ঢাকা, শুক্রবার   ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

কল্পনা : মনের চালিকা শক্তি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৫:৫৬, ২০ জুলাই ২০২১

Ekushey Television Ltd.

কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতে কার না ভালো লাগে। এমন কে আছেন যিনি আকাশ-কুসুম কল্পনায় মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে না ফেলেন। কল্পনাবিলাসী বলে বদনাম রয়েছে এমন লোকের সংখ্যাও তো নেহাত কম নয়। পড়তে বসে কল্পনায় হারিয়ে গিয়ে পিতা-মাতার গালমন্দ খায় নি এমন ছেলে-মেয়ের সংখ্যা নেহাতই কম বলা চলে। 

কল্পনা একটা গুণ হিসেবে আমাদের সমাজে একেবারে অবহেলিত। কল্পনা আমাদের সমাজে গণ্য হয় এক পরিত্যাজ্য বিষয় হিসেবে। কল্পনা আর আকাশ-কুসুম অলীকতাকে (Fantasy) এক করে দেখা হয় অথচ মানব সভ্যতার আজকের অগ্রগতির মূল ভিত্তি হচ্ছে কল্পনা। মানুষ কল্পনা করতে না পারলে কিছুই সৃষ্টি করতে পারত না, বানাতে পারত না, আবিষ্কার করতে পারত না। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান সবই মুখ থুবড়ে পড়ে যেত। তাই বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, ‘জ্ঞানের চেয়েও কল্পনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

অভিধানে কল্পনার সংজ্ঞা হচ্ছে, মনের ছবি তৈরির ক্ষমতা। চোখের সামনে উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও কোনো কিছুর মানসিক চিত্র (Mental image) তৈরির প্রক্রিয়া; স্মৃতি থেকে ছবি পুনরায় তৈরির মানসিক ক্ষমতা, মনের পুনঃসৃজন ক্ষমতা। কল্পনার অর্থ অভিধানে যা-ই থাক না কেন-আমাদের বাস্তব জীবনে কল্পনা হচ্ছে বাস্তবতার তোরণ। কল্পনাশক্তি আছে বলেই আমরা যা চাই তা করতে পারি, যা চাই তা হতে পারি। 

আমাদের বস্তুনিষ্ঠ জীবনও মূলত প্রভাবিত হচ্ছে কল্পনা বা কল্পদৃষ্টি বা কল্পচিত্র দ্বারা। একজন কেমিস্ট রাসায়নিক অণুগুলো কীভাবে একটা অন্যটার সাথে সংযুক্ত হয়েছে তা দেখার জন্যে কল্পচিত্র (Imagery) ব্যবহার করে থাকেন। 

একজন ফ্যাশন ডিজাইনার পোশাক তৈরির আগেই মডেলের গায়ে তা পরালে কেমন লাগবে তা কল্পনায় দেখে নেন। একজন শিল্পীর ছবির পুরোটাই আসে কল্পনা থেকে। একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী সাব-এটমিক পার্টিকেলের জগৎকে বোঝার জন্যে কাল্পনিক মডেল তৈরি করেন। 

দাবাড়ু খেলার কৌশল নির্ধারণেও ব্যবহার করেন কল্পচিত্র। পরিবহন কর্মকর্তারা কোনো কিছু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে কীভাবে স্থাপন করবেন, তা আগেই কল্পনা করে নেন। একজন সফল ডাক্তার রোগীকে অপারেশন করার আগেই কল্পনায় দেখে নেন পুরো দৃশ্যটা। 

তাই ড. কার্ল গুস্তব ইয়াং বলেছেন, ‘কল্পনার কাছে আমাদের ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয়।’

সত্যিকার অর্থে মেন্টাল ইমেজ বা মনের ছবি হচ্ছে একটি বস্তু বা বিষয়ের অনুকরণে মনের তৈরি ছবি। আপনার একান্ত কল্পনার জগতে আপনি বাস্তবে সামনে নেই এমন জিনিসের যেমন চিত্র দেখতে পান, তেমনি শুনতে, গন্ধ শুঁকতে, স্বাদ গ্রহণ ও অনুভব করতে পারেন। 

আপনি একটি গাঁদা ফুল বা গোলাপ ফুল হাতে ধরে না রেখেও কল্পনায় পুরোপুরি এর ছবি আঁকতে পারেন। বস্তু বা পদার্থ ছাড়াও মনের কল্প ছবি বর্ণনা করতে পারে স্বাধীনতা, মুক্তি, সৌন্দর্য বা আনন্দের স্বরূপ।

মনের ছবি তৈরির ক্ষমতা একেকজনের একেক রকম। যেমন এসি জেনারেটর ও ফ্লুরোসেন্ট বাতির আবিষ্কারক নিকোলাস তেসলার মনের ইমেজ তৈরির ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনি মনের চোখে নিয়মিত সব জটিল জটিল যন্ত্রপাতির ত্রিমাত্রিক ইমেজ দেখতেন। যন্ত্রপাতিগুলো খুঁটিনাটি সবকিছু নিয়ে পরিপূর্ণ এবং ব্লু-প্রিন্টের মতো সুস্পষ্ট। 

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে তেসলা এই যন্ত্রপাতিগুলোর কার্যকারিতা মনে মনেই টেস্ট করতেন। কয়েক সপ্তাহ মনের মধ্যেই চালিয়ে এর পার্টসগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা পরীক্ষা করতেন। বিজ্ঞানী তেসলা অবশ্য ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাধর কল্পচিত্রকর। 

মনে দেখা ছবি তার কাছে চোখে দেখা ছবির মতোই ছিল উজ্জ্বল। যার ফটোগ্রাফিক মেমোরি রয়েছে, শুধুমাত্র তার পক্ষেই এত সুস্পষ্ট কল্পচিত্র তৈরি সম্ভব। যার ফটোগ্রাফিক মেমোরি রয়েছে এমন যে-কেউ সংবাদপত্রের পাতার ওপর কয়েক সেকেন্ড দৃষ্টি বুলিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পুরো পৃষ্ঠাটাই মনের চোখে পড়ে যেতে পারেন। এদের মনের ছবিও হয় নিখুঁত ও দীর্ঘস্থায়ী। 

আমরা জানি, কল্পনা জ্ঞানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এখন দেখুন না আপনি কতটুকু ভিজুয়ালাইজ করতে পারেন! আপনার মনে সৃষ্ট ইমেজ কী সুস্পষ্ট ও স্থায়ী, না অস্পষ্ট ও ক্ষণস্থায়ী? ইমেজটি কি ত্রিমাত্রিক বাস্তব না টেলিভিশনের ছবির মতো ফ্ল্যাট? 

রঙ কি আপনি স্পষ্ট দেখতে পান? না আপনার ছবি আসে সাদা-কালোতে? ভিজুয়ালাইজ করার সামর্থ্য জনে জনে ভিন্ন, কেউ কেউ একেবারে ত্রিমাত্রিক ছবি দেখেন। আবার কেউ কেউ কোনো ছবিই দেখেন না। কেউ কেউ চিন্তাই করেন ছবির মাধ্যমে। আবার কেউ কেউ মনের চোখে কিছুই দেখেন না, মনে মনে কথা বলেন মাত্র।

মনোবিজ্ঞানীরা ভিজুয়ালাইজ করার সামর্থ্যকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমত, স্পষ্টতা। অর্থাৎ ইমেজ কত উজ্জ্বল, স্পষ্ট ও প্রাণবন্ত। দ্বিতীয়ত, স্থিরতা। অর্থাৎ ইমেজ কতটা স্থির ও নিশ্চিত অবস্থায় থাকে। আর দুটোই একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। স্পষ্টতা যোগ করতে পারলে আপনার ইমেজ হবে রঙিন, ত্রিমাত্রিক ও বাস্তব। স্থিরতা যোগ করতে পারলে তা হবে স্থির ও সুনির্দিষ্ট।

মনস্তত্ত্ববিদ ফ্রান্সিস গ্যাল্টন কল্পনা শক্তির স্পষ্টতা পরীক্ষার জন্যে একটি প্রশ্নমালা তৈরি করেছিলেন। এ প্রশ্নমালার জবাব দিয়ে আপনিও আপনার মনের ইমেজ তৈরির ক্ষমতা যাচাই করে দেখতে পারেন।
অনুশীলন : ভোজ

দৃশ্যটি কল্পনা করতে ২ মিনিট সময় ব্যয় করুন। দাওয়াত খাওয়ার জন্যে আপনি গেছেন কারো বাসায়। খাবার টেবিলে সমবেত মেহমানদের ভিজুয়ালাইজ করুন, পরিবেশ ভিজুলাইজ করুন, টেবিল সজ্জা, খাবারের স্বাদ ও কী কী আওয়াজ শুনেছেন ভিজুয়ালাইজ করুন। দুমিনিট সময়ে আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি ছবি তৈরি করুন। এবার মনে যে ছবি তৈরি হলো তার ভিত্তিতে নিচের প্রশ্নগুলোর জবাব লিখুন- 

১. আপনার ছবি স্পষ্ট না অস্পষ্ট?
২. মূল দৃশ্যের চেয়ে ছবি কি উজ্জ্বল না অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল?
৩. পুরো দৃশ্যটা কি একই সাথে সুনির্দিষ্ট অবস্থায় ছিল না কোনো অংশ অন্য অংশের চেয়ে স্পষ্ট ছিল?
৪. ছবি কি রঙিন ছিল না সাদা কালোর শেডে ছিল?
৫. ছবি রঙিন হয়ে থাকলে রঙের মিশ্রণ কি সঠিক ছিল?
৬. পুরো খাবার ঘরের অখণ্ড ছবি কি আপনি তৈরি করতে পেরেছিলেন?
৭. আপনি কি আপনার খাবারের প্লেটের ছবি একইভাবে ধরে রাখতে পেরেছিলেন? যদি তা-ই হয় তাহলে কি প্লেটের ঔজ্জ্বল্য বেড়েছিল?
৮. আপনি কি খাবারের প্লেট ও আপনার মুখোমুখি যিনি বসেছিলেন, তাকে একই সাথে দেখতে পেয়েছিলেন?
৯. আপনি কি খাবারের ঘ্রাণ পাচ্ছিলেন?
১০. আপনি কি সবার পোশাক শনাক্ত করতে পারছিলেন?

অনুশীলনের পর কেমন অনুভব করছেন? সম্ভবত আপনার কল্পচিত্রের অংশবিশেষ স্পষ্ট ছিল। আর অংশবিশেষ অস্পষ্ট। হয়তো আপনি মেহমানদের চেহারা স্পষ্ট দেখেছেন, কিন্তু তৈজসপত্রের ধরন ভুলে গেছেন। খাবারের গন্ধ পেয়েছেন, কিন্তু স্বাদ অনুভব করতে পারেন নি। অথবা দাওয়াতের কোনো ইমেজ না দেখে শুধুমাত্র ধারণাকে নিজের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন।

মনে ছবি যত পরিষ্কারই আসুক, আমাদের মনের ছবি সঠিক হয় খুবই কম। প্রতিদিনের চির-পরিচিত যে-কোনো কিছুর ছবি আঁকতে যান, তাহলেই বুঝতে পারবেন আপনার মনের ছবির মধ্যে ফাঁক কতখানি! 

মূল বস্তুকে আপনি কত গভীরভাবে দেখেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন, তার ওপরই নির্ভর করবে আপনার মনের ছবি তৈরির ক্ষমতা। কোনো বস্তুকে পরবর্তী সময়ে সুস্পষ্ট ভিজুয়ালাইজ করতে চাইলে আপনি সেটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন, আমি বাস্তবে কী দেখছি। কয়েক মুহূর্ত ব্যয় করুন এর পুরো আকৃতি দেখতে। এটি কতটা উজ্জ্বল বা অন্ধকার? এর আকৃতি দেখে কী অনুভূতি হচ্ছে আপনার? 

এই বস্তুটি আপনাকে অন্য কোনো কিছুর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে কি? এবার বস্তুটিকে ভাগ ভাগ করে অংশ হিসেবে দেখুন। প্রতিটি অংশের বিশেষত্ব বুঝতে চেষ্টা করুন। নানাভাবে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখুন। একসময় দেখবেন বস্তুটি সম্পর্কে আপনার এক স্বচ্ছ ধারণা ও অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। কোনোকিছু যত দেখবেন, যত জানবেন, তত সহজে তার ছবি মনে সৃষ্টি করতে পারবেন।

মনে কোনো কিছুর সুস্পষ্ট ছবি তৈরি করতে চান? প্রথমে আপনার বিশ্লেষণলব্ধ জ্ঞানকে স্মৃতি থেকে বের করে নিয়ে আসুন। আপনার সামনে ছবিটিকে গড়ে উঠতে দিন। ভিজুয়ালাইজ করার অভ্যাস না থাকলে এটা প্রথমদিকে কষ্টকর মনে হতে পারে। কিন্তু আপনি নিজেকে ভিজুয়ালাইজ করার সময় দিন, দেখবেন উজ্জ্বল ও স্থির ছবি গড়ে উঠছে আপনার মনের চোখের সামনে।
লেখাটি কোয়ান্টাম মেথডের প্রবক্তা মহাজাতক এর মেডিটেশন বই থেকে সংগ্রহ।
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি