ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও মুজিব বর্ষ প্রসঙ্গ

ড. এ কে আব্দুল মোমেন

প্রকাশিত : ২২:০৪, ৩১ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ২২:৫৫, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

ড. এ কে আব্দুল মোমেন

ড. এ কে আব্দুল মোমেন

বাঙালী জাতির ইতিহাসে জঘন্যতম এক কলঙ্কের দিন ১৯৭৫-এর ১৫ অগস্ট। এ দিন মধ্যরাতে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালী জাতি সত্তার মুক্তির রূপকার, স্বাধীনতার রচয়িতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে কুচক্রীর দল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে সঙ্গেই ভিন্ন পথচলা শুরু হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। মুখ থুবড়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রশাসন থেকে রাজনীতি সব জায়গায় জেঁকে বসে পাকিস্তানী প্রেতাত্মাদের ভূত। জাতির জনককে হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশ বেতার হয়ে গিয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধে রণধ্বনী জয় বাংলা বদলে যায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদে। বছর না ঘুরতে জেলখানা থেকে স্বদম্ভে বেড়িয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, যাঁরা বিশ্বাস করতেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে তাঁদের জন্য শুরু হয় অন্ধকার কাল। ১৫ অগস্ট হত্যাকান্ডের পর থেকেই একটানা চেষ্টা চলে বঙ্গবন্ধুকে ভুলিয়ে দেওয়ার। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম। আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরে চলে ধারাবাহিক নির্যাতন। জঘন্যতম এ হত্যাকান্ডে বিচার তো দূরের কথা এর প্রতিদান স্বরূপ নানাভাবে পুরস্কৃত করা হয় বঙ্গবন্ধুর খুনীচক্রকে। বিভিন্ন দূতাবাসে তাদের চাকুরি দেয়া হয়। সেই সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতির কাছে পাকিস্থানী মন্ত্রণালয় হিসেবে চিহ্নিত হয়।

১৯৭৬ সালের ৮ জুন ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডে সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়ে অভিযুক্ত হত্যাকারী গোষ্ঠীর ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। লে. কর্নেল শরিফুল হককে (ডালিম) চীনে প্রথম সচিব, লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, কর্নেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব, লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব, লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচানোর জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্ব-ঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ (যিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন) ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর আছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালযয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশে যা বলা হয়েছিল, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ, ও অন্যান্য আইন, এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোনো ফরমান দ্বারা এই সংবিধানের যে সকল সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে তাহা, এবং অনুরূপ কোনো ফরমান, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ বা অন্য কোনো আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত ক্ষমতাবলে, অথবা অনুরূপ কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া বা অনুরূপ বিবেচনায় কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোনো আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোনো দন্ডাদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ, অথবা প্রণীত, কৃত, বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তদসম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকান্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন। ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনিদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার কার্য শুরু হয়।

১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ নানা কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় প্রদান করে। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ বজায় রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। পরে হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ আবারও বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।

২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর- ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ঐ দিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। এ রায় কার্যকরের মাধ্যমে হত্যকাণ্ডের দীর্ঘ ৩৫ বছর পর জাতির পিতার খুনের দায় একটু হলেও মোচন করার প্রয়াস পাওয়া যায়।

৫ আসামীর রায় কার্যকর করা হলেও বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের ৬ জন এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দন্ডিত অপরাধীরা পালিয়ে আছে বিদেশে। দন্ডিত পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানো হচ্ছে। একটু সময় লাগলেও ঠিকই তাদের ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করা হবে। কোনো অবস্থাতেই তাদেরকে রেহাই দেওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমান সরকার সকল খুনিদের বিচার কার্যকর করাতে বদ্ধপরিকর। শুধু বিচারই নয়, খুনিদের সব সম্পদও বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর পাশাপাশি যারা এ হত্যাকান্ডের নেপথ্যের শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন, সেই কুশীলবদের শনাক্ত করতে একটি কমিশনও গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর জেলহত্যার তদন্ত করবে এ কমিশন।
দন্ডিত খুনিদের মধ্যে ৪ জনের অবস্থান এখনো শনাক্ত করা যায়নি। 

পলাতক আসামিরা হলেন- খন্দকার আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী, আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার (ক্যাপ্টেন) মোসলেহ উদ্দিন। ১৯৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত ২১ বছরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খুনিরা নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার সুযোগ পেয়েছে। খুনিদের অনেক তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। তাই পলাতকদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। একটু সময় লাগতে পারে, তবে অবশ্যই খুনিদের ফেরত আনা হবে। কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকে ফেরাতে কূটনৈতিক ও আইনি তৎপরতা অব্যাহত আছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরাতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। 

