ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪

করোনা ও বিশ্বাস

নাজমুশ শাহাদাৎ

প্রকাশিত : ২১:৩৬, ১৭ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ২২:৪৭, ১৭ এপ্রিল ২০২০

করোনা ও ইমান -প্রতীকী ছবি

করোনা ও ইমান -প্রতীকী ছবি

অনেককেই বলতে শুনেছি, শেষ জামানায় একটা সময় আসবে যখন নাকি হাতের উপর আগুন রাখা যতটা কষ্টকর বা কঠিন হবে, নিজেদের ইমানকে ধরে রাখা বা বজায় রাখাটাও নাকি ততোটাই কঠিন হবে। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক সময় আসবে যখন মুসলমানদের জন্য ঈমান ধরে রাখা, জ্বলন্ত কয়লা হাতের মধ্যে রাখার ন্যায় কঠিন হবে- (তিরমিজি-২২৬০)।

আমার মনে হয়, বর্তমানে এই করোনা ভাইরাস এসে সেই ইমানের পরীক্ষাই নিচ্ছে। অনেকেই তা বুঝতে পারছে আবার বেশিরভাগই আছে না বোঝার দলে। কারণ, সবাই যে বিধির বিধান অমোঘ মৃত্যুকে খুব করে ভয় পায়।

ভয় পায় মূলত এই কারণে যে, তারা প্রত্যেকেই এই ক্ষণস্থায়ী জীবনটাকে অতিমাত্রায় ভালোবাসে। এখানে যারা আছে, যা কিছু আছে, সবই যে আদতে মরিচীকা বা তারই প্রয়োজনের নিমিত্ত মাত্র, সেটা কারো বোধগম্য নয়। কেউ কেউ তা বুঝেও আবার মোহে আবৃত হয়ে পড়ে। এই নশ্বর দুনিয়া নিয়েই সবার যত টেনশন। এই টেনশনেই কারো ঘুম আসে না।

এখানের সফলতাই সবার চিন্তার বিষয়, আবেগের বিষয়। অথচ এটা যে শ্রেফ এবং কেবলই পরীক্ষা ক্ষেত্র মাত্র। এটা অনেকেই জানে, বুঝে, তবুও আমলে নেয় না। যখন দেখে তার চারপাশের অনেকেই চলমান স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে ছুটে চলছে নিরন্তর এই মিথ্যা দুনিয়াকে পাওয়ার আশায়, এঁকে হাসিল করার আশায়। নিজেকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছানোর আশায়। কিন্তু তারপর কী হবে এটা সে জানে না। হয়তো জানে, জেনেও না জানার ভান করে ভোগে মত্ত হয়ে যায়।

বলছিলাম ইমানের কথা, বিশ্বাসীদের জন্য। এই পৃথিবীতে মানব সভ্যতার শুরু থেকে নানা মহামারীও এসেছে। তাতে লাখ লাখ মানুষও মরেছে। চলমান করোনা বা কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসও মহামারীতে রূপ নিয়েছে। যাতে ইতোমধ্যেই ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে দেড় ১ লাখ। বাংলাদেশেও অনেক মানুষ মারা গেছে, যদিও সরকারি হিসেব মতে ৭৫ জন।

এই মানুষকে আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন, এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, আবার প্রত্যেককেই একটা নির্দিস্ট সময় পর মৃত্যু নামক একটা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তাকে নির্ধারিত চিরন্তন ঠিকানায় রাখার জন্য উঠিয়ে নিবেন। মূলত এটাই সত্য। যদিও এই সত্যটা নিয়ে অনেকেই বেহুদা আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক করে নানান খিচুড়ি পাকিয়ে থাকে। 

এ বিষয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “তোমরা জেনে রাখ যে, দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া কৌতুক, শোভা-সৌন্দর্য, তোমাদের পারস্পরিক গর্ব-অহংকার এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র। এর উপমা হলো বৃষ্টির মতো, যার উৎপন্ন ফসল কৃষকদেরকে আনন্দ দেয়, তারপর তা শুকিয়ে যায়, তখন তুমি তা হলুদ বর্ণের দেখতে পাও, তারপর তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। আর আখিরাতে আছে কঠিন আযাব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবনটা তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।” [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ২০]

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আখিরাত দ্বারা পারলৌকিক জীবনকে বুঝায়। আখিরাতের বিপরীত দুনিয়া বা ইহলৌকিক জীবন। দুনিয়ার জীবনই মানবজীবনের শেষ নয়; বরং মৃত্যুর পারও রয়েছে মানুষের জন্য এক অনন্ত জীবন। যেখানে মানুষকে তার দুনিয়ার জীবনে কৃত ভাল ও মন্দ কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব-নিকেশ দিতে হবে। বিচারের পর পুরস্কার স্বরূপ জান্নাত এবং পাপীরা শাস্তি স্বরূপ জাহান্নাম লাভ করবে। মানবাত্মা অমর-অনন্ত। মৃত্যু তার শেষ পরিণতি নয়। মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথেই তার সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যায় না। মৃত ব্যক্তি আমাদের চোখের আড়ালে চলে যায়। তার আরেক নতুন জীবন শুরু হয়। এ জীবন চিরন্তন জীবন। এটাই মানুষের প্রকৃত জীবন। মৃত্যুর এ পরবর্তী জীবনের নামই আখিরাত বা পরকাল। 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দুনিয়ার মহব্বত একটি মারাত্মক ব্যাধি, যা মানবাত্মাকে ধ্বংস করে দেয় এবং মানবজাতিকে আখিরাত বিমুখ করে। কিন্তু আমাদের সবাইকেই একদিন মরতে হবে এবং আমরা জানি যে এটা আমাদের আসল ঠিকানা নয়। বরং পরীক্ষা ক্ষেত্র মাত্র। এখানে আমরা যে যাকিছু করবো তার ফলটা আমাদেরকে সেই চিরস্থায়ী জগতে আমার অবস্থান করে দিবে, ভালো অথবা মন্দ। মূলত কথা হচ্ছে- সেই জগতে যেতে হলে মরতে আমাদের হবেই। আজ হোক বা কাল। এটা নিশ্চিত। তা জানা স্বত্বেও আমরা কেউই যেন মরতেই চাই না। এই জগতেই থাকতে চাই আজীবন। মনে হয় যেন আমরা সবাই এই জগতের স্থায়ী বাসিন্দা। আর এটা প্রমাণের জন্য আমরা যা নয় তা করেই চলেছি নিরন্তর। আর তা করতে গিয়ে আমরা আমাদের পরীক্ষার কথা ভুলে যাই, আমাদের উদ্দেশ্যের কথা ভুলে যাই।

যেমন ধরুন, এই করোনা প্রোকোপে পড়ে অনেকেই মারা যাচ্ছেন, আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতিদিন নানান ভিডিও আসছে ইনবক্সে, যার বেশিরভাগই লাইভ ভিডিও করা। যার মধ্যে থাকছে- এই করোনার ভয়াল থাবা সম্পর্কে, সেকী ভয়ঙ্কর অবস্থা...! কেউই বাঁচতে পারছে না, কাউকেই বাঁচতে দিচ্ছে না, কেউই রেহাই পাচ্ছে না। এখনও এর হাত থেকে বাচার কোনও পথ, ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, হেন তেন এটা সেটা...!

এর অর্থ হচ্ছে- (নাউজুবিল্লাহ -আল্লাহ মাফ করুন) এটা মহান আল্লাহর থেকেও শক্তিশালী হয়ে গেছে বা এমনই কিছু বুঝায় তা দ্বারা। এখানেই মূলত ইমানের বিপর্যয় ঘটছে। এ রকম হাজারোভাবে এতে ব্যক্তি যেমন নিজেও আতঙ্কিত, তেমনি তার মাধ্যমেই আরও অনেকে আতঙ্কিত হচ্ছে, আর নিজেদের ইমান নষ্ট করছে। আরে ভাই, মানুষ তো জন্মেছে মরার জন্যই। আপনার চারপাশেই তো অনেক লোক অনেক ভাবেই মারা যাচ্ছে। কেউ শিশু তো কেউ বুড়ো, কেউ বালক তো কেউ যুবক, কেউ নতুন বিয়ে করে বউ রেখে, কেউবা একটা বা দুটো সন্তান রেখে...! আবার মৃত্যুও হচ্ছে হরেক রকমের।

প্রত্যেকটা মৃত্যুতেই আপনি আমি আফসোস করছি, নানান কথা বলছি... অকাল মৃত্যু, এ কেমন মৃত্যু, কি হবে ওই পরিবারের, বাচ্ছা দুটো নিয়ে এখন কি করবে ওই বেচারী, হেন তেন এটা সেটা...! একবারও কেউই ভেবে দেখছি না যে, আসলে আমরা কী বলছি আর কেনইবা তা বলছি...! অথচ কিছু দিন কিছু বছর পর দেখা যায় দিব্যি চলছে সবার জীবন। তবে এখানেও অনেক কথা আছে...

কেউ অল্পতে তুষ্ট হয়, আবার কেউ গাড়ি বাড়ি প্রভাব প্রতিপত্তি হাসিল করেও তুষ্ট নয়। এটাও এক ধরনের পরীক্ষা। আসলে মানুষের জীবনের প্রতিটা মুহুর্তই হলো পরীক্ষা ক্ষেত্র। যে এটা বুঝে তার কাছে কিছু থাক বা না থাক, সে নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করে। আর যে এটা বুঝে না তার কাছে বিশাল কিছু থাকলেও সে নিজেকে প্রস্তুত করার সময়ই পায় না। মুল বিষয় হলো নিজেকে সর্বদা প্রস্তুত রাখা, সতর্ক থাকা, আর নিজের কাজ করে যাওয়া। বিশ্বাসীরা তো জানেই যে, ভালো কাজ করলে ফলটা সে ভালোই পাবে। আর খারাপের পরিণতি সে তো ভয়াবহ। তাই সে সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করে। তবে শয়তান কিন্তু একজন আছে, সে কিন্তু বসে থাকে না। তাই তাকে চেনাটাও বিশ্বাসীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক- সাংবাদিক

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি