অবরুদ্ধ লন্ডন
প্রকাশিত : ২৩:২৬, ২৭ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ১৭:৪৮, ২৮ মার্চ ২০২০
এমনতর বিপদেই খোলস খুলে যায়। মানুষের আসল রূপ বেরিয়ে আসে। করোনার কোয়ারেন্টাইন ও তাতে আক্রান্ত হবার ভয়াবহ আশংকা মানুষের সামাজিক পোশাক খুলে নিয়েছে। বদলে দিয়েছে তার চলার বলার ধরণ ধারণ। মানুষ পড়ে গেছে তার স্মরণাতীত কালের একঘেয়ে দুশ্চিন্তাময় এক গাতায়। প্রাণভয়ে চলে যাচ্ছে সভ্যতা ভব্যতা ও টেবিল ম্যানারিজম ও শিষ্টাচার। এমনকি হ্যান্ডশেক কালচারের জন্মদেশ বিলেত থেকে উঠে গেছে করমর্দন। এখানে আর নেই কোন আলিঙ্গন, চুম্বন।
গৃহবন্দী কম্পিউটার বাহিত একঘরে জীবন থেকে কাচের শার্সি দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি এইসব। এক সময়ের মুখরিত মোস্টিন গ্রোভ রাস্তায় মানুষ কমে এসেছে। প্রেমিক যুগল পাশাপাশি হাত ছাড়াছাড়ি হেঁটে যাচ্ছে যেন অফিস সহকর্মী। মুখে মাস্ক দেখে বুঝতেও পারি না তারা হাসছে কিনা।
দেশ থেকে ফিরে এসেছি তিন সপ্তাহ হলো। ঈশিতা রয়ে গেছে আকরাম খান এ্যান্ড কোম্পানীর কাজের জন্য। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সে আসবে। চীনের করোনা সংবাদ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও ইটালির মোচ্ছব শুরু হয়নি তখনো। কিছু একটা আসছে ধেয়ে তার খবরে রোমান রোডে গিয়ে দেখি ঐ রাত ৯টায় ও চলছে তুমুল কেনাকাটা। মানুষ করছে কি? এ যে প্যানিক বাইং! দশের কথা চিন্তা না করে দুনিয়ার খাবার একাই গিলবে? ফার্মাসিতে ঢুকে দেখি ওয়েট ওয়াইপ নেই। স্যানিটাইজার ও নেই। এক পাউন্ডের ঐ তরল নাকি এখন আট পাউন্ডেও পাওয়া যাবে না। বলে কি এরা! নিজেকে যে স্মার্ট ভাবতাম তার গোড়ার স্ক্রু বেশ খানিকটা ঢিলা হয়ে গেল।
বাড়ি ফিরেই একটার পর একটা মিটিং ও কাজ ক্যান্সেলেশনের ইমেল পেয়ে অবাক হয়ে গেলাম। ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে কাজের জন্য সর্বশেষ বাইরে যাওয়া ছিল স্ট্রাটফোর্ড লাইব্রেরীর ওয়ার্কশপের জন্য। আমি আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেনেই দস্তানা পরে, পকেটে মিনি স্যানিটাইজার বোতল ও ওয়েট ওয়াইপ নিয়ে গেছি। প্রবেশ পথেই রোজী এগিয়ে এসেছিলো হ্যান্ডশেকের ভংগিতে। তারপর অদৃশ্য এক বৈদ্যূতিক ছোবলের মত হাত ফিরিয়ে নিয়ে হেসে বলেছিলো ‘নমস্কার’ শামীম। আমি হেসে হাত তুলে বললাম ‘সালাম’। ওদিকে দূর থেকে বেভারলী ও হেবা হাত নেড়ে দেখালো ‘হাই’। আমরা মাস্ক খুলে বসলাম। পাশে্র টেবিলে্র মার্টিন পিন্ডার বসবার আগে স্প্রে দিয়ে টেবিল টপ পরিষ্কার করে বসেছিলেন। ব্রেকে এ নিয়ে এবং অন্যান্য রেডিও টিভির কমেডি কৌতুক, ইমেল, ইমেজ, ভিডিও ক্লিপ এসব নিয়ে প্রচুর হাসাহাসি হলো।
কিন্তু হুড় হুড় করে মৃত্যু সংখ্যা বাড়বার এবং বুনো আগুনের মত তা ইটালি ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে হাসাহাসি বন্ধ হয়ে গেল। শুনলাম আমাদেরই দালানে এক ইটালি ফেরত কোয়ারেন্টাইনে আছেন। নার্স এসে দেখে যাবে ১৪ দিন পার না হওয়া অবধি।
আমার বার বার ভয়াবহ একাত্তরের সেই আবদ্ধ দিনগুলোর কথা মনেপড়ে যাচ্ছে। সে পাকিস্তানী আর্মি ও রাজাকার শ্ত্রুকে চোখে দেখা যেতো। আর করোনাকে দেখা যায় না। সে সময় আমি তরুণী ছিলাম এখন প্রবীন। তখন যুদ্ধে গেছি। এখন বৃটেনের ভাল্নারেবল দলে পড়ি বলে গৃহে অন্তরিণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় আম্মা-আব্বা চাল, ডাল, লবন ও তেল সঞ্চয় করে রেখে ছিলেন।
আমাদের পড়ার ঘরে খাটের নিচটাতে ছিলো আলু, পেঁয়াজ ও মিষ্টি কুমড়ো। সেকথা মনে করেই আমি কিনে এনেছি শুকনো পেঁয়াজের এক প্যাকেট, ২ কেজি চাল, ডাল, আলু, ১ বোতল ভার্জিন অলিভ ওয়েল, শুকনো মরিচ ও ২ লিটার দুধ। বাদ বাকি কিছু ঘরেই আছে। পরের সপ্তাহে বুঝি, যা কিনেছি তা অপ্রতুল। কিন্তু প্রচার মাধ্যমে বার বার সতর্কবানী আসতে থাকে সত্তুরে প্রবীণদের জন্য। আর আমাকে কেউ আর বাইরে যেতে দেবেনা। আপা কি লাগে, আপা কি লাগে? ফোনে, ফেইসবুকে আমার নিজস্ব এক ভলেন্টিয়ার ব্রিগেট তৈরি হয়ে গেল। এর সদস্যগন ঢাকা কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, গোল্ডেন জামালপুর সদস্য, বিজয়ফুল উজ্জিবক, লন্ডন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য এবং কেউ বা শুধুমাত্র আমার লেখার পাঠক!
সব চেয়ে যা দামী তা হচ্ছে মানুষ। কিন্তু এই মানুষই অজান্তে হয়ে যেতে পারে ঘাতক। এই তরুণ মানুষগুলোর সাহায্য প্রস্তাবনাই এখন আমার টাকা। আমি এদের ব্যয় করবো সুগৃহিনীর মত। করোনার থাবা বয়ঃবৃদ্ধদের উপর পড়েছে বলে কি! এই ৩৫-৪০ চল্লিশের জীবনেও যে সে খামচি দেবে না তার গ্যারান্টি নেই। আরমান বৃটিশ পুলিশ সার্ভিসে কাজ করে। সে বৃটেনের পরিস্থিতি সঙ্গিন হলেও নাকি অত্যাবশ্যকীয় ড্রপ করতে পারবে। আমার খুব কাছেই যার বসবাস সে হচ্ছে বিজয়ফুলের কো-কোর্ডিনেটার ও কবি অপু ইসলাম।
তো প্রথম সপ্তাহে ফেইসবুক ম্যাসেঞ্জারের লিস্টের পন্য নিয়ে অপু দু’বার এসেছিলো। প্রথম দিন ফ্রোজেন সব্জী, বিস্কুট ও চা এবং পরদিন এক ব্লক ফ্রোজেন মাছ, পিটাব্রেড ও গুঁড়ো দুধ নিয়ে। বাজারে তরল দুধ নেই। ফোন পেয়ে ঐসব ইত্যাদি ইত্যাদি এবং কোট পরে যখন আমি আমাদের দীর্ঘ প্যাসেজ পার হচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল এর শেষ নেই। আমার একাত্তরের ট্রেঞ্চের দিনগুলোর কথা মনে হচ্ছিলো। চারিদিকে শুধু মাটির দেয়াল, ওপরে টিনের ঢাকনা। ভেতরে গাদাগাদি আমরা ক’জন। বাইরে সাইরেনের আর্তনাদ।
অভ্যর্থনা কর্মী সুইচ টিপে কাচের দরজা খুলে দিলে দীর্ঘদেহী অপু দেবদূতের মত এসে দাঁড়ালো। কিন্তু এ দেবতার মাথায় মুকুট নেই আছে ব্রাউন হ্যাট, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লভস। আমাকে দেখা মাত্র মাস্কের উপর দিয়ে চোখজোড়া ঝিকিয়ে উঠেছে। হিসাব নিকাশ হবে অনলাইনে। ঈশারায় বিদায় ও ভালোবাসা মাইম করে প্লাস্টিকের প্যাকেটগুলো গ্লভস হাতে নিয়ে এসেই সিংকে ভিজিয়েছি। তারপরে গোলা সাবানের সংগে মেশানো জলে সব প্যাকেট ধুয়ে একটি কিচেন টাওয়েলের উপর জল শুকোতে দিয়ে রাইস কুকারে ভাত চড়িয়ে মাছের ব্লক ভিজিয়ে দৌড়ে স্নান করতে গেলাম।
আজ খোসা সহ আলু-বোয়াল মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাবো। শাওয়ার ছেড়ে দিলে জলের শব্দে রেডিওর সংবাদ হারিয়ে যায়- বৃটেনে এ যাবত মৃত্যু হয়েছে আটজনের আর সংক্রমণ হয়েছে ৪৬০ জনের, আর্সেনাল ফুটবল ক্লাবের ম্যানেজার ও একজন খেলোয়াড় করোনাক্রান্ত হয়েছেন। এপ্রিল পর্যন্ত সকল প্রিমিয়ার লীগ ফুটবল বাতিল করা হয়েছে। ব্রিটিশ এয়ারওয়াজ ইটালির সব ফ্লাইট বাতিল করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের সবগুলো দেশ যাদের ভিসা বহির্ভূত আসা-যাওয়া আছে তাদেরকে আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।
গা মুছে বেরুতেই মনে পড়ে অপুর মায়াময় চোখ জোড়া। মানুষের ভালবাসা পাখির মত। তা কি ঠেকিয়ে রাখা যায়?
লন্ডন
২৭.৩.২০২০
লেখকঃ কবি ও কলামিস্ট শামীম আজাদ।
এসি
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।