বা এই এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৮৫ -৯০। তার আগে ছিলেন গণপরিষদ সদস্য। নির্ঝঞ্জাট মাটির মানুষ ছিলেন আব্বা। সবার সাথে মিশতেন অবলীলায়। কর্মজীবনে এলাকায় বহু স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত ছিলেন এবং সুনামের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে আব্বার ছিল বিশাল অবদান। যাই হোক সরকারী চাকুরীজীবি হিসেবে যোগদান করেই পরদিন আমার কর্মস্থল আমিশাপাড়া সাবসেন্টারে চলে গেলাম। নোয়াখালীর মাইজদীতে আমাদের বাসা থেকে বাসে করে বজরা এরপর টেম্পুতে ঝুলতে ঝুলতে আমার নতুন কর্মস্থল। নতুন অফিস দেখে মনটা একেবারে খারাপ হয়ে গেল। অফিসে এসে কাউকেই পেলাম না। শেষে লোকমারফত খবর পাঠিয়ে দারোয়ানকে আনালাম। ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর মহাশয় এলেন মহা বিরক্তি নিয়ে।
 
পুরানো জীর্ণশীর্ণ  ৩ রুমের এক বিল্ডিং। এক রুমে অফিস এবং রুগী দেখার বিছানা, একটা স্টোর  রুম আর টয়লেট। প্লাস্টার উঠা ছাদ।  টয়লেট কবে শেষ ব্যবহার হয়েছে জানি না। তবে দরজা খুলতেই পেট গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো, কোনো রকমে সামাল দিলাম। প্রাকৃতিক কাজের জন্য প্রকৃতি ছাড়া উপায় নেই বুঝে গেলাম। টেবিলটা একেবারে নড়বড়ে। মনে হচ্ছিলো যে চেপে লিখলেই ভেঙে যাবে। দারোয়ান চেয়ারের উপর রাখা জরাজীর্ণ তোয়ালে দিয়ে টেবিল ঝাড়া শুরু করলো। দুজনেরই বিষম খাওয়ার অবস্থা। ইতিমধ্যে বেশ কিছু লোক জমে গেছে। ডাক্তার সাহেব এসেছে শুনে তারা বেশ হতবাক। এইখানে কেউ থাকে না স্যার, দারোয়ান সুধায়। কেমনে থাকবে, টয়লেট দেখছেন স্যার? কথা সত্য। দুপুর পেরোনোর পর সেকমো সাহেব এলেন, উনি ব্যস্ত মানুষ, চরম প্র্যাক্টিস এখানে। আমি থাকবো শুনে তেমন ভাবান্তর দেখালেন না।
 
যাই হোক কাজে লেগে  গেলাম আমি।  টগবগে তরুণ আমি, ২ সপ্তাহের মধ্যে ব্যবহার উপযোগী করে তুললাম সাব সেন্টারকে। রুগী দেখা শুরু করলাম পুরোদমে। দেশের জন্য কিছু করছি, খুব ভালো লাগছিল। মাস দুয়েক গেল।  হঠাৎ একদিন দেখি ইউএনও সাহেবের চিঠি। আমাকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার কেন্দ্র প্রধান হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে। আমি  জানতাম যে আমিশাপাড়া হচ্ছে নকল উৎসবের প্রাণ কেন্দ্র। বুঝলাম আমাকে হয়তো নকল ফ্রি করে দিতে হবে নয়তো কঠোর হস্তে নকল দমন করতে হবে। 

আমি ছোটোখাটো মানুষ, তবে আপোষ করতে জানি না , সাদাসিধেভাবে নিজে সঠিক যেটাকে ভেবেছি সেটাই করেছি আজীবন। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে নকল প্রতিরোদ করবো। সোনাইমুড়ী থানার ওসি, এস আই পরিচিত ছিল। তাদের জানালাম আমার প্ল্যান। ইউএনও সাহেব আশ্বস্থ করলেন, বললেন যে উনি সবরকম সাহায্য করবেন নকল প্রতিরোধ করার জন্য। আমিও বিপুল উৎসাহে তৈরি হলাম আমার পেশার বাইরে দেশের জন্য কিছু করতে পারবো বলে। আমার জন্য চমক অপেক্ষা করছিল।
 
প্রথম থেকেই কড়াকড়ি করলাম পরীক্ষার হলে, প্রবেশ পথে, ১৪৪ ধারা দিলাম পরীক্ষার হলের ১০০ গজের ভেতর। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সকল সদস্য, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের একটাই দাবি অবাধে নকল করতে দিতে হবে। আমিও নাছোড় বান্দা। নকল করতে দিবো না। ইংরেজি পরীক্ষার দিন ৩ বস্তা নকল ধরলাম হল গেটে। এরপর শুরু হলো হুমকি। বাসায় পৌঁছাল কাফনের কাপড়। প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের জানালাম। সমস্যা টা হলো যেদিন স্থানীয় এক জাঁদরেল ব্যক্তির কন্যাকে বহিস্কার করলাম নকলসহ হাতে নাতে।
 
উনি এসে হুমকি দিলেন, এই এলাকায় কিভাবে চাকুরী করি দেখে নিবেন। উনি স্থানীয় সংসদ সদস্যের আত্মীয় সেটাও জানিয়ে দিলেন। আমার বিরুদ্ধে মিছিল করালেন, প্লাস্টার খসে পড়া সাব সেন্টারের ভাঙ্গাচুরা আসবাবপত্র গুড়িয়ে দিলেন। ইউএনও সাহেব আমাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে গেলেন। পুলিশ দিলেন সাথে দুইজন। পরীক্ষা শেষ হল যথারীতি। ২ সপ্তাহ যেতে না যেতেই বদলির নোটিশ পেলাম। সিভিল সার্জন অফিস এ পরিচিত জন থাকার সুবাধে জেলা হসপিটালে এটাচমেন্ট করিয়ে নিলাম। দুমাস যেতে না যেতেই জেলার বাইরে বদলি।  
চট্টগ্রামের বিভাগীয় অফিসে তদবির করিয়ে কোনমতে বদলি ঠেকালাম। ছয় মাসের মাথায় আবার বদলি। একেবারে পাহাড়ী এলাকায়। পানিশমেন্ট বদলি! অথচ জানি না আমার কি অপরাধ ছিল? এইবার আর ঠেকাতে পারলাম না। নিজের যা রাজনৈতিক কানেকশন ছিল তা দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম বদলি ঠেকানোর। সব চেষ্টা বিফলে গেল। "ড্যাবের মেম্বার না হলে বদলি ঠেকানো  যাবে না!" এখনকার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার হান্নান সাহেব (তখন সার্জারী কনসালটেন্ট নোয়াখালী) সেটাই জানালেন। সরকারি চাকুরীর উপর মন উঠে গেল। বুঝে গেলাম আওয়ামীলীগার হিসাবে তকমা লাগানো থাকায় আমি রাজনৈতিক হয়রানির শিকার, যার শুরু হলো মাত্র! অনিশ্চয়তার দোলাচলে চলে এলাম বিদেশ।
 
রাজনীতির আবহে ছোট বেলা থেকে বেড়ে উঠেছি, মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন্তান আমি। আব্বা গণ পরিষদের সদস্য ছিলেন। আমি নিজে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম। ছাত্রলীগ মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি হিসাবে সম্মুখ সারিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্ব দেয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বেগম  জিয়ার আমলে বারবার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছি, তবুও কখনো ছাড়িনি, সেই আমিই কিনা চলে এলাম বিদেশ। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল আমাদের দেশ প্রেম!
 
এটা কি দেশ প্রেম? নাকি এটা প্রশ্নবিদ্ধ দেশপ্রেম? জানি না, তবে বিদেশে থাকি বলে দেশের প্রতি মমত্ববোধ এতটুকুও কমেনি। চিন্তা চেতনা অস্তিত্ব  জুড়েই এখনও বাংলাদেশ। এখনও প্রতিদিন দেশের সংবাদ পড়ি। দেশের দুঃখ ছুঁয়ে যায় হৃদয়। দেশের আনন্দে আপ্লুত হয়। এখানকার কোনো স্টোরে মেড ইন বাংলাদেশ লেখা কোনো কিছু দেখলেই সেটা ছুঁয়ে শুঁকে দেখি আমার দেশের মাটির গন্ধ পাবো  বলে। সারা রাত জেগে দেশের খেলা দেখি। বিদেশের মাটিতে কোনো অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত শুনলে নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে নামে অশ্রুর ধারা। 

-ডাক্তার একরাম চৌধুরী, সহ সভাপতি অস্ট্রেলিয়া আওয়ামীলীগ।


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি