ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪

সাংবাদিকতায় ঝুঁকি এবং প্রণোদনা 

জসিম উদ্দিন খান

প্রকাশিত : ১৪:০৮, ১৮ এপ্রিল ২০২০

জসিম উদ্দিন খান

জসিম উদ্দিন খান

করোনা আক্রান্ত দেশে ঘরে আটকেপড়া কর্মহীন নিম্ন আয়ের মানুষদের সরকার সাহায্য করবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা বা ঋণ সুবিধা দিবে এটাও স্বাভাবিক। যারা ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় জীবন বাজি রেখে মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন যেমন ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সেনাবাহিনী, ব্যাংকার তাদের বিশেষ ভাতা দেয়া হবে এটাও স্বাভাবিক। কারণ তারা দেশের জন্য, মানুষের সেবায় কাজ করছেন।

আমাদের দেশে গণমাধ্যমগুলোতে কর্মরত সাংবাদিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও তারা কোন ভাতা বা প্রণোদনা পান না। দীর্ঘ ৩০ থেকে ৪০ বছর কাজ করে একজন অবসরে যাওয়া সাংবাদিকের অনেকটা খালি হাতে বিদায় নিতে হয়। আবার কঠিন কোনো অসুস্থ হলেও অর্থের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয়। 

কখনো কখনো হয়তো বন্ধু-বান্ধব শুভাকাঙ্খীরা চারদিক থেকে চাঁদা তুলে চিকিৎসার ব্যবস্থার করেন। তবে, এখন সাংবাদিক কল্যাণ সংস্থা থেকে কিছু কিছু সাহায্য করা হয়। তবুও বলা যায়, সাংবাদিকরা এখনো আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। 

গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব আলোচনা উঠে এসেছে। সাংবাদিক নেতারা সরকারের কাছে ঝুঁকি ভাতা বা প্রণোদনা দাবি করছেন। যা খুবই সময়পোযোগী দাবি। 

বিভিন্ন সাংবাদিকের ফেসবুক ওয়াল ও স্ট্যাটাস দেখলে মনে হচ্ছে, সরকার যে সাংবাদিকদের কোন প্রণোদনা দিচ্ছে না এটা একটা বিরাট সংকট। আলোচনায় আসছে সাংবাদিকদের ঝুঁকি ভাতা দেয়া নিয়েও। অনেক সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ তারা গার্মেন্টসের শ্রমিকদের মতো সরকারি তরফ থেকে বেতনের জন্য বরাদ্দ চাচ্ছেন। 

এখন প্রশ্ন আসে সাংবাদিকদের ঝুঁকি ভাতা বা প্রণোদনা কে বা কারা দিবেন। এ বিষয়েও অনেক যৌক্তিক বিতর্ক আসবে। কেউ বলবেন সরকার দিবেন, আবার কারো মতে মালিক বা কর্তৃপক্ষ দিবেন। সাংবাদিকদের ঝুঁকি, অধিকার, দাবি তথা চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আমার কিছু মতামত আজ এখানে তুলে ধরছি। 

কাউকে আঘাত করা বা আক্রমণ করা আমার কোন উদ্দেশ্য নয়। বলতে পারি একজন সাংবাদিকতার ছাত্র বা সাংবাদিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণেই এসব ভাবনা। প্রথমেই বলে নিই, সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড বা চাকরি নীতিমালায় এই ঝুঁকিভাতার ব্যাপারে স্পষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন ছিল। সাংবাদিকরা নেতারা সেটা করতে পারতেন। 

ঢাকায় এখন কত সংবাদপত্র আছে বা প্রকাশিত হয় সেটা আমার তেমন জানা নেই। তবে জানা মতে প্রায় ৫শ’র মতো দৈনিক সংবাদপত্র সরকারি মিডিয়াভুক্ত। যার মধ্যে ১০০টির মতো দৈনিক সংবাদপত্র কাগজে কলমে দেখিয়ে থাকে, তারা অষ্টম ওয়েজবোর্ড অনুসারে বেতন ভাতা দেন। অর্থাৎ, তারা কাগজে কলমে বেতন দেয়া এবং বেশি সার্কুলেশন দেখিয়ে সরকার থেকে সুযোগ সুবিধা আদায় করেন। 

এতে সাধারণ সাংবাদিকরা উপকৃত না হলেও তথাকথিত সম্পাদক মালিকরা লাভবান হয়ে থাকেন। এছাড়া প্রায় ৩০টির বেশি টেলিভিশন, ডজন দুয়েক কমিউনিটি রেডিও, কয়েক হাজার ওয়েব পোর্টাল আছে। এসব বেশি সার্কুলেশন দেখানো আন্ডার গ্রাউন্ড গণমাধ্যমে কারা সাংবাদিকতা করেন বা কারা সম্পাদক, এদের যোগ্যতা কী, এসব বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। তবে এ কথা সত্য যে, সংখ্যায় অগণিত সাংবাদিকরা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছেন। 

প্রকৃত মূলধারার সাংবাদিকরা যারা কাজ করেন তারা সুযোগ সুবিধা পাবেন এটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এক ধরণের নামকাওয়াস্তে সাংবাদিক গোষ্ঠী আছেন, প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় তদবির করে বেড়ানোই যাদের মূলকাজ। তাদের নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করি। কারণ, এসব সাংবাদিকদের কারণেই প্রকৃত সাংবাদিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

বড় বড় সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের মালিকদের দিকে তাকালে স্পষ্ট হবে তাদের বেশিরভাগই দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা। বড় মালিকদের বড় সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের সাংবাদিকরা কেন ঝুঁকির মধ্যে থাকবেন? এসব মালিকদের ব্যাংক বা অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তো ঝুঁকিতে নেই। তারা সকল সুযোগ সুবিধা পেয়ে থকেন। তাহলে বুঝতে হবে সাংবাদিকরাই তাদের অধিকার, সুযোগ সুবিধা আদায় করতে পারেননি।

অথবা অন্যভাবে বলা যায়, সিনিয়র সাংবাদিক কর্তারা নিজেদের সুযোগ সুবিধা আদায়ে এতো বেশি ব্যস্ত ছিলেন যে, মাঠে কাজ করা সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে বেশি চেষ্টা করেননি। তাহলে এখানে আমরা একথা স্পষ্ট করে বলতে পারি, আমরাই আমাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছি। 

আমরা যদি পেছনে ফিরে দেখি গত এক দশকে দেশে টেলিভিশন, সংবাদপত্র, অনলাইনের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। আর সাংবাদিকও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত এত সংবাদপত্র ও সাংবাদিক দেশের উন্নয়নে বা জাতীয় প্রয়োজনে তাদের অবদান কী। অর্থাৎ, তারা প্রকৃতপক্ষে কী কাজ করছেন সেটা যাছাই করা দরকার। কোন রকমের যেনতেন ভাবে কাট পেস্ট করে পত্রিকা বের করে নিজেরা হ্নষ্ট, পুষ্ট হবেন সেটা দেখার কী কেউ থাকবে না!

সংবাদপত্রকে দেশের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। অর্থাৎ দেশের লেজিসলেটিভ (সংসদ) প্রথম স্তম্ভ, নির্বাহী বিভাগ (জনপ্রশাসন, পুলিশ, মিলিটারি), দ্বিতীয় স্তম্ভ, বিচার বিভাগ (জজ কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট), তৃতীয় স্তম্ভ এবং সংবাদপত্র বা সংবাদিকতা হচ্ছে চতুর্থ স্তম্ভ। এই যে চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব হিসেবে বিগত ১০ বছরে এসব সাংবাদিকরা কী কী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। 

তারা কি দেশের গণতন্ত্র নির্ভেজাল রাখার জন্য সরকারকে যথাযথ পরামর্শ বা দিক নির্দেশনা দিয়েছে? ঘুষ, দুর্নীতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা কি সমালোচনা করেছে বা সংবাদ প্রকাশ করেছে? তারা কি দেশের বিভিন্ন দপ্তরে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি অন্যায় সেগুলো ঠিক ঠিক ভাবে তুলে ধরেছে? মানুষের কষ্ট, যন্ত্রণা তুলে ধরেছে?

প্রথম শ্রেণির ১২/১৫ টি সংবাদপত্র যাদের প্রচার সংখ্যা ৫ লাখ থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত এবং যারা মোটামুটি নিয়মিত বেতন দেয় সেই সকল সংবাদপত্র ব্যাতিরেকে বেশিরভাগ সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কি করেছে। কখনো কি তারা ভূমি দস্যু, ক্যাসিনো ও নারী ব্যবসায়ী হাইব্রিড কতিপয় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কোন ভূমিকা পালন করেছে? 

এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা উল্লেখ করছি, আমাদের দেশে একরকম সাংবাদিক বা সম্পাদক আছেন যাদের অন্যকোন পেশায় যাওয়ার সুযোগ নেই এমন সব লোকদের সাংবাদিক বানিয়েছেন বা এখনো বানাচ্ছেন। এসব লোকেরা সাংবাদিক সাইনবোর্ড লাগিয়ে সারা শহর দাপিয়ে বেড়ায়। এসব সাংবাদিকরাই কখনো মাদক ব্যবসায়ী, মাদক চোরাচালানীদের সহযোগিতা করেছে।  ভূমি দস্যুদের আকাম/কুকামে সহযোগিতা করে থাকে। কখনো চাঁদাবাজি করেছে দুর্নীতিবাজ পুলিশের কাছে, এলজিইডি প্রকৌশলীদের কাছে, কাস্টমস আর কর কর্মকর্তাদের কাছে। 

যেখানেই কোন দুর্নীতি আপরাধ সেখানেই এসব সাংবাদিক হাজির। সম্রাট, খালেদ, পাপিয়াসহ সবাই সাংবাদিক পুষেছে। সম্রাটের পয়সা ছাড়া অনেক সাংবাদিক সংগঠনের কোন অনুষ্ঠানই হতে পারেনি। এজন্যই আজ দেশে একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে ভাত ছিটালে সাংবাদিকের অভাব হয় না।

এখন আসি আমাদের সাংবাদিক নেতাদের প্রসঙ্গে। একেকটা সংগঠনের নির্বাচন আসলে স্পষ্ট হয় সাংবাদিক নেতার সংখ্যা কত বৃহৎ। সবার একটা গুরু দায়িত্ব সাংবাদিকদের জন্য কিছু করা। অথচ, সাংবাদিকদের অসহায়ত্ব দেখলেই স্পষ্ট হয় তারা কি করেছেন। 

আবার অনেক সাংবাদিক নেতারা দিনে দিনে নিজেদের উন্নতি করলেও পেশাদার সাংবাদিকদের উন্নয়নে তেমন কিছু করেননি। তাদের দাপট সবখানে। পেশার উন্নয়নে বা সাধারণ সাংবাদিকের উন্নয়নের তাদের ভূমিকা কখনো দেখা যায় না। তবে, তারা অযোগ্য, অথর্ব্য সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নিজেরা লাভবান হন। আবার অনেক সাংবাদিক নেতা একখণ্ড সরকারি জমি উপহার হিসেবে পেয়েছে আর হাইব্রিড নেতাদের দালালী করে গেছে। 

একথা জোর দিয়ে বলা যায়, বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গণমাধ্যম বান্ধব একজন মানুষ। সাংবাদিকদের প্রয়োজনে তিনি সবসময় উদার। সাংবাদিক নেতারা সাংবাদিকদের পেশাগত ঝুঁকি মোকাবেলায় যদি গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ তার কাছে প্রস্তাব করতো, সেটা এতোদিনে অবশ্যই বাস্তবায়িত হতো। সত্যিকারের পেশাদার সাংবাদিকদের কল্যাণে এখনও যেকোন বিষয়ে তিনি এগিয়ে আসবেন বলে অমাাদের বিশ্বাস।  

আমার এসব কথায় আমাদের অনেক সাংবাদিক নেতা বিরক্ত হতে পারেন। তবে এ কথা সত্য যে, বাস্তবতা কারো পছন্দের উপর নির্ভর করে না। এই যে মহামারিতে সাংবাদিকদের অসহায়ত্ব, এটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।

আজ যদি আমাদের সিনিয়র সাংবাদিক বা সাংবাদিক নেতারা অন্তত গত দশ বছরে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতেন তাহলে সাংবাদিকদের আজকে-এ অবস্থা থাকতো না। আবারো বলছি, মালিকরা তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি, বোনাস কিংবা প্রণোদনা দিতে পারলে সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে দিবেন না কেন? 

আর প্রধানমন্ত্রী থেকে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের জন্য কোন প্রস্তাব বা সুবিধা চেয়ে পাওয়া যায়নি এরকম ঘটনাতো কেউ শুনেনি। আজ যদি বলি সংগঠন করার নামে পিকনিক বা অনুষ্ঠান করার জন্য চাঁদাবাজি না করে সাংবাদিকদের প্রকৃত কল্যাণে কাজ করতো, তাহলে আজকে এই অসহায়ত্ব দেখতে হতো না। দুস্থ সাংবাদিক না বানিয়ে সুস্থ ও দক্ষ সাংবাদিক বানালে দেশেরও লাভ হবে। 

লেখকঃ গণমাধ্যমকর্মী ও ব্যাংকার 

এআই/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি