বঙ্গবন্ধু ও অসমাপ্ত আত্মজীবনী
প্রকাশিত : ২১:০৭, ৩১ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ২২:৩৭, ৩১ জানুয়ারি ২০২০
রাজনীতির মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি ২০১২ সালে প্রথমবার তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গোগ্রাসে পড়েছিলাম।
আজ ছয় বছরে প্রায় শতাধিকবার একই পঠিত বিষয় আবারও পাঠ করে চলেছি। আমার কাছে এ মুহূর্তে কেউ যদি জানতে চায় কোন্ পাঁচটি বইকে আমি শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে আমার হৃদয় ও মস্তিষ্কে ধারণ করে আছি, এক কথায় বলব, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইখানি অন্যতম।
কারণ জানতে চাইলে অবশ্যই বলব, একজন মানুষ কিভাবে বেড়ে উঠেছেন, জেল-জুলুম-নির্যাতন কোন কিছুই দমাতে পারেনি, স্নেহবৎসল পিতা এবং স্বামী হয়েও দেশ ও দশের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষার অভাব বোধ করেননি। সবকিছুর ওপরে ছিল দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের জন্য অকৃত্রিম কিছু করার প্রবল বাসনা।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়তে পড়তে বারবার ডুবে যাই শৈশব-কৈশোর-যৌবন-যেখানে বাধা, সেখানেই ন্যায়ের পথে পরিচালিত হয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর জীবনে তাঁর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছার অবদান কতখানি এটি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনীগ্রন্থের প্রারম্ভের দ্বিতীয় ও তৃতীয় লাইনে- ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেল গেটে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবন কাহিনী’ (পৃঃ ১)।
আসলে প্রত্যেক সৃষ্টিশীল পুরুষের জীবনে একজন অসামান্য সমার্থক ব্যক্তি থাকেন। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, যার ডাকনাম ছিল রেনু। সর্বদা সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। ব্যক্তিগত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠে কিভাবে জীবনকে মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করতে হয় তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে গ্রন্থখানিতে।
১৭ মার্চ, ২০২০ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ১০০ তম জন্মশতবার্ষিকী। ইতোমধ্যে মুজিব শতবর্ষের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে। আবার যখন পড়তে বসেছি আত্মজীবনীখানি মনে পড়ে যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ১৪০০ সাল কবিতাখানি- যার কয়েকটি চরণ হচ্ছে : ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে/কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/কৌতূহলভরে,/আজি হতে শতবর্ষ পরে।’... যদিও এখন বাংলা ১৪২৬ সন, তারপরও রবীন্দ্রনাথ এখনও আমাদের কাছে শ্রদ্ধেয়।
অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শ্রদ্ধা, ভালবাসায় প্রতিটি বাঙালির কাছে পূর্ব-বর্তমান-ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মানবদরদী, একটি জাতির মুক্তির দিশারি হিসেবে বিবেচিত হবেন। বঙ্গবন্ধু আলোচ্য গ্রন্থে মানুষের প্রতি, জনগণের দরদী হিসেবে নির্মোহ ভঙ্গিতে যতখানি লিখে গেছেন, মানুষের জন্য তাঁর যে বিশেষ দিকনির্দেশনা, করণীয়, কর্মকাণ্ড, বিভিন্নভাবে উপকার সাধনে ব্যাপৃত হওয়া নিয়ে তার আমিত্ব কখনও ফলাতে যাননি।
বরং সাধারণের ভাগ্য উন্নয়নই যে তাঁর লক্ষ্য, সে বিষয়টি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। অনেক সাধারণ নেতাকর্মী যারা বেশি আত্মম্ভরি হয়ে গেছে তাদের বঙ্গবন্ধুর জীবনী থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। বইটির সূচনাতেই বঙ্গবন্ধুর লেখায় যে উদ্ধৃতি রয়েছে সেটি তুলে ধরছি : ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।
এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ আসলে মানুষের কল্যাণ সাধনে যে রাজনীতিবিদ নিরন্তর প্রয়াসে যুক্ত হন তিনি সবসময়ই কল্যাণকামী ও মানবদরদী রাজনীতিবিদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। আর তাঁর সমগ্র সত্তায় বাঙালির প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ, স্নেহান্ধ পিতার মতো প্রত্যেক বাঙালিকে তিনি দিতে চেয়েছেন কেবল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, বরং অর্থনৈতিক মুক্তি।
আজকে বঙ্গবন্ধুর সেই কষ্ট জর্জরিত অর্থনৈতিক মুক্তির প্রয়াস গ্রহণ করেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অমিত বিক্রম তেজদীপ্ত উন্নয়ন প্রয়াস, বাঙালীর প্রতি শাশ্বত আস্থা, দ্বিধাহীন চিত্তে কর্মনিষ্ঠা এবং অবিচল থেকে বাঙালির সেরা সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর ধ্যান-জ্ঞান। রাজনীতির মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ানো অমিত নেতৃত্ব প্রদানকারী ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান এক প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষ হিসেবে চিরভাস্বর ও দেদীপ্যমান।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘পাকিস্তান দুটোই হবে, লাহোর ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, আর একটা ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে। অন্যটা হবে হিন্দুস্তান (পৃঃ ২২)।’
