করোনা সঙ্কট: কিছু ইতিবাচক দিক
প্রকাশিত : ২০:১৩, ১ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ২০:১৪, ১ এপ্রিল ২০২০
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
প্রশ্নটা তিনি ঝট করেই করেছিলেন - ‘করোনা সঙ্কটের ইতিবাচক কোন দিক আছে বলে তুমি মনে কর?’ এটাই বন্ধুটির স্বভাব - আচমকা প্রশ্ন করে অন্যকে হতবুদ্ধি করে দেয়া। ফোন করেছিলেন তিনি সকাল বেলায় খোঁজ-খবর নিতে। কথা চলছিল ভালোই মূলত: করোনাকে নিয়ে। তার মধ্যেই ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো’ তাঁর এই প্রশ্ন। নিজেকে সামলে নিতে একটু সময় লাগলো। তারপর শান্ত গলায় বললাম, ‘তা ধরোগে, পাঁচটি ইতিবাচক দিক তো আছেই’। ‘পাঁচটি!’, এবার তাঁর চমকানোর পালা। ‘তা বলো দিকি নি তোমার পঞ্চ কথা’ - তাঁর কণ্ঠস্বরে সূক্ষ্ম পরিহাসের তীরটি কানে লাগলো। ‘তা’হলে শোন’, খোলাসা করি তাঁর কাছে।
প্রথমত: করোনার কারণে একটা সঙ্কট ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে বলেই আমরা সবাই সবার হাল-হকিকতের খোঁজ নিচ্ছি। কে কেমন আছি, কারে কিছু লাগবে কিনা - সব জানতে চাচ্ছি এবং কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি কিনা, তাও জিজ্ঞেস করছি। খবর ও তথ্যের আদান-প্রদান করছি এবং নানা বিষয়ে নানান মানুষকে সাবধানও করে দিচ্ছি। এমন সৌহার্দ্য, হৃদ্যতা, সংবেদনশীলতা ক’দিন আগেও এমনটা ছিল না। বলা চলে, করোনা সঙ্কট ওআতঙ্ক আমাদের সামাজিক একাত্মতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত: পারিবারিক বন্ধনও তো আরো দৃঢ় হয়েছে করোনার কারনে। সবাই আটকা পড়ে আছি বাড়ির মধ্যে। করোনা প্রেক্ষিতে মা-বাবার ভঙ্গুরতার কারণে তাঁদের প্রতি অনেক বেশি যত্নবান হচ্ছি, ভাই- বোনদের নতুন করে চিনতে পারছি, শিশুদের দেখছি বড় মায়াময় চোখে। অদ্যাবধি যাপিত জীবনের ব্যস্ততাকে বিরতি দিয়ে পারিবারিক জীবনকে যেন নতুন চোখে দেখছি - শিশুদের সঙ্গে খেলছি, গল্প করছি পরিবারের নানান সদস্যদের সঙ্গে, ঘর-বাড়ির আশপাশটাও নতুন করে দেখছি। বড় টান বোধ করছি প্রিয়জনদের প্রতি।
তৃতীয়ত: ঘরের মধ্যে আটকা বড়ে অন্তত: তিনটে ব্যাপারে আমাদের নতুন করে নানান উপলব্ধি হচ্ছে। এক, বাড়ির মেয়েরা কি পরিমান কাজ করেন - ঘরে বাইরে। দুই, ঘরের কাজে যারা আমাদের সাহায্যকারী, আমাদের যাপিত জীবনের চাকা সচল রাখতে তাঁদের ভূমিকা যে কত বড়! তিন, বহু বই বাড়িতে রয়ে গেছে বহুদিন, পড়া হয় নি; বহু কথা মনে জমে আছে বহুদিন, বলা হয় নি; বহু কাজ সামনে জমে আছে বহুদিন, করা হয় নি। এ সব চেতনার জন্মদাত্রী তো করোনা সঙ্কটই বটে!
চতুর্থত: থমকে যাওয়া পৃথিবী, জীবন ও মানুষের কারণে কমে গেছে বায়ু ও শব্দ দূষণ। আকাশের দিকে তাকালে কি আর একটু ঝকঝকে মনে হয় না, রাতে কি তারাদের আর একটু উজ্জ্বল দেখা যায় না, বাতাসটুকুকে কি আর একটু নির্মল বোধ হয় না?
মনে কি হয় না যে, নিস্তবদ্ধতারও একটি শব্দ আছে, যা বহুকাল শুনি নি?
পঞ্চমত: করোনা সঙ্কটে মানব জাতি নতুন করে তিনটে সত্যি হৃদয়ঙ্গম করতে পারলো - মাতা ধরিত্রীর তুলনায় মানুষ খুবই ক্ষুদ্র; প্রকৃতির রোষের কাছে সে বড় অসহায়; প্রকৃতির অপব্যবহার করলে সে কোনো না কোনোভাবে এর বদলা নেবেই।
বহু মৃত্যু, বহু ক্ষতি, বহু দু:স্বপ্নের স্মৃতি পেরিয়ে কোনো একদিন হয়তো এ সঙ্কট কেটে যাবে। সুন্দর দিন আবার ফিরে আসবে। কিন্তু তখন আমরা যেন এই সময় ভুলে না যায়, বিস্মৃত না হই বর্তমান সঙ্কটের শিক্ষা না ভুলে যাই। কিন্ত এ মুহূর্তে শুধু বলি, মানুষ, নম্র হও, নত হও প্রকৃতির কাছে, নমিত হও মাতা ধরিত্রীর কাছে।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।