৭১তম জন্মদিনে আওয়ামী লীগ ও আলোর মিছিলে বাংলাদেশ
প্রকাশিত : ২৩:২৮, ২২ জুন ২০২০ | আপডেট: ০৯:২৮, ২৩ জুন ২০২০
২৩শে জুন। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই করোনাকালেও এবারের ২৩শে জুন গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্য্যময়। সভ্যতার ইতিহাসে একটি বড় দুঃসময় অতিক্রম করছে পৃথিবী। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ যখন ক্ষুধা, দারিদ্রের অভিশাপ মুক্ত হয়ে উন্নয়নশীল দেশের তকমা পরিহার করে একটি আত্মসম্মানজনক, মধ্যআয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দোরগোড়ায়, সেই সময় কোভিড-১৯’র আঘাতে আবার হোঁচট খাচ্ছে। জানি না এই মরণঘাতি মহামারি আর কত ভোগাবে, তবে আমি আত্মবিশ্বাসী।
ভূমিষ্ঠকাল থেকে রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে বেড়ে ওঠা বাঙালি ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় এখন অন্যতম বেস্ট সারভাইবল ন্যাশন অন দ্যা আর্থ। ভৌগলিক কারণে জলবায়ুর হিংস্রতার বিপরীতে এই আসমুদ্রহিমাচলে সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বের বৃহত্ত্বম ব-দ্বীপ, সুজলা-সুফলা এই বঙ্গভূমি। ঐশ্বর্য্যশীল এই বঙ্গীয় জনপদে আবহমানকাল থেকেই ভিনদেশী লুটেরারা এসেছে সম্পদের লোভে। সেই বৈদিক যুগে মধ্য-এশিয়া হতে আগত যাযাবর আর্য তারপর মধ্যযুগে কখনো আরব-আফগান কখনো পর্তুগীজ, ওলোন্দাজ, বৃটিশ এবং সর্বশেষ পাকিস্তানী। কখনো ঔপনিবেশিকতার নিগড়, কখনো ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতিতত্ত্বের করাল আগ্রাসন। আমার সম্পদ দিয়ে ইউরোপে হয় শিল্প বিপ্লব, বিপরীতে দাসত্বের শিকলে শৃঙ্খলিত হয় আমার পূর্ব পরম্পরা। সেই শৃঙ্খল ভাঙ্গার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাই আমাদের ইমিউনিটি। এ জাতি লড়তে জানে শত্রুর সাথে। হোক সে শত্রু ভিনদেশী লুটেরা, ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস কিংবা করোনা ভাইরাস।
হাজার বছরের লড়াই সংগ্রাম শেষে আত্মপরিচয় বিনির্মাণ তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সৃষ্ট বাঙালির প্রাণের সংগঠন ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ এগিয়ে চলছে দুর্বার বেগে। শুধু জাতীয়তাবাদের উম্মেষ জাগানো ও তার ধারাবাহিকতায় একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্মই নয়, আত্মমর্যাদাশীল আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে নিরন্তর কর্মরত, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাংলার মানুষের প্রাণের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি যুগসন্ধিক্ষণে তার ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে। করোনা পরবর্তি পৃথিবীর চেহারা কেমন হবে আমরা জানি না। এতটুকু বুঝি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনই শুধু নয় ও ব্যক্তির যাপিত জীবনের ভবিষ্যতই এখন আনপ্রেডিক্টাবল। চলমান এই করোনাকালীন কঠিন সময়ে, বাংলাদেশের রজত জয়ন্তীর প্রাক্কালে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষকালে হয়তো অনাড়ম্বরভাবেই পালিত হবে লড়াই-সংগ্রাম আর উন্নয়নের ধারক ঐতিহ্যবাহী গণ-সংগঠন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আমার কাছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ - ইতিহাসের উজান বেয়ে টিকে থাকা বাঙালির জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারই শুধু নয়; ইতিহাস বিনির্মানকারী একক রাজনৈতিক সংগঠন, যার ২য় কোন উপমা বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল।
ধরা হয় বাংলার প্রথম স্বাধীনতার অস্ত যায় ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন, যেদিন পলাশীর প্রান্তরে প্রহসনমূলক যুদ্ধে হেরে যায় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উ-দৌলা। মুসলিম মোঘল সাম্রাজ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে এগিয়ে ছিল যে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী, বৃটিশ শাসনের শুরু থেকেই ইংরেজরা 'Divide and Rule' নীতির মাধ্যমে শাসন-শোষণ শুরু করে। এই ক্রূর রাজনীতির প্রধান শিকার ছিল মুসলিম জনগোষ্ঠী। যেহেতু বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মুসলিম ছিলেন, কাজেই চতুর রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর জয়কে মুসলিমদের উপর হিন্দুদের জয় হিসেবে চিত্রিত করার পরিকল্পনা করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ও নবকৃষ্ণ দেবসহ কয়েকজন হিন্দু রাজা ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তি ইংরেজদের উৎসাহ ও পরিকল্পনায় শুরু হয় শারদীয় দুর্গোৎসব। এভাবেই দূরদর্শী পরিকল্পনায় অতি সূক্ষ্মতার সাথে রাজনীতিকে ধর্মের সাথে মিলিয়ে দেয় ইংরেজরা। মুসলিম শাসনামলে সম্রাট, নওয়াব, জমিদার, জায়গীরদার ও ধনী ব্যক্তিবর্গের অর্থানুকূল্যে মুসলিমদের জন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। ইংরেজদের কূটচালে সবই ধ্বংস হয়ে যায়। ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং সূর্যাস্ত আইন দিয়ে নিলামে তোলা হয় অধিকাংশ মুসলিম জমিদারী, যার মালিকানা চলে যায় প্রতারক হিন্দু গোমস্তাদের হাতে। অধিকাংশের বাংলার জমিদারী, তালুকদারী, সরকারি চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সব কিছুতেই এগিয়ে যায় হিন্দুরা। ১৮৩৫ সালে লর্ড ম্যাকলে প্রণীত শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে প্রণিত ইন্ডিয়ান এডুকেশন এ্যাক্টে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে মুসলিমরা তা প্রত্যাখ্যান করে ফলশ্রুতিতে সবক্ষেত্রেই পিছিয়ে যায় মুসলমানরা।
উপমহাদেশে বৃটিশ রাজত্বের প্রথম একশ বছর অতিক্রমেরও পর রাজনৈতিক চেতনা দানা বাঁধা শুরু করে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সিভিলিয়ান অফিসার অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমের উৎসাহ ও উদ্যোগে ১৮৮৫ সালে প্রথম রাজনৈতিক দল ভারতীয় কংগ্রেসের জন্ম নেয়া যতটা দেশপ্রেমের প্রেক্ষিতে তার বেশি বৃটিশ শাসনের আনুকুল্যে। বৃটিশদের ডিভাইড এন্ড রুলের ফাঁদে পরে যায় ভারতবাসী। মুসলিম নিস্পেষণ, বর্ণহিন্দুদের বাবুগিরি ও কংগ্রেসে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নিলে ভারতীয় মুসলমানদের অসহায়ত্ব তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা ফিরে পায় রাজধানীর মর্যাদা বিপরীতে কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু ধর্মীয় বুদ্ধিজীবীরা ফুঁসে ওঠে প্রতিবাদে। বঙ্গভঙ্গ রোধের দাবীতে উত্তপ্ত ভারতবর্ষে হিন্দুত্বের তীব্রতা ও তাদের মুসলিম বিদ্বেষী মনোভবের কারণে সর্বভারতীয় মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন মুসলিম নবাবরা। অবশেষে পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকার শাহাবাগে ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। ঢাকায় এই ঐতিহাসিক সম্মেলনে বঙ্গভঙ্গ সমর্থন এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের নিন্দা করা হয়।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাব্দে রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে শুরু হওয়া ব্রাম্মধর্মকেন্দ্রিক আন্দোলনকে কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীগণ বঙ্গীয় রেনেসাঁয় রূপ দিতে সচেষ্ট হয়। বাংলার এই পুর্নজাগরণের ঢেউ বাঙালি মুসলমানকে আলোড়িত করেনি। অস্বীকার করার উপায় নেই বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সাম্প্রদায়িক চেতনাই ছিল আধুনিকতা; দেশপ্রেমও তখন সাম্প্রদায়িকতার বাইরে নয়। মুসলিমলীগের জন্মের পর ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মধ্যে প্রথমবারের মত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনা জন্ম নেয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বৃটিশ শাসকদের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির মাধ্যমে ভারতবর্ষকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করতে সাম্প্রদায়িক উস্কানীর চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছায়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পর মুসলিম অসন্তোষ জেগে উঠলে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরে বঞ্চিত মুসলমান।
১৯৪৭ এর দেশভাগের মাধ্যমে খণ্ডিত স্বাধীতার স্বাদ পায় ভারতীয় মুসলিম। পাকিস্তান আন্দোলন ও বাস্তবায়নে পূর্ব বাংলার মানুষের অবদান অপরিসীম। নয়া স্বাধীনতার অব্যাবহিত পরেই ডিভাইড এন্ড রুলের মাধ্যমে দ্বি-জাতিতত্ত্বের অসারতা বুঝতে সময় লাগেনি পূর্বপাকিস্তানের। মুসলিম লীগের পৃষ্টপোষকতায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানের ভূস্বামী, সামন্ত জমিদার, উলেমা, পীর, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এক লুটেরা শাসক ও শোষক শ্রেণি। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই বাংলার মুসলিম লীগের প্রগতিশীল ও জনপ্রিয় অংশটিকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার বলয় থেকে হটিয়ে দেয়া হয়। নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হয় পূর্ব পাকিস্তানে। সদ্য কলকাতা ফেরৎ তরুন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উৎসাহ ও পরামর্শে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারী কার্জন হলে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। নতুন দল যেন গঠিত হতে না পারে সে উদ্দেশ্যে ১৯৪৯ সালের এপ্রিলেই গ্রেফতার হয় প্রতিশ্রুতিশীল তরুন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাংলার প্রগতিশীল মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রমুখের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন ঢাকার টিকাটুলি রোজ গার্ডেনে (হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি বলে পরিচিত) অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন হারিয়ে যাওয়া বাংলার স্বাধীনতা ফিরে পেতে এই জনপদের মানুষ ১৯৪৯ সালের একইদিন অর্থাৎ ২৩শে জুন গঠিত হওয়া নতুন রাজনৈতিক দল “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে কেন্দ্র করে আবার স্বপ্ন দেখে। নতুন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উম্মেষ ও এর তীব্রতায় কেঁপে ওঠে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা ভাসানী সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব সারা বাংলাদেশ ঘুরে বঞ্চিত বাঙালিকে সংগঠিত করে আওয়ামী মুসলিম লীগের পতাকাতলে। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি প্রথম রুখে দাঁড়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৩ সালের কাউন্সিলে “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ” মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয় এবং ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের অব্যবহিত পর ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” থেকেও মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। পাকিস্তানী শাসকদের অত্যাচার, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিপরীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে আরও শাণিত হয় বাঙালির অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনা।
পাকিস্তান শাসনে অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় চেপে বসে সামরিক স্বৈরাচার। ইতিহাসের কানাগলিতে পথ হারায় পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা। তার পরের ইতিহাস শুধুই আন্দোলন-সংগ্রামের। যে সংগ্রামে ধারাবাহিকভাবে দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত একক নেতা। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান প্রতিটি কালজয়ী লড়াই গোটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছে মুক্তির সংগ্রামে । অবশেষে এল সেই মুক্তির ঘোষণা, মহাপুরুষ ডাক দিলেন স্বাধীনতার। তার তর্জনীর নির্দেশে জেগে ওঠে সাড়ে সাতকোটি বাঙালি। দীর্ঘ ৯মাসের রক্তাত্ব সংগ্রাম, ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বনিময়ে আমরা পেলাম স্বাধীনতা। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন আমাদের স্বাধীনতা।
মুক্তিযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি দেশকে পুনর্গঠন করে এবং মাত্র নয় মাসের মধ্যে একটি সংবিধান উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও শোষণমুক্ত-উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমি নির্মাণ করে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আত্মমর্যাদাশীল স্বনির্ভর দেশ গড়তে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাংলাদেশ, ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা সদ্যোস্বাধীন দেশে ঘটায় পৃথিবীর ইতিহাসের নির্মম, ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ড। সামরিক শাসনের বুটে পিষ্ট হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম আইন ইমডেন্টিটি অধ্যাদেশ করে হালাল করা হলো হত্যাকাণ্ডকে। পাপিষ্ট রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধীদের সাথে নিয়ে সামরিক জান্তা বসল সিংহাসনে। নিষিদ্ধ হলো বঙ্গবন্ধু, জয়বাংলা।
তারপর আবার সুদীর্ঘ একুশ বছরের সংগ্রাম। ইতোমধ্যে পৃথিবীময় উদ্বাস্তু জীবন শেষে ১৯৮১ সালে নিজভূমে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। সামরিক স্বৈরাচার আর তথাকথিত জাতীয়তাবাদের পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে দেশময় প্রতিরোধ গড়ে তুলে দিক হারা দেশকে নতুন দিশার সন্ধান দিলেন এসময়ের বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্র নায়ক, জননেত্রী শেখ হাসিনা। হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠনে সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিয়ে বীরদর্পে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। যোগ্য পিতার সফল উত্তরাধিকারের হাত ধরে উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ, রূপকল্প ২০-২১ এখন বাস্তবায়নের দারগোড়ায়, রূপকল্প ৪০-৪১ শুধু সময়ের বিষয়। বাংলাদেশের এই আলোকিত যাত্রাপথে কোভিড-১৯ কতবড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে আমরা জানি না কিন্তু এতটুকু জানি যে সংগঠনের হাত ধরে এসেছে স্বাধীনতা, তার হাত ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ এবং শতবর্ষী ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির সোপানে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বৃটিশদের তৈরী করা ডিভাইড এ্যান্ড রুলের প্রভাবে সৃষ্ট ধর্মীয় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা থেকে মুক্ত হতে পারে নি বাংলাদেশ। ৭১’এ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে দণ্ডিত রাজাকারদের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তান যেমন সোচ্চার তেমনি সোচ্চার এদেশীয় অনেক ধর্মান্ধ। এখনও পাকি প্রেতাত্মারা বিশ্বাস করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধুই হিন্দুবাদী রাষ্ট্র ভারতের ষড়যন্ত্রের ফসল। রাষ্ট্র পাকিস্তান এখনও তাদের অপরাধ স্বীকার করে না। পাকিস্তানের সামরিক সরকার পাকিস্তানী জনগণকেও বিভ্রান্ত করে রেখেছে জন্ম থেকে। ধর্মান্ধতা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে জঙ্গিবাদের আতুর ঘরে পরিণত করেছে। পাকিস্তানের আশরাফীয় মুসলমানিত্বের অহংকার শুধু ১৯৭১ এর আগেই নয় বরং একবিংশেও তা বহমান ছিল। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে এসে উম্মুক্ত তথ্য দুনিয়ায় পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের কাছে এখন সত্য পরিস্কার হচ্ছে দিনকে দিন। একদা পাকিস্তানের বঞ্চিত অংশ বর্তমানের বাংলাদেশে যে সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে তাতে সকল সামাজিক সূচকে বীরদর্পে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানের তুলনায়। প্রকৃত ইতিহাস বেশিদিন ছাই চাঁপা দিয়ে রাখা যায় না। পাকিস্তানের বিভিন্ন মিডিয়ায় সত্য প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছে। তাদের টকশোতে দেখি, পাকিস্তান যেন দ্রুতই বাংলাদেশের মত সমান তালে এগিয়ে যেতে পারে সে জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায় ইদানিং।
২০০৯ সালে পাকিস্তানের একটি টিভি চ্যানেলে “Fall of Dhaka on 16 December 1971” শিরোনামে মাহীন উসমানীর একটা রিপোর্ট দেখেছিলাম ইউটিউবে। রিপোর্টার নিজে সেখানে কমেন্টস করেছেন, “বলা হয়ে থাকে, যে জাতিগুলি তাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না তাদের ভুল পুনরাবৃত্তি করে চলার জন্য তাদের নিন্দা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের মর্মান্তিক ক্ষতির কারণগুলি বিকৃত করা হয়েছে, এবং দীর্ঘদিন ধরে তা কার্পেট দিয়ে চেপে রেখেছে। বাঙালিরা কেন নিজেদের নিপীড়িত, বিচ্ছিন্ন, বঞ্চিত মনে করেছিল এবং পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দেয়া ছাড়া তাদের আর কোনও বিকল্প নেই বলে মনে হয়েছে সে সম্পর্কে সত্যতা জানা আমার প্রাপ্য। একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার কারণ এবং বাংলাদেশের উত্থানের কারণগুলির দিকে নজর দেওয়া যাক।”
৯ মিনিট ১৪ সেকেন্ডের এই রিপোর্টে ৬ দফাসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতার পর ইহাহিয়া খান আর ভূট্টোর টালবাহানা, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে কিছুটা সত্য প্রকাশ দেখলাম। বঙ্গবন্ধু একটি সাক্ষাৎকারের কয়েকটি লাইন এরকম, “No Body should play with the fire; nobody should try to suppress 70 million people. If they are determined to achieve something nobody can suppress them. Today, tomorrow or day after tomorrow, they must win”
চিরায়ত ভঙ্গিতে কয়েকটি মাত্র বাক্য ব্যয়ে বঙ্গবন্ধুর দীপ্রতা ও আত্মবিশ্বাস দেখানো হলো তাতে যে কেউ বিমোহিত হবেন। দীর্ঘ অন্ধকার পেরিয়ে আলোর পানে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম ও গণমাধ্যম এখন বাংলাদেশের উত্থানের কারণগুলো বিশ্লেষণে মরিয়া। বাংলাদেশ নামক এই জাতিরাষ্ট্রের প্রধান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তার হাতে গড়া সংগঠন, ইতিহাসের আল পথ বেয়ে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই ৭১ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অতিক্রম করছে মুজিববর্ষে। বাংলাদেশের রজত জয়ন্তীর প্রাক্কালে বিশ্বাস করতে চাই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে আত্মমর্যাদাশীল একটি উন্নত রাষ্ট্রে। দুর্বার এই পথচলায় নিরন্তর শুভকামনা ও শুভেচ্ছা জানাই ইতিহাস, ঐতিহ্য আর উন্নয়নের ধারক এই গণসংগঠনটিকে তার ৭১ তম জন্মবার্ষিকীতে।
লেখক: রাজনৈতিক কর্মী
আরও পড়ুন