রক্তে ভেজা শাড়ি পরে আসার কথা ছিল না তাঁর
প্রকাশিত : ২০:৪৯, ২০ ডিসেম্বর ২০১৯
অত্যন্ত কাকতালীয়ভাবে আজ ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন এবং একই সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদের যোগ্য সহধর্মিণী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক আহবায়ক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য, ৭৫ পরবর্তীতে এই দলের হাল ধরে দলকে পুনর্জীবন দেয়া মহিয়সী নারী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের প্রয়াণ দিবস।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগের দিনের আওয়ামী লীগ আর পনের তারিখের পরের দিনের আওয়ামী লীগের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। এই তফাৎটা আজকের প্রজন্মের আওয়ামী রাজনীতিকদের উপলব্ধি করাটা বেশ কষ্ট সাধ্য হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পর বাঙালি জাতি যখন দিশেহারা, দেশ ও জাতি যখন কঠিন সঙ্কটে পড়ে ঠিক তখনই এই মহিয়সী নারী ঝাঁপিয়ে পড়েন এদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনর্প্রতিষ্ঠা ও বাংলার ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড গুলোর বিচারের দাবিতে।
তিনি বলেছিলেন, 'আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি, আমার সন্তানেরা এতিম হয়েছে, কিন্তু জাতি হারিয়েছে বঙ্গবন্ধুকে আর জাতীয় চার নেতাকে, আমার ক্ষতির চেয়ে জাতির অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেলো। আর তাই আজ আমি আমার রক্তে মাখা আঁচল নিয়ে আপনাদের কাছে বিচার দিয়ে গেলাম।'
১৮৭৯ সালে সুনামগঞ্জে গিয়েছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মালেক উকিল, আব্দুস সামাদ আজাদ, আব্দুর রাজ্জাক সহ সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। আজকের পৌরবিপনী তখনকার বালুর মাঠের জনসভায় তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন "আমারতো আজ শহীদের রক্তেভেজা সাদা শাড়ি পড়ে এখানে আসার কথা ছিল না।" বলতেই গোটা জনসভায় নেমে আসে পিনপতন নিরবতা। কি আবেগঘন বক্তৃতা। ৭৫ উত্তর কঠিন দুঃসময়ে দলের দায়িত্ব নিজ কাঁদে তুলে নিলেন এই মহিয়সী নারী। তাকে আহবায়ক করেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেস্টায় লিপ্ত হল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই বাংলার পথ-ঘাট, মাঠে ময়দানে তিনি চষে বেড়ালেন। ছুটে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে-টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া। ফিনিক্স পাখির মত এই দলটাকে পুনর্জীবন দান করলেন।
ঘাতকচক্রের বিশ্বাস ছিলো বঙ্গবন্ধুর রক্তের একজনও জীবিত থাকলে আওয়ামী লীগ ৫০ বছর পরে হলেও ঘুরে দাঁড়াবে। তাইতো সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিবারের নারী, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও হত্যা করা হয়েছিল। যাতে করে আওয়ামী লীগ কখনো মেরুদণ্ড সোজা করে আর দাঁড়াতে না পারে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নিহত করার পর এই দলটির বিরুদ্ধে নানান ধরনের কালিমা লেপনের চেস্টা করা হয়েছে। মিথ্যা রটনা রটান হয়েছে। শুধু মাত্র বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে জায়েজ করার জন্যে। বাংলাদেশের জন্মদাতা এই দলটিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ ইসলামের শত্রু, আওয়ামী লীগ বাকশাল করেছে, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেনা ইত্যাদি ইত্যাদি বদনাম করা হয়েছে। এখানে ছোট একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। জেল হত্যাকাণ্ডের পর তাজউদ্দীন আহমেদের লাশ যখন লোকজন দেখতে আসছিলেন। সেখানে ভিড়ের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করছিলেন, আচ্ছা তাজউদ্দীন আহমেদের যে ছেলেটা হাইজ্যাক করে, ব্যাংক লুট করে সে কোথায়? অতচ শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদের একমাত্র ছেলের বয়স তখন ৪/৫ বছর। তাঁর জন্ম হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। তাজউদ্দীন আহমেদের কন্যা শারমিন আহমেদের লেখা 'জেল হত্যার পুর্বাপর' বইতে এই ঘটনার বিস্তারিত আছে। মিথ্যাচার, অপপ্রচারের এমন কঠিন দিনে সর্বপ্রথম আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন।
অনেকে ধারণা করেছিলেন সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও জেলে জাতীয় চারনেতাকে হত্যার পর আওয়ামী লীগ আর আলোর মুখ দেখবে না; জোহরা তাজউদ্দীন তাদের সেই স্বপ্নে ছাই ঢেলে দিয়েছিলেন। ৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রথম জাগরণ ঘটালেন, বাঙালির নিদ্রা ভাঙালেন জোহরা তাজউদ্দীন। প্রচণ্ড কোনঠাসা, বিপর্যয়, সাংগঠনিক সমন্বয়হীনতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে জোহরা তাজউদ্দীন তাঁর নেতৃত্বে দলকে পুনরায় বাংলাদেশ-এর জনগণের কাছে মেলে ধরলেন। আওয়ামী লীগের কালবেলার অন্যতম স্তম্ভ জোহরা তাজউদ্দীন ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দলের হাল শক্তহাতে ধরেছিলেন বলেই আওয়ামী লীগ টিকে ছিলো, মরে যায়নি।
বাংলাদেশের সেরা নারী নেতৃত্বের তালিকায় চিরভাস্বর হয়েই থাকবেন তিনি; অন্যান্য সবার চাইতে অগ্রগামী থাকবেন তিনি এতে কোনো সন্দেহ নেই। এতকিছুর পরেও নতুন প্রজন্ম তাঁকে জানলোই না কখনো; আড়ালেই থেকে গেলেন সারাটা জীবন। আজ আমাদের প্রিয় এই অবিভাবক জোহরা তাজউদ্দীনের মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর আজকের এই দিনে অচীন গন্তব্যের পথে হেঁটেছিলেন তিনি। অন্য আলোয় ভালো থাকুন, পরম শান্তিতে। বাংলাদেশ আপনাকে আজীবন মনে রাখবে।
লেখক; কলামিস্ট, ছাত্রনেতা।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।