ঐতিহাসিক তাৎপর্যমন্ডিত ঘটনার বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধু নির্মোহ ভঙ্গিতে ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্বেকার পরিপ্রেক্ষিতটি বিধৃত করেছেন। বস্তুত তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকবর্গ ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই পূর্ব পাকিস্তান তথা আমাদের এ বাংলাদেশকে দ্বিতীয় উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তুলে শোষণ-বঞ্চনা ও পুঁজি পাচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।
তৎকালীন যে সমস্ত ভুঁইফোঁড় ব্যক্তি শোষণ-বঞ্চনা করত তাদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : ‘এই সমস্ত খান বাহাদুরদের দ্বারা পাকিস্তান আসবে, দেশ স্বাধীন হবে, ইংরেজকে তাড়ানোও যাবে, বিশ্বাস করতে কেন যেন কষ্ট হতো (পৃঃ ৩৫)।’ আসলে সে সময়কার প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ খান বাহাদুর মোসাহেবী চরিত্র ছাড়তে পারেননি। এ ধরনের গিরগিটির মতো মোসাহেব চরিত্র এখনও বিদ্যমান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথার্থই মন্তব্য করেছিলেন, ‘পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে (পৃঃ ৪৭)।’ তাঁর আত্মজীবনীতে এই মন্তব্যখানি সর্বজনবিদিত। কেননা বাংলাদেশে দরকার হলে পরের নাক কেটে যাত্রা ভঙ্গ করতে লোকের অভাব হয় না।
আবার বঙ্গবন্ধু যখন লেখেন, ‘পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল (পৃঃ ৭৫)।’ আসলে পাকিস্তানের ইতিহাস ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রাজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, ‘নাজিমুদ্দীন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়েই ঘোষণা করলেন, ঢাকা রাজধানী হবে এবং তিনি দলবলসহ ঢাকায় চলে গেলেন।
একবার চিন্তাও করলেন না, পশ্চিম বাংলার হতভাগা মুসলমানদের কথা (পৃঃ ৭৮)।’ ক্ষমতালোভী ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে সিদ্ধহস্ত নাজিমুদ্দীন আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের পদলেহী ছিলেন। নাজিমুদ্দীনের হঠকারী সিদ্ধান্তে সেদিন ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আজও কিছু এরকম রং পাল্টানো ডিগবাজি ব্যক্তি রয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, আইন পড়ব (পৃঃ ৮৭)।’ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের পটভূমিকা বলতে গিয়ে জনগণের সেই যে বাস্তবতা সে সম্পর্কে তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন শোনা যায়, ‘এখনও সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু যে কথাটি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বলেছিলেন, আমার মনে হয়, ২০২০ সালেও গুটিকয়েক সিনিয়র নেতা-নেত্রী, যাদের মধ্যমণি আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী বোঝেন, তা কিন্তু দলের ও অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী বুঝতে চান না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোয় তারা আলোকিত হন। বঙ্গবন্ধুর জীবনীতে দেখা যায়, তিনি তাঁর জীবনে একজন দক্ষ রাজনৈতিক উদ্যোক্তার মতো ঝুঁকি নিয়েছেন, নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে ভালবেসেছেন এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা বইটি পড়তে পড়তে তাঁর পাণ্ডিত্য, শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সম্মিলন দেখা যায়। যেটি স্বয়ং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কয়জনের মাঝে পাওয়া যায় সেটি দেখা দরকার। একজন নেতা-নেত্রীকে জনগণের বাস্তবতা বুঝতে হবে। পাশাপাশি জ্ঞান আহরণ ও তার বিকাশ সাধনে সচেষ্ট হতে হবে।
পৃষ্ঠা ৯১ তে দেখা যায় : ‘মুসলিম লিগ নেতারা উর্দুতেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। ... কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক।’ আসলে বইটি যেন সে সময়ের স্থিরচিত্র সমাজ দর্পণরূপে প্রতিভাত হয়ে ওঠে।
তিনি লিখেছেন যে, জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড়দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে (পৃঃ ৯৯)।’ বস্তুত এ বইটি শতাধিকবার পড়লেও মনে হয় এত স্বচ্ছ ভাষায় ইতিহাসকে ধরা কেবল একজন পন্ডিত ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব, যিনি নিজে ছিলেন এক জীবন্ত ইতিহাস। আমার কেন জানি মনের কোলে উঁকি দেয়, যারা বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন ও বড় পদে অধিষ্ঠিত হবেন, তারা কতটুকু বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এবং তাঁর দুটো গ্রন্থ সম্পর্কে জানেন। তার একটি পরীক্ষা কি আগামীতে নেয়ার ব্যবস্থা করা যায়?
বঙ্গবন্ধু যখন দেখলেন পাকিস্তানীরা দেশকে ভুল পথে পরিচালিত করছে, তখন তিনি প্রতিবাদ করতে শুরু করেন, ‘দুর্নীতি বেড়ে গেছে, খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে (পৃঃ ১২৬)।’ যে ছাত্রলীগ তার হাতে প্রতিষ্ঠিত, যেহেতু ছাত্রত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে সেজন্য নির্দ্বিধায় তিনি বলেছেন, ‘আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকব না (পৃঃ ১২৬)।’ বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত উঁচুমানের রাজনীতিক ছিলেন বলেই প্রত্যেক কর্মী ও নেতার কথা জিজ্ঞেস করলেন। পূর্ব বাংলার অবস্থা কি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাও জিজ্ঞেস করলেন।
বাংলাকে তিনি গভীরভাবে ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার মধ্যেও তা গভীরভাবে প্রোথিত। কিন্তু কয়জন নেতা-নেত্রী এ ধরনের রাজনৈতিক চর্চা করেন, সেটি দেখা দরকার। তারাই ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব লাভ করেন। যারা ত্যাগী নেতাকর্মীদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন, দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারের জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন, নিজেকে শক্ত করেছেন, কঠিন ইস্পাত সঙ্কল্পে নিজেকে গঠন করেছেন, তা তাঁর জীবনীতেই ফুটে উঠেছে। ‘ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবু তো যেতে হবে (পৃঃ ১৬৪)।’ আসলে সমগ্র পূর্ববঙ্গ ও তার মানুষকে নিয়ে যাঁর হৃদয় নিংরানো ভালবাসা তিনি শত চেষ্টা করেও পরিবারকে সময় কম দিতে বাধ্য হয়েছেন। কর্তব্যকর্মই যে সর্বাগ্রে তাঁর কাছে প্রাধান্য পেয়েছে।
সর্বজনের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা তাঁকে ঘিরে ভাস্বর থাকবে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে তিনবার জেলে যেতে হয়েছে। খাপড়া ওয়ার্ডে সংঘটিত ঘটনার বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন- ‘১৯৫০ সালে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে খাপড়া ওয়ার্ডের কামরা বন্ধ করে রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর গুলি করে সাতজনকে হত্যা করা হয়। যে কয়েকজন বেঁচে ছিল তাদের এমনভাবে মারপিট করা হয়েছিল যে, জীবনের তরে তাদের স্বাস্থ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল (পৃঃ ১৭২)।’
বঙ্গবন্ধুর জীবনে তাঁর স্ত্রীর ভূমিকা যে কত গভীর বইয়ের বিভিন্ন পাতায় তা বিধৃত হয়েছে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের একটি উক্তি আমি উদ্ধৃতি দিচ্ছি : রেনু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, ‘জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে (পৃঃ ১৯১)।’
আসলে বঙ্গবন্ধুর সাফল্যের পেছনে বঙ্গমাতার প্রচুর অবদান, ত্যাগ-তিতিক্ষা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আরেকটি উক্তি আমার মনে ভীষণ দাগ কাটছে, ‘জনগণের আস্থা হারাতে শুরু করেছিল বলে আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল মুসলিম লীগ নেতারা (পৃঃ ১৯৮)।’ অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে অনশন করে তিনি আপোসহীন মুক্তি আদায়ে সক্ষম হন। তিনি যখন বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেন, আজকের প্রধানমন্ত্রী সেদিন তাঁর গলা ধরে প্রথমেই বলেছিলেন, ‘আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই (পৃঃ ২০৭)।’
নিজের জীবন দেশমাতৃকার মঙ্গল যাচনায় উৎসর্গ করতে গিয়ে ছোট ছেলেমেয়েরা তাঁকে প্রায় ভুলতে বসেছিল। এ যেন বিষাদ গাথা- বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘এক সময় কামাল হাসিনাকে বলছে ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি (পৃঃ ২০৯)।’
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুন্দরভাবে চীন ভ্রমণের কথাও বলেছেন, পথিমধ্যে রেঙ্গুন, ব্যাঙ্কক এবং হংকংয়ে যাত্রাবিরতির কথাও বিধৃত করেছেন। বঙ্গবন্ধু যথাযর্থই লিখেছেন, ‘এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর শোষণ বন্ধ হতে পারে না (পৃঃ ২৩৪)।’ বঙ্গবন্ধুর যে উপলব্ধি সেদিন ছিল তা আজও সমাজ ব্যবস্থায় অনেকাংশে বিদ্যমান। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির মধ্যে বর্তমানে পার্থক্য থাকলেও শোষণ-বঞ্চনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে, কালে কালে বহমান। দেশভেদে শোষকের পরিবর্তন হয়ে থাকে মাত্র।
পাকিস্তানীরা এ অঞ্চলকে বানিয়ে ফেলেছিল শোষণের ক্ষেত্র। এজন্যই লেখক যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘এদিকে পূর্ব বাংলার সম্পদকে কেড়ে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে কত তাড়াতাড়ি গড়া যায়, একদল পশ্চিমা তথাকথিত কেন্দ্রীয় নেতা ও বড় বড় সরকারি কর্মচারী গোপনে সে কাজ করে চলেছিল (পৃঃ ২৪০)।’
ইমানুয়েলের ভাষায় বলতে হয় আন ইকুয়েল এক্সচেঞ্জ। এদেশ থেকে অর্থ ও পুঁজি পাচারই ছিল পশ্চিমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তিনি আরও মন্তব্য করেছেন- ‘অন্যদিকে পূর্ব বাংলার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে প্ল্যান প্রোগ্রাম করেই পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে লাগল (পৃঃ ২৪১)।’ এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের তোষণনীতি সম্পর্কেও তিনি লিখেছেন। বাঙালিও অবাঙালিদের মধ্যকার দাঙ্গার সময় বঙ্গবন্ধু যেভাবে দুঃসাহসিকতার সঙ্গে দাঙ্গা দমনে সচেষ্ট ছিলেন তা অত্যন্ত দুর্লভ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তাঁর অপরিসীম প্রজ্ঞা, মেধা ও মননের পরিচয় পাওয়া যায়। নবীন রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, উন্নয়ন সংগঠকদের জন্য গ্রন্থটি অবশ্য পাঠ্য। ইদানীং অনেকেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে চান না। মুজিববর্ষের কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল হৃদয়ের নেতার মধ্যে মানুষের প্রতি যে ভালবাসা ছিল সেটি তাঁকে অমরতার বরপুত্র হিসেবে পরিগণিত করেছে।
যারা শর্টকাটে নেতা-নেত্রী হতে চান, সেটি বাদ দিয়ে জনগণের সেবক হতে চান, তাদের অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর মতো দূরদর্শীসম্পন্ন, সত্য অনুসন্ধানী এবং কর্মের দেদীপ্যমানতায় উজ্জ্বল হতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে অন্তর্লীন সত্তায় ধারণ করতে হবে। একজন নবীন রাজনৈতিক কর্মী তখনই কেবল সাফল্য লাভ করবে, যখন প্রলোভনমুক্ত হয়ে, ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত থেকে বিনয়ের সঙ্গে জনসেবা করবে। যে পথ অত্যন্ত বন্ধুর ও কণ্টকাকীর্ণ।
লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট এবং প্রফেসর
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।