আমেরিকান এক ভদ্রলোক খুন করে কানাডায় পালিয়ে যায়। সে টেক্সাসের বাসিন্দা ছিল বলে জানা যায়। টেক্সাসের গভর্নর কানাডার কাছে সে ব্যক্তিকে দেশে ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ জানায়। কিন্তু টেক্সাসে মৃত্যুদন্ড পদ্ধতি কার্যকর আছে। কারও মৃত্যুদন্ড শাস্তি থাকলে সে দেশে কানাডা লোকজনকে ফেরত পাঠায় না। পরে ওয়াশিংটন স্টেটের কর্তৃপক্ষ কানাডার কাছে আবেদন করে সেই খুনি ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কানাডা এবার রাজি হয়ে যায়, কারণ ওয়াশিংটন স্টেটে খুনিদের মৃত্যুদন্ডের বিধান নেই। ওয়াশিংটন স্টেটে সেই ব্যক্তিকে ফিরিয়ে এনে টেক্সাসের হাতে তুলে দেয়। পরে তার ফাঁসি দন্ড কার্যকর করা হয়। ইউরোপও কয়েকটি দেশে এমন আইন রয়েছে। কানাডায় বিভিন্ন দেশের খুনিরা আশ্রয় নেয়। আর কানাডা চায় না, যত অপরাধীই হোক না কেন, কারও মৃত্যুদন্ড কার্যকর হোক। তবে টেক্সাস আর ওয়াশিংটন স্টেটের ওই ঘটনার ফলে আমাদেরও একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। কানাডা থেকে খুনি নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার। কানাডার কাছে ফিরিয়ে নেওয়ার আবেদন জানালে তারা আমাদেরও জানিয়েছে যদি মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা না হয় , তবে তারা ফিরিয়ে দিতে রাজি। সমস্যা হলো এরই মধ্যে আমাদেরও আদালত তাকে মৃত্যুদন্ড ঘোষনা দিয়েছে।

তবে ফেরানোর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হত্যার পলাতক খুনিদের মানসিকভাবে শাস্তি দিতে তাদের বাড়ির সামনে প্রবাসীদের নিয়মিত আন্দোলন অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নিতে পারে।  কানাডার নূর চৌধুরী আর আমেরিকায় রাশেদ চৌধুরীর বাড়ির সামনে আমাদের প্রবাসীরা আন্দোলন করতে পারেন। নিয়মিত সভাসমাবেশ করতে পারেন। এতে তারা মানসিক যন্ত্রণায় থাকবেন। ইসরায়ল এই কাজটা করে। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বাড়ির সামনে তারা নিয়মিত প্রতিবাদ সমাবেশ করে, খুনিদেরও বিচার চাই, এই বাড়িতে খুনি থাকে। এই ধরনের স্লোগান দেয়। ফলে তারা সামাজিকভাবে হেয় হতে থাকে। অবশ্য রাশেদ চৌধুরীর বিচারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আমেরিকান সরকার।

আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে চলতি বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ সফল করতে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের অনেকেরই শাস্তি কার্যকর হয়েছে। যাদের দন্ড কার্যকর হয়নি, তারা বিদেশে পলাতক। তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য জোর প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। এই কূটনৈতিক প্রয়াস সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে। কোনো কোনো দেশের আইনে জটিলতা রয়েছে। তাদের দেশে মৃত্যুদণ্ডর কোনো বিধান নেই, বঙ্গবন্ধুর খুনিতে জড়িত সবাই ফাঁসির আসামী। তাই তাদের ফিরিয়ে আনতে অসুবিধা হচ্ছে। তবুও বিভিন্ন দেশে যারা রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের আলাপ আলোচনা চলছে। তাদের কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে আমাদের জোর তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষ উদযাপনের আগে পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের নিরলস প্রচেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে কানাডার খুনিকে ফেরানোর ব্যাপারে অনেকটা অগ্রগতি হয়েছে। খুনিদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। এর পাশাপাশি যারা এই হত্যাকান্ডের নেপথ্যে শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, সেই কুশীলবদের শনাক্ত করতে কমিশন করতে যাচ্ছে সরকার। বঙ্গবন্ধুর হত্যার নেপথ্যে কারা ছিল, তা নতুন প্রজন্মের জানা উচিত। কেউ কেউ স্বার্থের কারণে হলেও অনেকের দিকে আঙুল তোলে। এটা নিরসন হওয়া উচিত। তাই হত্যাকাণ্ড তদন্তে একটি কমিশন গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর জেল হত্যার তদন্ত করবে এই কমিশন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে এই কমিটির কার্যক্রমের সম্পৃক্ততা নিয়েও ভাবা হচ্ছে। 

১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সময়ে দেশের বাইরে ছিলেন তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। স্বামী-সন্তানসহ ছয় বছর বিদেশে কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৯ মে দেশে ফিরতে সক্ষম হন তাঁর বড় মেয়ে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই শিশু সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে লন্ডনে ছোট বোন শেখ রেহানার কাছে রেখে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন তিনি। পিতা হারানোর বেদনা তখনও জ্বল জ্বল করে তার অন্তপুরে।

দীর্ঘ দিন পরে দেশে ফেরা শেখ হাসিনার জন্য যতটা না আনন্দের ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি বেদনার। দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর দেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শের-এ-বাংলা নগর পর্যন্ত সব রাস্তা সেদিন পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। দেশের মাটিতে পা দিয়েই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি; বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।” তাঁর আগমন উপলক্ষে স্বাধীনতার অজেয় ধ্বনী ‘জয় বাংলা’ আবারও লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল সেদিন। সেদিন সবার কন্ঠে ¯স্লোগান ছিলো- ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম- পিতৃ হত্যার বদলা নেব’। ২০১০ সালে ঐতিহাসিক রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে হয়েছিল সেই বদলা নেওয়ার সূচনা। দন্ডিত পলাতক আসামীদের ফিরিয়ে এনে বিচার কার্যকর করার মাধ্যমেই কেবল তা পূর্ণতা পাবে।

লেখক: মন্ত্রী, পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়

এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি