করোনাভাইরাস: চিকিৎসকদের ত্যাগ হৃদয় দিয়ে অনুভব করুন
প্রকাশিত : ২২:৩৯, ১৩ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ২৩:১৪, ১৩ এপ্রিল ২০২০
একজন ব্যারিস্টার ফেসবুকে খুব আক্ষেপ করে লিখেছেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা কি শিখছে? ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার যারা হয়, তারা তো ভালোমানুষ হওয়ার কথা! পুরো লেখাটা পড়ার পর তিনি নিজে কেমন মানুষ হয়েছেন, তাই নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলাম।
একই লেখায় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ৬ জন চিকিৎসক করোনা রোগীদের সেবা করতে অনীহা প্রকাশ করায় (?) সেই চিকিৎসকদের অভিহিত করেছেন 'লোভী কুকুর' ও 'নেমক হারাম' বলে। সাথে দাবি করেছেন তাদের চাকরি হতে বহিষ্কার ও লাইসেন্স বাতিলের। বিশাল সেই লেখায় 'মাসে মাসে বেতন নিচ্ছেন', 'আমাদের টাকায় পড়ালেখা করছেন' জাতীয় কথার ছড়াছড়ি।
এই ব্যারিস্টার ভদ্রলোককে মানবাধিকার নিয়ে টিভিতে মাঝে মাঝে কথা বলতে দেখি।
আমরা কি অসভ্য সমাজে বসবাস করছি? সভ্য সমাজে চিকিৎসকদের প্রতি সম্মান জানানোটাই রীতি। আমাদের দেশে উল্টোটা।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে চিকিৎসকদের কিভাবে মূল্যায়ন করেছেন, দেখেছেন? ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চিকিৎসকদের ভগবান গণ্য করেছেন। ভারত সরকার করোনায় সেবাদানকারী চিকিৎসকদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বীমা সুবিধার ঘোষণা দিয়েছে। দিল্লির রাজ্য সরকার দিয়েছে এক কোটি টাকার বীমা। প্রণোদনা, বীমা এসবের জন্য চিকিৎসকরা লালায়িত না। তারা চায় সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা সরঞ্জাম। আর সম্মান।
সম্মান দিতে টাকা লাগে না। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি চিঠি লিখে তাঁর রাজ্যের পাশাপাশি যেভাবে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের অনুপ্রাণিত করতে পেরেছেন । বাংলায় লেখা অসম্ভব সুন্দর একটা চিঠি।
বাংলাদেশের চিকিৎসকরা বড় দুর্ভাগা। হোসেইন মহম্মদ এরশাদের সময় থেকে ডাক্তাররা বারবার অবমাননাকর বক্তব্য ও আচরণের শিকার হয়ে আসছেন। সরকার, প্রশাসন যেন চিকিৎসকদের হেয় প্রতিপন্ন করে চাপের মধ্যে রাখতেই পছন্দ করে।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্য, অন্যান্য কিছু পেশাজীবীদের অবচেতন মনেও যেন বাসা বেঁধে আছে চিকিৎসকদের প্রতি এক ধরণের ঈর্ষা!
সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পায়। পারিবারিক ও সামাজিক চাপও থাকে। এমনকি শতাধিক মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা বিশাল সংখ্যক চিকিৎসক কর্মসংস্থানহীন থাকার পরেও মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় ভাটা পড়েনি। আমি দেখেছি, যারা উঠতে বসতে চিকিৎসকদের প্রতি ক্ষোভ ও ঈর্ষা প্রকাশ করেন, তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েদেরকে ডাক্তারি পড়ার সুযোগের জন্য কত কসরত করেন। ইদানিং নতুন কিছু বিষয়ের প্রতি কিছু তরুণের আগ্রহ বাড়লেও, ডাক্তারির মোহ কাটেনি।
তবে এটা ঠিক, চিকিৎসকদের একটি অংশের প্রতি সাধারণ মানুষের সমালোচনা অনেক যুক্তিসঙ্গত, ক্ষোভও যথার্থ। আমি নিজেও অনেক বিষয়ে তীব্র সমালোচনা করি। কিন্তু এর জন্য যারা দায়ী, তারা সংখ্যায় কম। বেশিরভাগ চিকিৎসক, বিশেষ করে তরুণ চিকিৎসকদের অনেককেই লম্বা সময় কঠিন সংগ্রাম করতে হয়।
সরকার, প্রশাসন, অন্যান্য কিছু পেশাজীবীদের উদ্দেশ্যমূলক প্রাচারণায় বিভ্রান্ত হন সাধারণ মানুষের একটা অংশ। কিছু চিকিৎসকের বাণিজ্যিক মনোভাব, রোগীদের পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া, কাউন্সেলিংয়ের অভাব থেকে সাধারণ মানুষের যে ক্ষোভ, তাতে আগুন ঢালে নীতিনির্ধারকদের কিছু ভুল ও কিছু ধুরন্ধর গোষ্ঠীর পরিকল্পিত মিথ্যাচার। এই দুর্বলতার সুযোগে অন্যায়ভাবে কিছু দুর্বৃত্ত চিকিৎসকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার মতো দুঃসাহস পায়।
একটা গোষ্ঠী সুচতুরভাবে চিকিৎসকদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সুযোগ পেলেই নেতিবাচক খবর প্রকাশে উস্কানি দেয়, টকশোতে ঝড় তোলে।
সাম্প্রতিককালে করোনা পরিস্থিতিতে যথারীতি এসব প্রচারণা চলছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই তিন মাসে যা যা করা উচিত ছিলো, তা করতে না পারার যেটুকু ব্যর্থতা, তার সাথে চিকিৎসা সেবার সাথে জড়িত কোনো স্বাস্থ্যকর্মীর বিন্দুমাত্র দায় নেই। এটা নীতিনির্ধারক আর প্রশাসনে জড়িত কিছু চিকিৎসকের ব্যর্থতা। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরো বিশ্লেষণের সুযোগ আছে, প্রয়োজনও আছে। সেই ব্যর্থতার দায় সাধারণ চিকিৎসকদের দিকে ঠেলে দিয়ে তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় করা শুধু অন্যায় নয়, অমানবিক।
চিকিৎসক সমাজের প্রতি আহ্বান, মহান আল্লাহ যদি আমাদের দেশবাসীকে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন, আত্মসমালোচনা করুন। নিজ পেশার নগণ্যসংখ্যক মানুষের অন্যায় আচরণ ও কর্মের দায়ভার সবাই কেন নিবেন? তাদের চিহ্নিত করুন। পারলে সংশোধন করুন, না পারলে তাদের বর্জন করুন।
দেশের বিবেকমান মানুষদের কাছে আহ্বান, যৌক্তিক আচরণ করুন। কিছু চিকিৎসকের অন্যায্য আচরণের জন্য ঢালাওভাবে আপনাদের কথা ও কাজে চিকিৎসকদের প্রতি অমানবিক হবেন না। এই চিকিৎসকরা এই সমাজ থেকেই উঠে এসেছে। কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে চাষ করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়নি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ভোগবাদিতা, লোভ ও লুটপাটের মহোৎসব চলছে, সেখানে কিছু চিকিৎসকও অন্যায় করতে পারে। তার জন্য শুধু চিকিৎসকদের ঢালাওভাবে চরিত্রহননের যে অশুভ প্রক্রিয়া, তাতে সায় দিবেন কেন?
এই দেশের চিকিৎসক অধ্যাপক ইব্রাহিম বারডেম প্রতিষ্ঠা করেছেন, সারা দেশে ডায়াবেটিক সেন্টার গড়ে তুলেছেন। চিকিৎসক ব্রিগেডিয়ার মালিক হার্ট ফাউন্ডেশন গঠন করেছেন, দেশেই হৃদরোগ চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, এখনও কাজ করে যাচ্ছেন। অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক ডা. এম আর খান নিজেদের উৎসর্গ করেছেন মানবসেবায়। পুরো জাতির জন্য তারা বাতিঘর।
এখনও অনেক চিকিৎসক সত্যিকারভাবেই মানুষের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন, যা অনেকেই জানি না। গতবছর ডেঙ্গুর সময় চিকিৎসকদের অবদান কি এই সমাজ ভুলে যাবে? এই যে প্রায় তিরিশ জন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন, ৩ জন আইসিইউতে, প্রায় ৬০ জন আইসোলেশনে। তাদের সন্তান, স্বামী/স্ত্রী, আত্মীয়দের মনের অবস্থা, সংসারের অবস্থা, ভেবে দেখেছেন? মাসাধিককাল যারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন আছেন, তাদের শারীরিক ও মানসিক চাপ হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন?
ফেসবুকের প্রিয় যোদ্ধা, টকশোর কিছু সর্বজ্ঞানী বিশেষজ্ঞ, যারা চিকিৎসকদের প্রতি অমানবিক, নিষ্ঠুর মন্তব্য করে যাচ্ছেন, দয়া করে একবার নিজেকে জিজ্ঞেস করবেন? আপনি দেশোদ্ধারে বা দেশের মানুষের জন্য ফেসবুকের বাইরে কি দায়িত্ব পালন করেছেন? চিকিৎসক ছাড়া দেশের সবাই যদি সুনাগরিক হতো, তাহলে এই সংকটে ত্রাণ চুরি করছে কারা? একটা বালিশ হাজার টাকায় কিনে কারা? রাস্তা বানাতে ইউরোপ আমেরিকার চেয়ে দ্বিগুণ তিনগুণ খরচ হয় কেন? লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয় কেন? সরকারি অনেক কর্মকর্তার সন্তানরা বিদেশে পড়ে কিভাবে? মন্ত্রীর ছেলে নিউইয়র্কে ১৪ ফ্লাটের মালিক হয় কিভাবে? বিচারপ্রার্থীরা সর্বশান্ত হয় কাদের পকেট ভরতে?
ফেসবুকীয় যোদ্ধাগণ, চিকিৎসকরা সমাজের মেধাবী সন্তান। তারা কতভাবে সরকারি চাকরিতে বৈষমের শিকার জানেন? বিএ/এমএ পাস কিছু মানুষ কোন যোগ্যতায় চিকিৎসকদের প্রজা ভেবে নিজেরা রাজার মত চলেন, তা ভেবে দেখেছেন? সবচেয়ে মেধাবী হয়ে ৫ বছর লেখাপড়া, এক বছর ইন্টারনশিপ করে আরো অন্তত ১০ বছর কঠোর সাধনার পর বিশেষজ্ঞ হন একজন চিকিৎসক। তারপর হয়তো সফলতার মুখ দেখেন। আমি আবারও বলছি, কিছু চিকিৎসকের সংশোধনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কার। আর এইখানে মূল ভুমিকায় নেই আপনাদের গালিগালাজ খাওয়া চিকিৎসারা। আছেন নীতিনির্ধারক, আমলাতন্ত্র আর কিছু চিকিৎসক আমলা।
সবশেষে ট্যাক্সের টাকা প্রসঙ্গ। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সবাই পড়েন। কিন্তু কেউ কেউ শুধু ডাক্তারদের মনে করিয়ে দেন যে তারা ট্যাক্সের টাকায়, 'আমাদের' টাকায় পড়ালেখা করেছেন। আমার কথায় কারো মন খারাপ হতে পারে, তবুও বলি, যারা এটা বলে তারাই আসলে ট্যাক্স দেন না। ব্যবসায়ী শিল্পপতি বাদ দিলে চিকিৎসকরাই সর্বোচ্চ ট্যাক্স দাতা।
করোনায় বিপর্যস্ত সারা বিশ্ব। সুপারপাওয়ার রাষ্ট্র, মহাক্ষমতাধর ব্যক্তি, কেউ নিস্তার পাচ্ছে না। এদেশের ক্ষমতাবান ও নতুন-পুরান পয়সাওয়ালা মানুষরা চিকিৎসার জন্য, ভোগবিলাসের জন্য দেশের বাইরে হরহামেশাই যান। এবার চাইলেও যেতে পারছেন না। কেউ আক্রান্ত হলে আপাতত এই দেশের ডাক্তারদের কাছেই চিকিৎসা নিতে হবে। চিকিৎসকরাও এই দেশের মানুষ। তাদের কাজ করার মনোবলটুকু নষ্ট করে দিবেন না। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর যে মিছিল শুরু হয়েছে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাই মানবিক হই। ঐক্যবদ্ধ থাকি। সংকট কেটে গেলে আরো বিচার-বিশ্লেষণ করা যাবে।
গৃহবন্দি এই সময়ে নিজেদের অন্যায়, ভুল-ভ্রান্তি, পাপের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাই। ডাক্তার ও ডাক্তার বিদ্বেষী, সবাই। ভোগবাদিতা, লুটপাট, অন্যের অধিকার—হরণের জন্য ক্ষমা চাই। ভালো হয়ে যাই। যদি বেঁচে থাকি, আগের চেয়ে কিছুটা ভালো হয়ে বাঁচি।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।