করোনা সঙ্কট ও বাংলাদেশের অর্থনীতি
প্রকাশিত : ১২:৩৫, ৯ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১২:৩৭, ৯ এপ্রিল ২০২০
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।
করোনা সঙ্কটের ব্যাপ্তি এখনো বাংলাদেশে তেমন ছড়িয়ে পড়েনি বলে সবাই বলছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাবধান করে দিচ্ছে যে আগামী দিনগুলোতে এ সঙ্কট ঐ সব দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু সেটা যদি নাও হয়, বাংলাদেশে বর্তমান যে অবস্থা বিরাজ করছে, তা চলতে থাকলে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে কতগুলো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
সেসব প্রতিক্রিয়ার কিছু কিছু তো এখনই দেখা যায়। গৃহে অবরুদ্ধ হওয়ার কারণে বহু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখন বন্ধ। দোকান খোলা নেই, কারখানায় কাজ হচ্ছে না, লোকজন বাইরে বেরুচ্ছে না। ফলে যাঁরা ‘দিন এনে দিন খান’, তাঁদের আয়ের পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছেন দিন-মজুর, রিক্সাচালক, বাজারের ক্ষুদ্র বিক্রেতাগণ, যাঁরা রাস্তার পাশে বেসাতি সাজিয়ে বসতেন এবং এমন অজস্র মানুষেরা। বহু বাড়িতে সাহায্যকারী গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। তাঁদের আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে।
ইতিমধ্যেই বাজার থেকে বহু পণ্য হাওয়া হয়ে গেছে। এমনটাই আশংকা করা গিয়েছিল। সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা লোটার ঐতিহ্য আমাদের আছে। করোনা সঙ্কটও তার ব্যতয় নয়। মজুতদারেরা মজুত শুরু করেছেন এবং আগামী দিনগুলোতে এ সঙ্কট গভীরতর হবে। শোনা গেছে যে মুদীর দোকানে পরিস্কারক, মুখাবরনী, শল্য চিকিৎসকের দস্তানা পাওয়া যাচ্ছ, যেগুলো পাওয়ার কথা ঔষধের দোকানে। কিছুদিনের মধ্যেই মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে এবং তার ভারটিও বহন করতে হবে দেশের দরিদ্র জনগণকে।
উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। অবরুদ্ধ জীবনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলাফল এটি। ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারীরা দেউলিয়া হয়ে যাবেন। দিনের পর দিন সে সব প্রতিষ্ঠান নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে সেগুলো সচল থাকতে পারবে না। তাদের এমন কেন সঞ্চয় নেই যে তারা ক্রমাগত ক্ষতি দিয়েও টিঁকে থাকতে পারবেন।
করোনা সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে তিনটে প্রভাব পড়বে। প্রথমত: আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধির দুটো মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে পোশাক রপ্তানী ও বর্হি:বিশ্বে কর্মরত বাঙ্গালি শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, করোনা সঙ্কটের কারণে দু’টো চালিকা শক্তির ওপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। এর ফলে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার কমে আসবে এবং অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে।
মন্দার কারণে কর্মসংস্হান কমে যাবে এবং বেকারত্ব বাড়বে। পোশাক শিল্পের হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে পড়বেন এবং বিদেশে কর্মরত অদক্ষ শ্রমিকেরা কর্মহীন অবস্হায় দেশে ফিরবেন। এসব জনগোষ্ঠী ও তাঁদের পরিবারের ওপরে বিরাট অর্থনৈতিক চাপ পড়বে। সেই সঙ্গে বর্তমানে তেলের দাম যে বাড়ছে, তার ফলে বাংলাদেশকে তেল আমদানীর জন্যে একদিকে যেমন আমাদেরকে অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হবে, তেমনি মূল্যস্ফীতিতে এটা একটা বিরাট ভূমিকা রাখবে।
এ বছর যদি কৃষিখাতে যদি কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়, তা’হলে আগামী বছর কৃষি উৎপাদন কমে যেতে- কমে যেতে পারে খাদ্যসামগ্রীর লভ্যতা। এর ফলে খাদ্য সঙ্কটের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
ঠিক এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে করোনা সঙ্কটের পরিণাম কি হবে, তা সঠিক ব্যাপ্তি ও মাত্রিকতা নিরুপণ করা যাবে না। কোন উপাত্তের উল্লেখ তো দূরের কথা। মোটা দাগের কিছু সম্ভাবনার কথা বলা যেতে পারে মাত্র। এ অবস্থায় এর থেকে উত্তরণের পথ সম্পর্কে ভাবা বাতুলতা মাত্র। সমস্যার স্বরূপই যেখানে বোঝা যাচ্ছে না, সেখানে সমাধানের পথ কি করে খোঁজা যাবে। এখানে ‘বিশেষজ্ঞের’ ভান করে কোন লাভ নেই, কারণ এ সময়ে করোনা সঙ্কট ও তার অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আমরা সবাই ‘বিশেষভাবে অজ্ঞ’।
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।