কালের আয়নায়
ছবি ও ভাস্কর্যে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাওয়া যাবে না
প্রকাশিত : ১২:২৯, ১১ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১২:৩৫, ১১ জানুয়ারি ২০২০
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- ফাইল ছবি
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন। সেদিন আমি ঢাকায় ছিলাম না। কিন্তু টেলিভিশনে দেখা সেই দৃশ্যটি এখনও আমার চোখে ভাসে। খোলা ট্রাকে বঙ্গবন্ধু। তাকে ঘিরে তার অসংখ্য অনুসারী। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, গাজী গোলাম মোস্তফাকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। বিমানবন্দরে লাখ লাখ লোকের জমায়েত হয়েছিল। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু মাঝেমধ্যে কাঁদছেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ১৯৪৪ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শহরে। নাৎসিদের পরাজয়ে প্যারিস মুক্ত হয় এবং মুক্ত প্যারিসে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রবেশ করেন লিবারেশন ফোর্সের প্রধান নেতা জেনারেল দ্য গলে। লাখ লাখ মানুষ জমায়েত হয়েছিল দ্য গলকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য। তারা জয়ধ্বনি দিয়েছিল, ভিভালা ফ্রান্স (ফ্রান্স বেঁচে থাকুক)। ১৯৭২ সালে ঢাকার জনতা মুক্তিযুদ্ধের নায়ক বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে স্বাগতম জানিয়ে জয়ধ্বনি দিয়েছিল জয় বাংলা (বাংলাদেশের জয় হোক)।
বঙ্গবন্ধুর সেই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ৪৮ বছর কেটে গেছে। প্রতি বছর এই দিনটি তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়। ২০২০ সালে এই দিবসটি পালনের বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য অনেক। এই বছরটি তার জন্মশতবার্ষিকী পালনের বছর। হাসিনা সরকার এই বছরটিকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করে শুধু দেশে নয়, প্রায় সারাবিশ্বে এই দিবসটি বিশালভাবে পালনের আয়োজন করেছে। স্বাভাবিকভাবেই মুজিববর্ষের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালনের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব আলাদা। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অর্থ, শুধু একজন মানুষের বিদেশ থেকে স্বদেশে ফিরে আসা নয়; একটি বিজয়ী আদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শনের তার মানুষের কাছে ঘিরে আসা। এই আদর্শ ও বিশ্বাসের চূড়ান্ত জয় এখনও হয়নি। তাই বঙ্গবন্ধুকে তার দেশ ও জাতির কাছে বারবার ফিরে আসতে হয়।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যখন ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল, তখন বিদেশে থাকলেও আমার মনে এই বিশ্বাসটা জাগ্রত ছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে আসবেনই। তখন একটা কবিতা লিখেছিলাম। তার প্রথম দুটি লাইন হলো : 'বঙ্গবন্ধু আবার যখন ফিরবেন/পদ্মাপাড়ে নৌকা করে ভিড়বেন...।' লন্ডনের খ্যাতনামা বাঙালি সুরশিল্পী হিমাংশু গোস্বামী এই কবিতায় সুরারোপ করে গানে পরিণত করেছেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়ে থাকেন।
বঙ্গবন্ধু প্রথম দেশে ফেরেন ৪৮ বছর আগে (১০ জানুয়ারি ১৯৭২) পাকিস্তানের কারাগার থেকে। সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার সংগ্রামে লিপ্ত থাকার সময় তাকে হত্যা করা হয়। কেবল তাকে হত্যা করেই দেশি-বিদেশি ঘাতকের দল নিশ্চুপ থাকেনি। বাংলাদেশের স্রষ্টাকে তার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণ, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান জয় বাংলা উচ্চারণ ছিল মানুষের জন্য বিপজ্জনক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির পালা শুরু হয়েছিল। এক খলনায়ককে বঙ্গবন্ধুর স্থলাভিষিক্ত করে জাতির ত্রাতা সাজাবার চেষ্টা হয়েছিল। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রকে আবার সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার আয়োজন চলছিল। স্বাধীনতার শত্রু ঘাতকের গাড়িতে উড়েছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী- ফাইল ছবি
স্বাধীন বাংলাদেশকে এই অন্ধকারের ইতিহাস থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে নেতৃত্বদানের জন্য আবার বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরে আসা প্রয়োজন ছিল। এবারও ২১ বছর পর তিনি ফিরে এসেছেন। আগেরবার তিনি ফিরে এসেছিলেন নশ্বর দেহ নিয়ে। জীবিত মানুষরূপে ফিরে এসেছিলেন তার মানুষের কাছে। দ্বিতীয়বার তিনি দেহধারী হয়ে ফিরে আসতে পারেননি। এসেছেন অবিনাশী, অমিতায়ু একটি আদর্শের প্রতিভূ হয়ে। এখন বঙ্গবন্ধু নিজের অধিকারে অধিষ্ঠিত ইতিহাসের আসনে। আজ বঙ্গবন্ধু কোথায় নেই? টেলিভিশনে, বেতারে, খবরের কাগজের পাতায়, পাঠ্যবইয়ে, ডাকটিকিটে, সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের নামে, রাস্তার নামে, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ইউনিভার্সিটির নামে। বাংলাদেশে এখন চোখ খুললেই বঙ্গবন্ধু। দেশের তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী তার কন্যা শেখ হাসিনা। দেশে বিরোধী দল নেই বললেই চলে। দ্বিতীয় দফা গণমুক্তির আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অশরীরী নেতৃত্বদান ব্যর্থ হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয়বারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শরীরী প্রত্যাবর্তন ছিল না, ছিল তার অবিনাশী, অশরীরী আদর্শের প্রত্যাবর্তন। যে আদর্শের ডাকে মানুষ আবারও সাড়া দিয়েছে। স্বাধীনতার শত্রুরা আগে রণক্ষেত্রের যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। কিন্তু রাজনীতির যুদ্ধে পরাজিত হয়নি। এবার তারা রাজনীতির যুদ্ধেও পরাজিত। যদিও চূড়ান্ত যুদ্ধে এখনও তাদের পরাজয় হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী মহাসমারোহে পালনের ব্যবস্থা করেছে। বঙ্গবন্ধুর নাম আর ছবিতে ভরে দিয়েছে সারাটা দেশ।
এখানেই কথাটা ওঠে, ছবি ও ভাস্কর্য কি কখনও অক্ষয়-অব্যয়? যদি তার পেছনে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা না যায়? এই প্রাণ হলো আদর্শ। এই আদর্শ ছাড়া কেবল ভাস্কর্য ও ছবি কোনো দেশ ও জাতিকে প্রেরণা জোগাতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয়বারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন যাতে ব্যর্থ না হয়, সে জন্য আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ প্রভৃতি সব দল ও সহযোগী দলের উচিত ছিল, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তরুণ প্রজন্মকে দীক্ষিত করা; তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন মজবুত করা। কেবল নাম প্রচার, নামের ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় নয়। বঙ্গবন্ধু যদি স্কুল-কলেজে, পাঠ্যপুস্তকে মুখ লুকিয়ে থাকেন, তাহলেও তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে একটি শোষণ, অত্যাচার, দারিদ্র্যবিহীন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের আদর্শ রূপায়ণের মধ্যে। আওয়ামী লীগ সেই আদর্শ রূপায়ণের পথে এক পা এগোতে পেরেছে কি?
একটা মজার গল্প বলি। ১৯৭৮ সালে আমি লন্ডন শহরে ছিলাম। এখন যেমন আছি। এক সভায় গিয়েছিলাম। সেখানে বাংলাদেশের এক যুবা বয়সী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা হলো। তিনি জিয়াউর রহমানের সমর্থক। বঙ্গবন্ধুকে স্বৈরাচারী, দুর্নীতিপরায়ণ বলে সমালোচনা করলেন। জিয়াউর রহমানকে মডার্ন মিলিটারি লিডার বলে প্রশংসা করলেন। আমাকে বললেন, 'শুনছি, আপনারা বিদেশে বসে মুজিবের নাম ভাঙিয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। মুজিবের নাম ভুলে যান। মুজিব এখন অতীত। সামনের দিকে তাকান।'
তখন মুজিব অনুসারীদের বড় দুর্দিন। তাই তার কথার কোনো জবাব দিইনি। তারপর বহু বছর কেটে গেছে। এ বছর ডিসেম্বর মাসের কথা। আমি ঢাকায় গেছি এবং বন্ধুবর মোনায়েম সরকারের চামেলীবাগের বাসায় অবস্থান করছি। বহু লোকজন দেখা করতে আসেন। একদিন মুজিব কোটধারী এক ব্যক্তি এলেন। হাতে গোলাপ ফুল। আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালেন। দেখেই চিনলাম। ১৯৭৮ সালে লন্ডনে দেখা সেই রাজনীতিক।
আমি কথা বলার আগেই তিনি বললেন, আপনি তো জানেন, আমি চিরকাল বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করে আমার সারাটা জীবন গেল। এবার এমপি হওয়ার জন্য নমিনেশন চেয়েছিলাম, পাইনি। আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আপনি নেত্রীকে বলে আমাকে আওয়ামী লীগের একটা কাউন্সিলর পদ পাইয়ে দিন। আমি দেশ এবং দলের জন্য একটু কাজ করতে চাই।
তাকে বললাম, 'শেখ হাসিনা আমার কথা শোনেন, আপনাদের এই ধারণা ভুল। আমি আপনার অনুরোধ রাখতে পারব না।' আমি তার অতীতের কথা আর স্মরণ করিয়ে দিলাম না। তিনি আমাকে আমতা আমতা করে বললেন- কিন্তু শুনেছি, শেখ হাসিনা আপনার কথা শোনেন। অনেকে তাই বলেন। বললাম, অনেকেই ভুল জানে ও বলে। সেটাই আমার জীবনের ট্র্যাজেডি। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার মতো আওয়ামী লীগার দলে কতজন আছেন? তিনি আমার ঠাট্টাটা বুঝতে পারেননি। বললেন, অনেক আছে। কেন, সারাদেশের মানুষই এখন আওয়ামী লীগার।
তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, খোদা না করুন, '৭৫ সালের মতো কোনো অঘটন ঘটলে কতজন আওয়ামী লীগার থাকবে? তিনি এবার আমার কথার বিদ্রূপ বুঝতে পেরে চুপ করে রইলেন। কথায় বলে, 'বর্ষায় কই মাছ উজায়।' বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য কথাটা সঠিক। আদর্শবিহীন রাজনীতিতে রাতারাতি সমর্থকদের ভিড় জমে। তারপর ক্ষমতাহীনদের পাশ থেকে তারা সুখের দুপুরের ঘুঘুর মতো উধাও হয়ে যায়। সে জন্যই বঙ্গবন্ধু বলতেন, 'আমি হাজার হাজার সুবিধাবাদী সমর্থক চাই না। দশজন আদর্শনিষ্ঠ কর্মী চাই।' এ ধরনের আদর্শনিষ্ঠ কর্মী ও নেতা বঙ্গবন্ধু তৈরি করতে পেরেছিলেন বলেই আওয়ামী লীগ এখনও দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে আছে। কোটি লোক বঙ্গবন্ধুকে এখনও স্মরণ করছে।
ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানী জনগণের নেতা হয়েও এই আদর্শনিষ্ঠ কর্মী ও নেতা তৈরি করে যাননি বলে হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক পার্টি এবং মওলানা সাহেবের ন্যাপ বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৃত পার্টি। ভাসানী ন্যাপের অধিকাংশ নেতাকর্মী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বিএনপিতে যোগ দিয়েছে এবং মওলানা সাহেবের নাম ভুলে গেছে। অনেকেই এখনও ঘরে বা অফিসে হক সাহেব ও মওলানা সাহেবের ছবি টাঙিয়ে রাখেন। কিন্তু সেই ছবির অবস্থা এখন, 'তুমি কি কেবলই ছবি/শুধু পটে লিখা?'
আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সরকার মহাসমারোহে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করছে। ১০ জানুয়ারি শুক্রবার ২০২০ তার ৪৮তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসও পালিত হয়েছে। এত আড়ম্বরের মাঝে কি বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাওয়া যাবে? বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যাবে তার আদর্শ ও কর্মের মধ্যে। তিনি তো একবার নয়, দু'বার স্বদেশে ফিরেছেন। তার আদর্শ, সংগ্রাম ও সাধনার একটা আদর্শলিপি আছে। সেই আদর্শলিপি আমরা ক'জন পাঠ করি, স্মরণ করি! বঙ্গবন্ধুকে ছবিতে বা ভাস্কর্যে পরিণত করলে আসল মুজিব, মানুষ মুজিবকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
লন্ডন। ৯ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার), ২০২০
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।