প্রশাসন করোনাযুদ্ধ ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে
প্রকাশিত : ১২:৪৪, ২৯ এপ্রিল ২০২০
সাব্বির আহমেদ
এ পর্যন্ত যে কয়টি দেশ লকডাউন শিথিল করেছে তাদের মধ্যে শুধু নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া তা যথার্থভাবে করেছে। তাদের দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যখন একেবারে কমে এসেছে, শূন্যের কাছাকাছি এসেছে তখনই শুধু তারা লকডাউন শিথিল করেছে। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা–এরা লকডাউন শিথিল করেছে লাফিয়ে লাফিয়ে (exponential rate) আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি রোধের পরে।
ব্যবসায়ীদের প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাজ্য এখনও লকডাউন শিথিল করেনি। এখনও ইউরোপ আর আমেরিকায় বেড়ে চলছে আক্রান্তের মিছিল। করোনায় বেশি আক্রান্ত ইউরোপের একেকটি দেশে এখনো প্রতিদিন ২থেকে ৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। আমেরিকায় গত দশ দিনে গড়ে প্রতিদিন আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২৯ হাজার মানুষ।
আমাদের দেশে এখন দৈনিক ৪/৫ ’শ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যান্য দেশের করোনা প্রবণতার সঙ্গে তুলনা করে বলা যায় সামনের দিন গুলোতে এখানে লাফিয়ে লাফিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। সামনের দুই সপ্তাহ বেশি ক্রিটিক্যাল। মে মাসের ১৫ তারিখের পর দেশে করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা ভাল করে বোঝা যাবে। দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণও একই মতামত দিচ্ছেন। জাতিসংঘ বারবার লকডাউন শিথিল না করার পরামর্শ দিচ্ছে। মিডিয়ায় তা প্রচারও হচ্ছে। তবুও এখানে প্রতিদিন নতুন নতুন অফিস, আদালত, ব্যবসা, কারখানা, রেস্টুরেন্ট খুলে দেওয়া হচ্ছে আগাপাশতলা না ভেবেই। কার স্বার্থে? কার পরামর্শে? লকডাউন চললে গরীব মানুষের কষ্ট হয়। গরীবের কষ্ট লাঘব করার জন্য প্রধানমন্ত্রী খাদ্য আর নগদ সহায়তা দিতে বলেছেন। তা করা হচ্ছে না–খাদ্য সাহায্য অপ্রতুল, নগদের খবর নেই। লকডাউন তুললে লাভ হয় বিগ বিজনেসদের।
লকডাউন কখনোই দেশে ঠিকভাবে কার্যকর হতে পারেনি। মানানো যায়নি শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নীতি। ফলাফল হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর হার অনেক বেশি। বাংলাদেশ ইউরোপ-আমেরিকা নয়। তাদের থেকে এখানকার আলো, বাতাস, জল, আদ্রতা, শারীরিক গঠন, খাদ্যাভ্যাস, ইমিউন সিস্টেম অনেক আলাদা। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা হবে না। বাংলাদেশের তুলনা করতে হবে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, ইত্যাদি দেশের সঙ্গে। তাদের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি অনেক খারাপ। রাস্তায়, কারখানায়, ত্রাণ বিতরণে, কাঁচাবাজারে মানানো যাচ্ছে না শারীরিক দূরত্ব রক্ষার নীতি। হাসপাতালে ঠিকমত চিকিৎসা পাচ্ছে না রোগীরা-ডাক্তার আসে না, নার্সদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অনলাইনে কল দিলে তিনদিন পর আসে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা নিতে। পরীক্ষার ফল জানাতে আরও বেশি সময় লাগছে। এখনো একতৃতীয়াংশ ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীরা পায়নি স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপকরণ। হচ্ছে না পর্যাপ্ত পরীক্ষা। এমন কি মৃত্যুর পর পরিবারের হাতে লাশ ফিরিয়ে দিতেও ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা সময় নিচ্ছে হাসপাতালগুলো।
রাস্তার পাশে বুভুক্ষ মানুষের লাইন দিন দিন বড় হচ্ছে। এখনো ত্রাণ আর ১০টাকা কেজির চাল পৌঁছায়নি অনেক গ্রামে। যেসব জায়গায় পৌঁছেছে সেখানে একবার পেলেও দ্বিতীয়বার পাবার হদিস নেই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কর্মহীন ও দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়নি নগদ অর্থ। সে উদ্যোগ কবে বাস্তবায়ন হবে, কি পরিস্থিতিতে আছে তা কেউ জানে না। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ব্যবসায়ীদের জন্য জন্য দেয়া ঋণ প্রণোদনা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা ঘোষণা করে দিয়েছিল সপ্তাখানেকের মধ্যে। নীতিমালা, তালিকা হচ্ছে না গরীবের অর্থ প্রাপ্তির বেলায়।
