স্পর্শ-সংস্কৃতি, বাংলাদেশ ও করোনাভাইরাস
প্রকাশিত : ১৪:০৭, ২১ মার্চ ২০২০
ড. মোহীত উল আলম- সংগৃহীত
১৯ মার্চ প্রায় প্রত্যেকটি দৈনিক পত্রিকার খবর মোটামুটি এ রকম- বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন, তার মধ্যে একজন মারা গেছেন। নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এ ভাইরাস দ্বিতীয় পর্যায় থেকে তৃতীয় পর্যায়ে হাঁটা শুরু করবে। অর্থাৎ পরিবারের লেভেল থেকে কমিউনিটি লেভেলে চলে যাবে এবং তখন তা মহামারি আকারে দেখা দেবে। নানা মহল থেকে এর মধ্যে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিদ্যমান পরিস্থিতি মহামারি ঘোষণা করার জন্য। তা না হলে লাখ লাখ লোক আক্রান্ত হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ভয়ানক মহামারি ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিদেশফেরত অনেকেই সতর্কতা-সচেতনতামূলক ও সঙ্গনিরোধ নির্দেশনা মানছেন না।
বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি। যেখানে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে হুঁশিয়ারি করা হচ্ছে, আমেরিকায় ২২ লাখ, যুক্তরাজ্যে অর্থাৎ গ্রেট ব্রিটেনে পাঁচ লাখ এবং ইরানে ৩৫ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থা ভাবতেও ভয় হয়। ইউনিসেফের একটি সতর্কবার্তা এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে। তার কয়েকটি শর্ত- বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাবের বিপক্ষে আছে বলে আমরা কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। বলা হচ্ছে, এ রোগের জীবাণু সর্বোচ্চ ২২ থেকে ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বা তার নিচে সংক্রামক থাকে এবং এর অধিক তাপমাত্রায় এটি বাঁচতে পারে না। যখন এ লেখাটি লিখছি, তখন চট্টগ্রামের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি এবং উত্তপ্ত রোদ- এই বেলা সাড়ে ১০টায় দ্বিতীয়বার গোসল করার জন্য উসকানি দিচ্ছে।
আরেকটা হলো, এই জীবাণু যেটা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় দেখতে রাজমুকুটের মতো, যার জন্য এটির নাম লাতিন শব্দ করোনা। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ক্রাউন এবং বাংলায় রাজমুকুট। এই তথ্যটি আমি পেয়েছি, আমার পুরোনো ছাত্র লন্ডন প্রবাসী খালিদ রশীদের টাইমলাইন থেকে। সে বলছে, যে করোনা সবার মাথায় মৃত্যুর রাজমুকুট পরিয়ে দিচ্ছে, সেই জীবাণুটা ওজনে একটু ভারী বিধায় বাতাসে উড়তে পারে না, ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়। জীবাণুটির এই পাখাবিহীন অক্ষমতাকে আমি মনে করি বাংলাদেশের মানুষের জন্য (বা পৃথিবীর মানুষের জন্য) একটি আশীর্বাদ। কেননা বাতাসে উড়লে ক্ষতি আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্বভাবতই জীবাণুটা যেহেতু প্রবল রোদ সহ্য করতে পারে না, তাই এই রৌদ্রস্নাত বাংলাদেশে এটা খুব সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে আমাদের এর মধ্যে স্বস্তি খুঁজলে চলবে না। সংক্রামক প্রতিরোধে এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এখন পর্যন্ত এসব ক্ষেত্রে নানা রকম ত্রুটির চিত্র আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখতে পারছি। বিষয়টি উদ্বেগের। এ ব্যাপারে যা কিছু করণীয় সবকিছুই করতে হবে দ্রুততা, সতর্কতা ও বিদ্যমান পরিস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে রেখে।
এই হামাগুড়ি দেওয়া জীবাণুটা যেখানে পড়ে সেখানেই আটকে যায়; কিন্তু বেঁচে থাকে হাতে বা মুখে ১০ মিনিট। কাপড়ে সাত-আট ঘণ্টা আর শক্ত সারফেসে মাটি, ফ্লোর, টেবিল ও মেটালিক আবরণে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা। এ জন্য বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার (বাংলা প্রবাদ 'হাত ধুয়ে দেওয়া' অর্থাৎ কাউকে ঠকানো, তার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই) কথা বলা হয়েছে অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত মুছতে বলা হয়েছে। যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন এবং পাঁচবারই ওজু করেন, তাদের হাত পরিস্কার থাকার কথা। হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মেও প্রচুর ধোয়াধুয়ির ব্যাপার আছে জানি। সবই বুঝলাম বটে, কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে অন্য জায়গায়। কোয়ারেন্টাইন করবেন কীভাবে? মানুষ গিজগিজ করছে যেখানে প্রতি বর্গইঞ্চিতে, সেখানে বিষয়টা এত সহজ নয়। তাছাড়া আমাদের সচেতনতার অভাব তো আছেই।
ইতালিফেরত মুনিরকে নিয়ে যে কথা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ফেইসবুকে, তাতে আমাদের সামাজিক মানসিকতার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। মুনির স্বেচ্ছানির্বাসনে তার গ্রামের বাড়িতে দিন কাটাবে; কিন্তু তার সব আত্মীয়স্বজন মিঠাই-পিঠাপুলি নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সুদূর উত্তরবঙ্গ থেকেও তার এক খালাশাশুড়ি দেখা করতে এসেছেন। কী তার অসুখ, কেমন করে তার দিন কেটেছে ইতালিতে বা বাংলাদেশে, এতদিন পরে এসে তার কেমন লাগছে দেশকে ইত্যাদি জানতে তিনি ছুটে এসেছেন। মুনিরের বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নের দরবার বেড়ে গেল; তারপরও মুনির ঘরের ভেতর থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে গেল। তখন তার শ্যালিকা দুলাভাইয়ের হাত ধরে বলল, ‘দুলাভাই, বাপের বাড়িতে তো এক সপ্তাহ রইলেন, এবার বাকি সপ্তাহটা আমাদের বাড়িতে কাটান।’ মুনির শ্বশুরবাড়ি রওনা দিল আর মুনিরের শাশুড়ি সে কথা শুনে জামাইয়ের জন্য মুরগির রোস্ট তৈরি করলেন। শ্বশুর কাছের হাট থেকে কিনে আনলেন আস্ত একটা ছাগল। জবাই হবে। এই হলো আমাদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাস্তবতা। তবে এর একটা উল্টো ঘটনাও আছে। সত্য ঘটনা। ইতালি প্রবাসী স্বামী দেশে ফেরত আসছে শুনে বউ শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়েছেন। এই বর্ণনায় আমাদের সমাজে সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থা কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়।
গুজব ছড়ানোর অপপ্রবণতা এই সমাজে নতুন নয়। আবার এই গুজব পুঁজি করে অনেকেই নিজেদের ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টাও করেন। যেমনটি দেখা গেছে আমাদের বাজারের ক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে চালসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম হুহু করে বেড়ে গেছে। দায়িত্বশীলদের তরফে প্রতিকারের কথা বলা হলেও প্রতিকারচিত্র এখনও সে রকম দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। সংকটে সুবিধাবাদীরা নানা রকম ফায়দা লোটার জন্য তৎপর থাকে- এ রকম অভিজ্ঞতা আমাদের যথেষ্ট পুষ্ট। এরই মধ্যে করোনার সংক্রমণ যেসব নেতিবাচক চিত্র দাঁড় করিয়েছে, তাতে সন্দেহ জাগে আগামীতে আরও না জানি কত রকম ফন্দি-ফিকির ধান্দাবাজরা আঁটতে থাকে। এসব ব্যাপারে প্রশাসনকে কঠোর দৃষ্টি দিতে হবে।
এর আগে যে লিখেছি শ্যালিকা দুলাভাইয়ের হাত ধরে বলেছিল তাদের বাড়ি যেতে। কিন্তু কভিড-১৯-এর অভিধানে কখনও স্পর্শ করা যাবে না, এটাই হলো মূল কথা। স্পর্শ-সংস্কৃতির জায়গাটায় আমরা (বাংলাদেশ) ফেল মারব। কারণ অতি ঘনত্বপূর্ণ দেশে স্পর্শ ছাড়া আমরা চলতেই পারি না। এখানে চক্ষুষ্ফ্মানভাবে ছেলেমেয়ে (বিবাহিত হলেও) হাত ধরাধরি করে হাঁটার রেওয়াজ নেই। কিন্তু মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রেই তো হাত ধরাধরি করে চলে আমাদের দেশে। শুধু তাই নয়, বয়স্করাও আমাদের দেশে জনসমক্ষে নিশ্চিন্তে একজনের হাত আরেকজন ধরে হাঁটেন। অনেকেই সেলফি তোলার সময় অবলীলায় পিঠে হাত রাখেন। আর মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির প্রভাব ও অণুকরণে ইদানীং পুরুষে পুরুষে গাল ঘেঁষাঘেঁষি করা, গালে আলতো চুমু খাওয়ার সংস্কৃতিও বেড়ে গেছে। অথচ করোনা ভাইরাসের প্রতিবিধানের প্রথম শর্ত হলো- স্পর্শ কর না। আমি মনে করি, এই উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে সহমর্মিতা প্রকাশের ধরনটাই হলো প্রধানত শারীরিক। তাই আমার মনে হয়, দুর্ভাগ্যক্রমে যদি বাংলাদেশ করোনার মহামারির পর্যায়ে পৌঁছায়, তা হলে শক্তিশালী স্পর্শ-সংস্কৃতির কারণে এখানে পরিস্থিতি বিশ্বে সবচেয়ে খারাপের পর্যায়ে রূপ নেবে। এখানে অসুস্থ লোককে সেবা করার জন্য লোক থাকবেই, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও। লোক সরিয়ে একটা লোককে একা মরতে দেবে আমাদের সামাজিক ও মানবিক সংস্কৃতির মধ্যে, এ মানসিকতার উপস্থিতিই নেই। এজন্য আমাদের সতর্ক থেকেই সবকিছু করতে হবে।
তা হলে কী করতে হবে? আমার অতি বিনীত পরামর্শ হলো, স্পর্শ-সংস্কৃতির ভীতি পরিহার করে অন্য একটি রাস্তা বের করা জরুরি। সেটা কী? এখানে সরকারের উদ্যোগ তো থাকবেই, বেসরকারি উদ্যোগও থাকবে। আর সেটা হলো, এখন থেকে গ্রামে গ্রামে বা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করা। তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা কিট দিয়ে অসংক্রমিত রাখা এবং সেবা কাজে প্রশিক্ষণ দেওয়া। আমাদের যেহেতু জনসংখ্যা বেশি এবং এই জনসংখ্যাকে রোগী মনে না করে সেবক মনে করে যদি আমরা করোনার মুখোমুখি হই, তা হলে মনে হয় বিস্তার ঠেকানো যাবে। এই রোগের সরাসরি প্রতিষেধক এখনও বের হয়নি। আমেরিকায় সামনের গ্রীষ্ফ্মে অর্থাৎ ২০২১-এ প্রতিষেধক বাজারে আসবে বলা হচ্ছে। এর আগ পর্যন্ত চিকিৎসকদের সম্ভবত সাধারণ চিকিৎসার বাইরে কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু একটি সমাজের সমষ্টিগত উদ্যোগ বিফলে যাবে বলে মনে হয় না। এটা তো আর মানুষ-প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না যে, প্রতিপক্ষের ভয়ে কাজ করতে বাধাপ্রাপ্ত হতে হবে। এটা করোনা নামক মৃত্যুদূতের সঙ্গে যুদ্ধ করা। অনেক বড় যুদ্ধ। সব মানুষ মিলে কাজ করা যায় এর বিরুদ্ধে, সে রকম একটা যুদ্ধ। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি। অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে, যেহেতু করোনার ফ্যাটালিটি রেইট ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে, তাই লোকক্ষয় ট্র্যাজিক হলেও অকল্পনীয় হবে না। কিন্তু রোগে ভুগবে লাখ লাখ মানুষ এবং সেটাই বিরাট সামাজিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। অর্থনীতির ধসের কথা আর বললাম না। তবে ভীতি নয়- সাহস, সচেতনতা, সতর্কতা ও পরিকল্পিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের এগোতে হবে। নানা রকম দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবিলায় আমাদের অভিজ্ঞতা আছে- এটাই বড় মানসিক শক্তি। একই আমাদের সঙ্গে অন্যান্য আক্রান্ত দেশ কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে, তাও পর্যবেক্ষণে রাখা যেতে পারে।
লেখক: ড. মোহীত উল আলম, শিক্ষাবিদ, গবেষক, কথাসাহিত্যিক।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।