ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

পাঁচ সপ্তাহ সংজ্ঞাহীন থেকেও করোনাকে জয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:২৫ পিএম, ১৯ মে ২০২০ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৫:৩৪ পিএম, ১৯ মে ২০২০ মঙ্গলবার

১৯৬০ সালে পাকিস্তান থেকে ব্রিটেনে আসা নূর হোসেন মার্চে ইংল্যান্ডে লকডাউন শুরু হবার আগেই ব্র্যাডফোর্ড শহরে মারা। তার পরিবার যে জানাজার আয়োজন করেছিল - তাতে সমাগম হয়েছিল বহু লোকের। দু:খজনকভাবে সেই জানাজায় আসা অনেকের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটে।

এতে নূর হোসেনের পরিবারের তিন জন মারা যান, গুরুতর অসুস্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান নূর হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ।তার সেরে ওঠার কাহিনি বর্ণনা করেছেন স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তার জন রাইট। খবর বিবিসির

“‍আমার শুধু মনে আছে, তারা আমাকে প্রশ্ন করেছিল যে কিছু ওষুধ দিয়ে তারা আমাকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করতে পারে কিনা – তারপর আমি বললাম ‌‌'হ্যাঁ‌। আর কিছুই আমার মনে নেই” – বলছিলেন মোহাম্মদ।

মোহাম্মদ হোসেনের বয়স ৫১, তিনি পেশায় একজন আইনজীবী। তিনি পাঁচ সপ্তাহ সংজ্ঞাহীন ছিলেন। যখন তার জ্ঞান ফিরলো তখন তার মানসিক অবস্থা একেবারেই তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল।

তার চারপাশে মাস্ক, জীবাণু-প্রতিরোধী ঢাকনা, আর গাউনপরা লোকজন দেখে নিশ্চয়ই তার মনে হচ্ছিল তিনি এক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির জগতের মধ্যে এসে পড়েছেন।

তিনি মনেই করতে পারছিলেন না - কিভাবে তিনি এখানে এলেন। পুরো এপ্রিল মাসটার কোন স্মৃতি তার মধ্যে ছিল না। ব্র্যাডফোর্ডে কোভিড-১৯এ আক্রান্ত হবার পর আমাদের হাসপাতালের আইসিইউতে নিতে হয় মোট ৪৯ জন। তার মধ্যে অধিকাংশকেই ভেন্টিলেশন দিয়ে রাথতে হয়।

এর মধ্যে ৭ জন এখন পর্যন্ত ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। মোহাম্মদ তাদের মধ্যে একজন।

মোহাম্মদ বলছিলেন, তাকে যখন অচেতন করে রাখা হয়েছিল – তখন তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন যে তার পরিবারের ওপর একটা সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। সংজ্ঞা ফিরে আসার পর তিনি অস্থির হয়ে উঠছিলেণ।

“আমার মনে একটা সন্দেহ বাতিক কাজ করছিল। মনে হচ্ছিল - এই লোকগুলো আমাকে একটা ফাঁদে ফেলার চেষ্টার চেষ্টা করছে। কী হচ্ছে? এসবের মানে কী?‍”

সংকটজনক অবস্থা থেকে চেতনা ফিরে আসার পর এ ধরণের বিভ্রান্ত মানসিক অবস্থা অনেকেই মধ্যেই দেখা যায় – বলছিলেন ব্র্যাডফোর্ড হাসপাতালের আইসিইউ কন্সালট্যান্ট ডা. ডেবি হর্নার।

‍“তাদের চারপাশে কী হচ্ছে তা নিয়ে রোগীর মধ্যে নানা রকম সন্দেহ-উদ্বেগ দেখা দেয়। খুবই স্বাভাবিক। যদি রোগী জেগে উঠে জানতে পারে যে এর মধ্যে এক মাস পার হয়ে গেছে, এবং তার চারপাশে অদ্ভূত পোশাক পরা কিছু লোক ঘোরাঘুরি করছে – তখন এটা হতেই পারে।“

অনেক সময় রোগীদের এ ব্যাপারে ভেন্টিলেটর দেবার আগেই জানিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু মোহাম্মদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব ছিল না। তার অবস্থা অত্যন্ত দ্রুত খারাপ হয়ে পড়েছিল। তিনি অসুস্থ হন মার্চ মাসে, তার পিতা নূর হোসেনের জানাজার পরই।

মৃত্যুর সময় নূর হোসেনের বয়স ছিল ৯০এর কোঠায়। তিনি ব্রিটেনে এসেছিলেন ১৯৬০-এর দশকে, ব্র্যাডফোর্ডে কারখানায় কাজ করতে। তার পরিবারকে ব্রিটেনেই বড় করেছেন তিনি।

“তার সবসময়ই ইচ্ছা ছিল যেন তার জন্মস্থান মিরপুরে – তার ভাইয়ের কবরের পাশে - তাকে সমাহিত দেয়া হয়। আমি তার সেই ইচ্ছা পূরণ করেছি – বলছিলেন মোহাম্মদ।