করোনাযুদ্ধের পুরো ব্যবস্থাটা আমলাদের হাতে–জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপণা মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়–এরাই চালাচ্ছে করোনা যুদ্ধ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এদের ব্যর্থতা স্পষ্ট।
প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে আছে আমলারা, তাদের পেছনে পুঁজিবাদী সুশীল, তারও পেছনে পুঁজির মালিক স্বয়ং। জনপ্রতিনিধিদের, রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা নেই, ক্ষমতা নেই। ২০-৫০ জনকে চাল চুরির অপরাধে ফাঁসিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের সকলকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। ৬১ হাজারের বেশি জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে চাল চুরির অভিযোগ উঠেছে মাত্র ২০/৫০ জনের বিরুদ্ধে যারা মোটের এক শতাংশও নয়। চালচুরি শুরু হয় প্রশাসকদের হাতে শেষ হয়েছে মাত্র কয়েকজন পৌর মেয়র, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর আর ডিলারদের হাতে। ডিলাররা জনপ্রতিনিধি নন। তাদের বিচারও হয়েছে। চাল চুরি থেমেছে। চাল চুরির বেশিরভাগ করেছে প্রশাসকেরা। প্রতিটি বস্তায় তারা কয়েক কেজি চাল কম দিয়েছে। তারপরেও চোরের তকমা নিতে হয়েছে; সাইজ করা হয়েছে সকল জনপ্রতিনিধিকে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে। ৬৪ জেলায় করোনা নিয়ন্ত্রণের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে ৬৪ জন আমলাকে, ৬৪ জন জননেতাকে নয়। স্থানীয় পর্যায়ের দ্বায়িত্ব জেলা প্রশাসকের, জনপ্রতিনিধিদের নয়। করোনা মোকাবেলায় জাতীয় কমিটির সকলেই প্রশাসক একমাত্র ব্যতিক্রম কমিটি প্রধান যিনি আবার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত। এরকম একটা ধনতান্ত্রিক (plutocratic) ব্যবস্থায় জনস্বার্থ, জনকল্যাণ উপেক্ষিত হবে–এটাই স্বাভাবিক।
ইউরোপ-আমেরিকা ব্যবসায়ীরা চালায়। তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য মৃত্যুর মিছিলের তোয়াক্কা না করে তারা লকডাউন শিথিল করছে। সেসব দেশে মানুষের প্রাণের চেয়ে পুঁজির স্বার্থের দাম বেশি – একথা আগে জানতাম। তাদের হিসেব হচ্ছেঃ কত মৃত্যুর বিনিময়ে কত বিলিয়ন ডলার রক্ষা করা যায়- এ রকম। জীবন বনাম ডলার। ভাবতাম বাংলাদেশে ও রকমভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে না; বাংলাদেশ গরীব হলেও এখানে মুনাফার চেয়ে মানুষের প্রাণের দাম বেশি আছে। আস্থা ছিল শেখের বেটির উপর। আস্থায় চিড় ধরেছে।
সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। চিন্তা-ভাবনা লাইনে নিয়ে আসা দরকার। শুধু প্রশাসকেরা এই পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন না। তারা ভুল পথে দেশকে পরিচালিত করছেন; করোনাযুদ্ধে দেশকে পরাস্থ করে তুলছেন। জনপ্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ এবং প্রশাসকদের সমন্বয়ে একটা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন একশনগ্রুপ দরকার। যারা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সার্বক্ষনিক করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনের দায়িত্বে থাকবেন, প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেবেন এবং আমলাদের মাধ্যমে জনকল্যাণে গ্রহিত সিদ্ধান্ত সমূহ বাস্তবায়নে কাজ করবেন। জেলায় জেলায় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, প্রশাসক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে কমিটি রয়েছে। সে কমিটিকে ক্ষমতায়ণ করে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার দ্বায়িত্ব দিতে হবে। অন্যথায় কারখানায়-কারখানায়, ঘরে-ঘরে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে যেতে পারে। সে রকম সম্ভাবনা যথেষ্ট। আর সে মিছিল শুরু হলে তার দায় প্রশাসক, সুশীল, পুঁজিপতি নেবে না। দায় নিতে হবে সরকার প্রধানকে। সে দায় অল্প-স্বল্প হবে না।
লেখকঃ চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড।
এমবি//
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।