করোনা সঙ্কট ও বৈশ্বিক অর্থনীতি
প্রকাশিত : ১৯:০৮, ৬ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১৯:১৮, ৬ এপ্রিল ২০২০
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
কথা বলছিলাম অনুজপ্রতিম আনিসের সঙ্গে। ভয়েস অব আমেরিকার প্রখ্যাত প্রতিবেদক, সাংবাদিক ও উপস্থাপক আনিস আহমেদ। আলোচনার বিষয় - ‘করোনা সঙ্কট ও বিশ্ব অর্থনীতি’। বলা বাহূল্য, বাংলাদেশের অর্থনীতির কথা স্বাভাবিকভাবে উঠে আসছিলো।
বৈশ্বিক সঙ্কট ও বিশ্ব অর্থনীতিতে তার প্রভাব বিষয়ে বর্তমান সঙ্কট প্রসঙ্গে ২০০৮ এর অর্থনৈতিক সঙ্কটের কথা উঠে আসছিলো বারবার। কিন্তু আমি মনে করি এ তুলনা প্রাসঙ্গিকও নয়, যথার্থও নয়। অন্তত: তিনটে বিষয় বলা যায় এ প্রসঙ্গে।
এক, বর্তমান সঙ্কটের সঙ্গে যুক্ত ব্যাপক প্রাণহানি, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটে সেটা প্রাসঙ্গিক ছিল না। সেই সঙ্গে ২০০৮ এ জনমানুষের গৃহবন্দী হওয়ার ব্যপারটি ছিল না, ২০২০এ সেটাই বর্তমান সময়ের সঙ্কটের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রিকতা। এবং এর অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া আছে।
দুই, ২০০৮ এর সঙ্কট উত্তরণের মোটামুটি একটি সময় প্রাক্কলন করা গেছে। কিন্তু বর্তমান সঙ্কট উত্তরণের কোন সময় সময়সূচী কেউ বলতে পারে না।
তিন, ২০০৮ সালে সঙ্কট উত্তরণের কলা-কৌশল নীতি-নির্ধারকদের জানা ছিলো, কারণ এমন অর্থনৈতিক সঙ্কট আগেও হয়েছে নানান দশকে।
করোনা সঙ্কটের বৈশ্বিক প্রভাবকে তিনটি সময় সীমার প্রেক্ষিতে মূল্যায়ণ করা যেতে পারে - স্বল্পকালীন, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী। স্বল্পমেয়াদে তিনটে বিরূপ অর্থনৈতিক প্রভাব পড়তে পারে বর্তমান করোনা সঙ্কটে।
প্রথমত: যেহেতু সবকিছু বন্ধ করে দেয়ার ফলে বেশীরভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরে বিধি- নিষেধ আছে। ফলে, নানান প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অস্থায়ীভাবে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এরফলে তাদের কর্মসংস্থান, আয় ও জীবনযাত্রার মানের ওপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। এ বিরূপ প্রভাবের মূল শিকার হচ্ছেন তারাই যাঁরা অদক্ষ শ্রমিক, সেবাখাতে কর্মরত, ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন।
দ্বিতীয়ত: খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের যোগান কমে যাওয়ায় খাদ্য সামগ্রীর লভ্যতা একটা বিরাট সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শিশুরা এর এক বিরাট শিকার। খাদ্য সামগ্রীর আকালে দরিদ্র মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নি:সন্দেহে।
তৃতীয়ত: ইতিমধ্যেই বিশ্ব অর্থ বাজারে বেশ টালমাটাল অবস্থা দেখা দিয়েছে। নানান বিনিময় পত্রের দাম পড়ে গেছে, আর্থিকবাজারের গতিবিধি নিম্নমুখী, যাকে সামাল দেয়া যাচ্ছে না। দিশেহারা বিনিয়োগকারীরা। আন্তর্জাতিক বানিজ্য পুরো স্তব্ধ হয়ে আছে।
মধ্য মেয়াদে আবারো তিনটে প্রবণতার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে। প্রথমত: বৈশ্বিক একটি মন্দা দেখা দেবে। তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা হয়তো অভাবনীয় হবে। এ মন্দার ফলে দরিদ্র দেশগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। এরফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত: দেশের মধ্যে উৎপাদন কাঠামো আরো বিপর্যস্ত হবে। যার ফলে, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান আরও সঙ্কুচিত হবে। শ্রমজীবি মানুষেরা সেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জালে নিষ্পেষিত হবেন। তৃতীয়ত: বহু ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যাবেন। যুক্তরাজ্যে প্রাক্কলন করা হচ্ছে যে প্রায় ৮ লক্ষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা হারাবেন।
দীর্ঘমেয়াদে, এ বছরে কৃষিকাজে কর্মযজ্ঞ না হওয়ায় আগামী বছরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আকাল বা দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেই সঙ্গে করোনা-মৃত্যুর আপাতন যদি বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপরে পড়ে, তা’হলে জনমিতির প্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশের নির্ভরতার হার কমে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এমনও হতে পারে যে কর্তৃত্ববাদী অর্থনীতিগুলোই হয়তো সমস্যার সমাধানদ্রুত ও অল্প আয়াসে করতে পারবে। সেটা যদি হয়, তা’হলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন হতে পারে।
শেষের কথা বলি। ঠিক এ সময়ে সঙ্কটের একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের কথা বলা বড় কঠিন। কোন রকম পরিমানগত প্রাক্কলন তো দু:সাধ্য। তাই মোটা দাগের কিছু প্রবণতার কথাই উল্লেখ করা হল। এগুলোই একমাত্র কথা নয়, শেষ কথাতো নয়ই।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।