নূর হোসেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিক ছিলেন। বার্মায় যুদ্ধ করেছেন, একজন দৃঢ়চেতা প্রকৃতির লোক ছিলেন তিনি। তিনি মারা যান মার্চের ১০ তারিখে। সেদিন বিকেল থেকেই তার শেষকৃত্যের জন্য স্থানীয় লোকেরা জড় হতে থাকেন। তার পরিবার ছিল অনেক বড় এবং ব্র্যাডফোর্ডে একটি সম্মানিত পরিবার, তাই যুক্তরাজ্যের নানা জায়গা থেকে লোক এসেছিলেন তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

ব্র্যাডফোর্ডের কেন্দ্রীয় মসজিদে প্রথম দিনের জানাজায় ছিলেন প্রায় ৬০০ লোক। পরদিন মোহাম্মদ, তার মা আর স্ত্রীকে নিয়ে তার পিতার মরদেহ সহ পাকিস্তানের পথে প্লেনে উঠলেন। কিন্তু ব্র্যাডফোর্ডে ফিরে আসার পরও আরো দু‌দিন ধরে শ্রদ্ধা নিবেদন চললো।

বারোই মার্চ বৃহস্পতিবার এক ভোজে সমবেত হলেন পাঁচশো লোক। এক সপ্তাহের মধ্যেই দেখা দিল করোনাভাইরাসের উপসর্গ। এর এক সপ্তাহ পর থেকেই লোকের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমলের লক্ষণ দেখা দিতে লাগলো।

প্রথম অসুস্থ হলো মোহাম্মদের এক ২৪ বছর বয়স্ক ভাতিজা। তাকে নেয়া হলো ব্র্যাডফোর্ড হাসপাতালের আইসিইউতে। একে একে ওই পরিবারের আরো তিন জন অসুস্থ হলেন। আরো একজনকে হাসপাতালে নিতে হলো। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও আরো কয়েকজন আক্রান্ত হলেন, তাদের কয়েকজন গেলেন ব্রাডফোর্ড আর ওল্ডহ্যামের হাসপাতালে।

স্পষ্টই বোঝা গেল যে ব্র্যাডফোর্ড বা অন্য কোথাও থেকে জানাজায় আসা কেউ একজন ছিলেন করোনাভাইরাস সংক্রমিত এবং তার থেকেই এটা অনেক লোকের মধ্যে ছড়িযে পড়েছে।

মোহাম্মদের ছেলে হারুন একজন রেডিওলজিস্ট। তিনি বলছিলেন, ‘জানাজায় আসা লোকেরা হাত মিলিয়েছে, পরস্পরের সাথে কথা বলেছে। আর তাতে বোঝাই যাচ্ছে কত দ্রুত এই ভাইরাস ছড়িয়েছে।’

‘এর কয়েকদিন পরই সারা ব্রিটেনে লকডাউন কার্যকর করা হয়। কিন্তু তার আগেই মানুষের মধ্যে এই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল – যদিও আমরা কেউ তা বুঝতে পারিনি। ফলে কোন লোকসমাগম হলেই তার মধ্যে অন্তত একজন সংক্রমিত লোক থাকতে পারে - এ সম্ভাবনা বেড়ে গিয়েছিল’ – বলছিলেন হারুন।

হারুন বললেন, তার পরিবারের আটজন সদস্য ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, এবং তার মধ্যে তিন জন মারা যান।

ডাক্তার রাইট বলছিলেন, তারা ওই সময়টায় অনেক রোগী পেয়েছেন যারা বিয়ে, পার্টি বা শেষকৃত্যের মত পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়ে সংক্রমিত হয়েছিলেন। এর কারণ হচ্ছে এসব অনুষ্ঠানে আগতরা ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শে আসেন। তারা কোলাকুলি করেন, হ্যান্ডশেক করেন – যার ফলে উচ্চ মাত্রায় সংক্রমণ ঘটে।

মোহাম্মদ পাকিস্তান থেকে ফিরেছিলেন ১৮ই মার্চ। তার আগেই হারুন এবং তার ভাইয়ের দেহে উপসর্গ দেখা দেয়।

“‍আমরা অন্যদের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু এক বাড়িতে থাকলে সেটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ একটা বাড়ির বাথরুম, ফ্রিজ, কিচেন সবাই ব্যবহার করে।‍ মোহাম্মদের আগে থেকেই এ্যাজমা বা হাঁপানির সমস্যা ছিল – তাই তিনি সংক্রমণে কী হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। কিন্তু সেই শনিবারই তার দেহে লক্ষণ দেখা দিল।

পরের ৯ দিন মোহাম্মদ বাড়িতে বসে থাকলেন, কিন্তু তার অবস্থা ক্রমে খারাপ হতে লাগলো। তার ছেলেরা তখন জরুরি নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করলেন। তাকে হাসপাতালে নিতে এ্যাম্বুলেন্স এলো।

‍“আমরা তার সাথে এ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত গেলাম। সেটা ছিল খুবই আবেগপূর্ণ একটা মুহূর্ত, কারণ আমরা তার সাথে যেতে পারিনি, কখন আবার তাকে দেখতে পাবো তাও জানতাম না।“

মোহাম্মদ ব্র্যাডফোর্ড রয়াল ইনফার্মারি হাসপাতালে এসে দেখলেন, ওয়েটিং রুমে বসে আছেন তারই চাচা, তার মুখেও অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। কয়েকদিন পরই তিনি মারা যান। মোহাম্মদের মুখের ভেতর দিয়ে টিউব ঢুকিয়ে তাকে ভেন্টিলেটর দেয়া হলো।

‍“এ সময় রোগীকে গভীরভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়, এবং তার দেহের পেশীগুলো ওষুধ দিয়ে অচল করে রাখা হয়ে যাতে দেহে অক্সিজেন ঢুকতে পারে”- বলেন ডেবি হর্ণার।

‘এসময় প্রতিদিন দু’‌‌বার মোহাম্মদকে উপুড় করে শোয়ানো হয় – যাতে তার ফুসফুসের বিভিন্ন অংশে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে তার শরীরে যত বেশি সম্ভব অক্সিজেন ঢোকানোর চেষ্টা করা হয়। একদল রেডিওলজিস্ট মিলে এ কাজটা করে থাকেন।‍’

প্রথম দিকে ডাক্তারদের ধারণা ছিল যে কোভিড-১৯ মূলত ফুসফুসের রোগ এবং রোগীকে সংজ্ঞাহীন করে ভেন্টিলেশন দেয়াটাই হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা। কিন্তু পরে তারা সিপিএপি নামে অন্য এক ধরণের ভেন্টিলেটর ব্যবহার করতে শুরু করেন – যা মূলত সরাসরি ফুসফুসে অক্সিজেন পাঠাতে থাকে। এ পদ্ধতির কার্যকারিতাও স্পষ্ট হয়েছে।

প্রাথমিক উপাত্তে দেখা যায়, ব্র্যাডফোর্ড রয়াল ইনফার্মারিতে রোগীদের মুত্যুহার ২৩ শতাংশ – যা ব্রিটেনের জাতীয় হারের চেয়ে কম। তবে আইসিইউতে মৃত্যুর হার যুক্তরাজ্যের অন্যান্য এলাকার মতো ৫০ শতাংশই ছিল।

ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে বের হবার পর মোহাম্মদ হোসেনকে সুস্থ হবার জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। প্রতিদিন দু‌বার উপুড় করে শোয়ানোর সময় তার কাঁধে চোট লাগে এবং তিনি ডান হাত খুব বেশি নাড়াতে পারতেন না। ফলে তার খেতে অসুবিধা হতো। এ জন্য তাকে বাড়তি ফিজিওথেরাপি নিতে হয়।

মোহাম্মদ হোসেন তার চিকিৎসার জন্য ডাক্তার-নার্সদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলেন।

“ শুধু চিকিৎসা নয়, তাদের মানবিক আচরণও আপনাকে সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করে।একদিন নানা রকম টেস্ট করা ফাঁকে ডাক্তার আমাকে আনারসের জুস খেতে দিলেন। আমার সেটাকে বেহেশতের পানীয় মনে হচ্ছিল” - বলছিলেন মোহাম্মদ।

মোহাম্মদ সংজ্ঞাহীন ছিলেন মোট পাঁচ সপ্তাহ। সেই সময়টা সবাইকে হোয়াটসএ্যাপে তার চিকিৎসার খবর জানাতেন তার ছেলে হারুন। গত মঙ্গলবার মোহাম্মদ যখন হাসপাতাল ত্যাগ করলেন, তখন তাকে রীতিমত সংবর্ধনা দিয়েছিলেন তার ওয়ার্ডের স্টাফরা।

তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেবার সময় স্বজনদের একটা চমক দিয়েছিলেন হারুন।

“আমি যখন বাবাকে হাসপাতাল থেকে আনতে গেলাম আমি কাউকে বলিনি। পরিবারের সবাইকে জানালাম, তারা যেন আমাদের বাড়িতে আসেন, কথা আছে। তারা এসে দেখলেন, আব্বা আরামদায়ক চেয়ারে বসা। সবাই অবাক হয়ে গেল। সে ছিল এক দারুণ মুহূর্ত“ – বলছিলেন হারুন।

মোহাম্মদ এখন সুস্থ হয়ে উঠছেন, বাগানে গিয়ে বসছেন। তবে অল্পতেই হাঁপিয়ে যান। পুরোপুরি সেরে উঠতে সময় লাগবে, তবে তার চারপাশে এখন প্রিয়জনরা আছেন। হারুনের মা-ও এখন পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছেন। ফলে পুরো পরিবার আবার একসাথে হয়েছে। সবাই খুব খুশি।

এসি