করোনা সঙ্কট: নমিতব্য জনেরা
প্রকাশিত : ২১:৫৮, ২৯ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ২২:২০, ২৯ মার্চ ২০২০
ড. সেলিম জাহান
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
প্রায়শ:ই মনে হয়, এ কোন সময়, এ কোন পৃথিবী, এ কোন জীবন। করোনার তাণ্ডবে সারা বিশ্বে আজ টাল মাটাল অবস্থা। এ অবস্থায়, আতঙ্ক, হতাশা, ক্রোধ খুবই স্বাভাবিক। তবু ‘অদ্ভুত আঁধার আজ পৃথিবীতে এক’ এর মধ্যে কিছু কিছু মানুষ আলোর একটি টলমলে শিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন। তাঁদের কথা যখন ভাবি, তখন নমিত হই নিজের অজান্তেই।
সারা বিশ্বজুড়ে যখন এক দিশেহারা অবস্থা, নিজের প্রাণ বাঁচাতে আমরা যখন মরিয়া, তখন দেশে দেশে স্বাস্থ্য সেবা দানকারীরা নিজের জীবন বাজী রেখে আমাদের জীবন বাঁচানোর কাজে ব্যস্ত। চিকিৎসক, সেবিকা এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সবাই ঘড়ির কাঁটা না মেনে কাজ করে যাচ্ছেন, অনেক সময় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ছাড়াই। তাঁরা বাড়ি ছেড়ে কাজে যাচ্ছেন আমাদের বাঁচানোর জন্যে, আমাদের কি উচিত নয়, যদি আমরা পারি, বাড়িতে নিজেদের আবদ্ধ রেখে তাঁদেরকে বাঁচানোর? নমিত হই বিশ্বের স্বাস্থ্য সেবাদান কর্মীদের প্রতি।
কৃতজ্ঞতা জানাই সেই সব মানুষদের যাঁরা এই সময়ে বিভিন্ন জরুরী সেবা দিয়ে একটি দেশের প্রতিদিনকার জীবনকে সচল রেখেছেন। তাদের সেবা ভিন্ন বিদ্যুৎ, জল, বর্জ্য নিষ্কাশন ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর সুরাহা হতো না। ভুতুড়ে শহরগুলোতে নানান বিষয়ে ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা আমাদের যাপিত জীবনকে সচল রেখেছেন।
ধন্যবাদ জানাই তাদেরকে যাঁরা মানবতাকে সামনে রেখে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন অন্যদের সাহায্য করতে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যেরা হস্ত সুরক্ষার নির্যাস তৈরী করে পৌঁছে দিচ্ছেন বঞ্চিত জনগণের কাছে। একই কাজ করছেন বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন চিকিৎসক ও সেবিকাদের জন্যে মুখাবরণী থেকে শুরু করে অন্যান্য সরঞ্জাম দান করেছেন। লন্ডনে এক হোটেল মালিক তাঁর নানান হোটেল ছেড়ে দিয়েছেন হাসপাতালে রূপান্তরের জন্যে।
দু’জন মানুষের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা - একজন যুক্তরাষ্ট্রের, অন্যজন বাংলাদেশের। যুক্তরাষ্ট্রের জেনিফার হলার পরীক্ষৃতৃব্য টীকার জন্যে স্বেচ্ছাসেবী হয়ছেন। এর ফলে তার মৃত্যুও হতে পারে। তবুও মানবতার জন্যে তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। তাঁর কাছে নমিত হই। কৃতজ্ঞতা বাংলাদেশে আমার পরম স্নেহভাজন নবনীতা চক্রবর্তীর প্রতি। শান্তি নিকেতনের তুখোড় শিক্ষার্থী ও বর্তমানে বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তির শিক্ষক এ মানুষটি স্বেচ্ছাসেবী হতে চেয়েছেন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডে। গড়ে তুলেছন ‘নীলফামারী ব্রিগেড’। মঙ্গল হোক তাঁর এবং সফল হোক তাঁর কর্মকাণ্ড।
শেষের তিনটে কথা বলি। প্রথমত: নানান জায়গায় বহু মানুষ মানবতাবাদী বহু কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের সবার কথা জানি না বা বলা হল না। নমিত হই জানা-অজানা সেই সব মানুষদের প্রতি।
দ্বিতীয়ত: ‘শুধু আমি আমাকে বাঁচাবো’ এমন আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে আমরা যেন নিজেদের মুক্ত রাখি। করোনার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে যুক্তি যেন আমাদের ভাষা হয়, যৌথতা যেন আমাদের সংস্কৃতি হয়। ‘অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ’ থাকবে না। সেই সঙ্গে আমরা যেন না ভুলি, আমরা ব্যক্তিগতভাবে নিরাপদ নই, যদি যে কাঠামোতে আমাদের বসবাস, তা যদি সুরক্ষিত না হয়। মনে রাখা দরকার যে, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয় তা থেকে রক্ষা পায় না।
শেষত: পৃথিবীর নানান জায়গায় বিজ্ঞান প্রাণপাত করে যাচ্ছেন করোনার একটি প্রতিষেধক বার করতে। অতীতে হয়েছে, এবারেও কেন হবে না? কৃতজ্ঞতা তাঁদের প্রতিও। আমি নিশ্চিত, একদিন সেটাও লভ্য হবে আমাদের কাছে। আশা হারাই না, কারণ ‘আশাতেই তে বসতি’। নিরাশার তো কোনো ইতিবাচক দিক দেখি না। ভাবি, কোনো একদিন ভবিষ্যতে একদিন আমরা পেছনে ফিরে তাকিয়ে বলবো, ‘মনে আছে সেই যে করোনার বছরে ...’।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।