নিশ্চিত বিজয় যেভাবে বিপর্যয়ে রূপান্তর হলো
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৪:৪৩ পিএম, ২১ মে ২০২০ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৪:৪৫ পিএম, ২১ মে ২০২০ বৃহস্পতিবার
পবিত্র কোরআন-এ আল্লাহ রব্বুল আলামীন সূরা আহজাব-এর ২১ নং আয়াতে বলেন, ‘(হে মানুষ!) নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে নবীজীবন সর্বোত্তম আদর্শ।’ নবীজীবন কোরআনের ফলিত রূপ। কোরআন বুঝতে হলে, কোরআনের গভীরে ডুব দিতে হলে নবীজীবনকে জানতে হবে। নবীজীবনকে যত গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যায়, নবীপ্রেমে নিজের অন্তরকে যত প্লাবিত করা যায়, ততোই কোরআনের বাস্তব ও পরাবাস্তব জ্ঞানের ছটায় উপকৃত হওয়া যায়। কোরআনে ব্যক্ত ও সুপ্ত সব কথারই মর্মমূলে প্রবেশ করার ফলে; বিশ্বাসের স্তর থেকে উত্তরণ ঘটবে জানার স্তরে।
প্রথম পর্বে আপনারা জেনেছেন নবী আগমনের পটভূমি। আইয়ামে জাহেলিয়াত। মক্কার বিবর্তন। কাবার নিয়ন্ত্রক বেনিয়া পুরোহিত চক্রের শোষণ ও ভোগবাদী সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের চরম বিপর্যয়ের বিবরণ। দ্বিতীয় পর্বে জেনেছেন শূন্য থেকে জীবন শুরু। অনিশ্চয়তার পর অনিশ্চয়তা। নিজ শ্রম ও মেধায় ৩৫ বছর বয়সে আসীন হলেন মক্কার সমাজে উচ্চ মর্যাদায়। তৃতীয় পর্বে আপনারা জেনেছেন জীবনের বাঁকবদল। জাহেলিয়াত থেকে উত্তরণের সূত্র লাভ। আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। সকল মানুষ সমান। শুরু করলেন সত্যের প্রচার। প্রথমে গোপনে। তারপর প্রকাশ্যে।
চতুর্থ পর্বে আপনারা জেনেছেন নির্মম নির্যাতন ও উৎপীড়নের মুখে স্বল্পসংখ্যক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের বিশ্বাস ও অহিংসায় অটল থেকে আত্মিক তূরীয় আনন্দে অবগাহনের বিবরণ। পঞ্চম পর্বে জেনেছেন হিজরত- চরম অনিশ্চয়তার মুখে সোনালি সকালের পথে যাত্রার বিবরণ। ষষ্ঠ পর্বে জেনেছেন মদিনায় আগমনের পর সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে ধাপে ধাপে তার ঘর গোছানোর কাহিনী। সপ্তম পর্বে জেনেছেন- সীমিত শক্তি ও উপকরণ নিয়ে বড় বিজয়ের উপাখ্যান। অষ্টম পর্বে জেনেছেন ঘর গোছানোর সাথে সাথে ধনীর সম্পদে দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যাকাতের বিধানাবলির বিবরণ। এবার নবম পর্বে জানবেন নিশ্চিত বিজয় বিপর্যয়ে রূপান্তরের উপাখ্যান।
বদরের প্রতিশোধ নিতে কোরাইশদের প্রস্তুতি
বদরের যুদ্ধ ছিল আরবে মক্কার একচ্ছত্র প্রভাব বলয়ের ওপর এক প্রচণ্ড ঝাঁকি। এ যুদ্ধের ফলে মদিনা নতুন শক্তিবলয়রূপে আবির্ভূত হলো। নবীজীর অভিযান ও কূটনৈতিক তৎপরতায় লোহিত সাগর তীরের কয়েকটি গোত্রের সাথে মৈত্রীচুক্তি সম্পাদিত হলো। ফলে কোরাইশদের জন্যে উপকূলীয় বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল। কারাদায় জায়েদের সফল অভিযানের ফলে ইরাকের বাণিজ্যপথও কোরাইশদের জন্যে আর নিরাপদ রইল না। বদরের প্রতিশোধ ও হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্যে কোরাইশদের গোপন প্রস্তুতি শেষ। আড়াই লক্ষ দিরহামের তহবিল গঠন করল তারা।
একবছর পর বিশাল বাহিনী নিয়ে সাগরের পথ ধরে মদিনার উত্তরে ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে শিবির স্থাপন করল। ৩০০০ সৈন্য, ৭০০ বর্ম, ২০০ ঘোড়া, ৩০০০ উট, কয়েকশ মনোরঞ্জনকারী নারী আর রসদপত্রের এক বিশাল বহর। এবারের যুদ্ধযাত্রায় কোরাইশদের লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট। মুহাম্মদ ও হামজাসহ মুসলিম নেতৃত্বের সম্পূর্ণ বিনাশ। নবীজীর কাছে যখন মক্কা থেকে কোরাইশি অভিযানের তথ্যসংবলিত গোয়েন্দা চিঠি এসে পৌঁছল তখন তিনি মদিনা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে কুবায়। ওহুদ ও মদিনার মাঝামাঝি জায়গায়। তিনি দ্রুত মদিনায় ফিরে এলেন। রাতে পাহারা ও টহলের ব্যবস্থা করলেন। বিপুল সংখ্যক মুসলমান সশস্ত্র অবস্থায় মসজিদে নববীতে অবস্থান নিলেন।
পরদিন শুক্রবার ফজরের নামাজের পর সাহাবীদের নিয়ে পরামর্শসভায় বসলেন। নবীজী বললেন, রাতে স্বপ্ন দেখেছি, ‘শত্রুরা আমার কিছু গবাদি পশু জবেহ করে ফেলেছে। আমার তরবারির আগায় একটা খাঁজ পড়েছে। আমার হাত একটা ঢালের ওপর।’ স্বপ্নের ব্যাখ্যায় নবীজী আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার কিছু অনুসারী শহিদ হবে, আমি আহত হবো। তবে ঢাল হচ্ছে মদিনা।’ তিনি এরপর বলেন, ‘আমরা মদিনায় থেকে যাই। শত্রপক্ষ যেখানে আছে সেখানেই থাকুক। আমরা না বেরোলে তারা নিজেদের বিজয়ী ভেবে আনন্দিত হবে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য অধরা থেকে যাবে। আর তারা যদি মদিনা আক্রমণ করে, তবে মদিনার অলিগলি আমরাই ভালো চিনি। তাদের ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারব। তারা বিপর্যস্ত হবে।’
যুগ যুগ ধরে মদিনা এভাবেই আক্রমণকারীদের পর্যুদস্ত করলেও বদরের বিজয় বিশ্বাসীদের সাহস ও উদ্দীপনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাই প্রবীণ ও নবীনদের অধিকাংশই ময়দানে গিয়ে শত্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রবল আগ্রহ ব্যক্ত করলেন। নিজের মতের বিপক্ষে গেলেও নবীজী অধিকাংশের মতামতকে মেনে নিয়ে যুদ্ধযাত্রার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। সবাইকে প্রস্তুত হয়ে আসার নির্দেশ দিলেন এবং আসর নামাজের পর নিজেও বর্ম পরিধানের জন্যে ঘরে গেলেন।
নবীজী তৈরি হওয়ার জন্যে ঘরে যাওয়ার পর প্রবীণদের মনে যুদ্ধযাত্রা নিয়ে দ্বিধা সৃষ্টি হলো। তাদের কাছে মনে হলো, তারা তাঁর বিজ্ঞ মতামতের ওপর নিজেদের মত চাপিয়ে দিয়েছেন। অতএব নবীজীর প্রথম পরামর্শ ‘শহরে অবস্থান নিয়ে থেকে যাওয়া’ই ভালো। তারা তাই নবীজী বর্ম পরে যুদ্ধসাজে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই আগের ঘটনার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, আপনি যা বলবেন আমরা তা-ই করব। নবীজী জবাব দিলেন, ‘আমি তোমাদের মদিনায় অবস্থান করতে বলেছিলাম। তোমরা শোনো নি। একজন নবী একবার বর্ম ধারণ করলে, আল্লাহ তাঁর ও শত্রুদের মধ্যে ফয়সালা না করা পর্যন্ত তিনি আর বর্ম খোলেন না। অতএব এখন আমার নির্দেশ অনুসরণ করো। দৃঢ় ও অবিচল থাকো। তোমরা জয়ী হবে।’
নবীজী সুস্পষ্টভাবেই বুঝতে পারছিলেন, এখন কোনো ধরনের দোদুল্যমানতাকে প্রশ্রয় দিলে সমূহ ক্ষতি হবে। সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেলে তা অবশ্যই পালিত হতে হবে। আসলে সঙ্ঘবদ্ধ জীবনে সিদ্ধান্ত সবসময়ই পরামর্শক্রমে নেয়া উচিত। কিন্তু একবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেলে তা নেতার জন্যেও অবশ্য পালনীয়। ওহুদের পথে ১০০০ সৈন্য নিয়ে যাত্রা শুরু হলো। মাত্র ১০০ জনের বর্ম ছিল। ঘোড়া ছিল দুইটি। পথিমধ্যে মুনাফিক প্রধান আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার গোত্রের ৩০০ জনকে নিয়ে দলত্যাগ করে মদিনায় ফিরে গেলেন। নবীজীর সৈন্যসংখ্যা দাঁড়াল ৭০০ জন। অর্থাৎ চার জন শত্রুর বিপক্ষে একজন। ৭০০ বিশ্বাসীকে নিয়ে মুহাম্মদ (স) ওহুদের প্রান্তরে উপস্থিত হলেন।
সবদিক পর্যবেক্ষণ করে ‘আইনায়েন’ টিলার ওপর আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের নেতৃত্বে ৫০ জন তীরন্দাজের একটি দলকে সৈন্যদের পশ্চাদ্ভাগ রক্ষার দায়িত্ব দিলেন। সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিলেন, কোনো অবস্থায়ই তোমরা টিলা ত্যাগ করবে না। আমাদের জয় দেখ বা পরাজয়, তোমরা কোনো অবস্থায়ই স্থান ত্যাগ করবে না। তোমাদের কাজ হচ্ছে, ঘোড়সওয়ারদের আক্রমণ থেকে তীর ব্যবহার করে আমাদের রক্ষা করা। ওহুদ প্রান্তরের উঁচু দিকে তিনি সৈন্যদের বিন্যস্ত করলেন। তারা তাদের বিশ্বাসের জন্যে তখন প্রাণ বিসর্জন দিতে সর্বোতভাবে প্রস্তুত।
তিনি ঘোড়ায় চড়ে সৈন্যদের প্রত্যেকের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর ঘোড়া থেকে নেমে আরেকজন সৈনিকের সাথে তাঁর বর্ম বদল করলেন। কোরাইশরা আক্রমণ শুরু করল। বিশ্বাসীরা হামলার জবাব দিল অসীম সাহসিকতার সাথে। একের পর এক কোরাইশ পতাকাবাহী নিহত হলো। দুই পক্ষ এত ভয়ঙ্কর যুদ্ধের মুখোমুখি এর আগে কখনো হয় নি। আবু দুজানা কোরাইশদের অবস্থান ছিন্নভিন্ন করে তাদের শিবিরে প্রবেশ করলেন। শিবিরের মনোরঞ্জনকারী নারীরা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করলে কোরাইশ বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। ওত পেতে অপেক্ষারত হাবশি ক্রীতদাস ওয়াহেশীর নিক্ষিপ্ত বল্লমের আঘাতে বীর হামজা শহিদ হলেন। বিশ্বাসীদের তীব্র পাল্টা আক্রমণে কোরাইশ বাহিনী মাঠ ছেড়ে পালাতে শুরু করল।ওহুদের প্রান্তরে আবারও প্রমাণিত হলো, একটা সুশৃঙ্খল অকুতোভয় ও আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছোট্ট বাহিনীও আদর্শহীন সুসজ্জিত বিশাল বাহিনীকে সম্মুখসমরে পরাজিত করতে পারে।
বিজয়ী বাহিনী এবার নেমে পড়ল গণিমত সংগ্রহে (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ)। আর তখনই ঘটল বিপর্যয়। টিলার শীর্ষে অবস্থানকারী অধিকাংশ তীরন্দাজ তাদের নেতার নির্দেশ লঙ্ঘন করল। জাহেলি যুগের বংশপরম্পরার অভ্যাসবশত টিলা থেকে নেমে তারাও গণিমত সংগ্রহে যোগ দিল। অথচ তাদের নিজেদের জন্যে এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। যুদ্ধলব্ধ মালামালের ব্যাপারে বিধান ছিল খুব সুস্পষ্ট: ‘তোমার কাছে গনিমতের বিধান সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে? তাদের বলো, গনিমত অর্থাৎ যুদ্ধলব্ধ মালামাল হচ্ছে আল্লাহ ও রসুলের। অতএব আল্লাহ-সচেতন থাকো এবং নিজেদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় রাখো। তোমরা সত্যিকারের বিশ্বাসী হলে আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য করো।’(সূরা আনফাল : ১)
‘জেনে রাখো, গনিমতের মালের এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ, রসুল, রসুলের স্বজন, এতিম, গরিব, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্যে নির্দিষ্ট। তোমরা যদি আল্লাহ এবং সত্য-মিথ্যার ফয়সালার দিন (বদরে দুই বাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধের সময়) আমি আমার বান্দার প্রতি যা নাজিল করেছিলাম, তাতে বিশ্বাস করো (তবে অবশ্যই এই নিয়ম পালন করবে)। আল্লাহ সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান।’ (সূরা আনফাল : ৪১)
গনিমতের মাল বণ্টনের নিয়মে কোনোকিছুই ব্যক্তিগতভাবে নেয়ার সুযোগ ছিল না। কারণ যুদ্ধলব্ধ সবকিছুই একত্রে জমা করতে হবে। তারপর এক-পঞ্চমাংশ রেখে নেতা তা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সুষমভাবে ভাগ করে দেবেন।
রণক্ষেত্রের ডান প্রান্তে অবস্থানকারী কোরাইশ সেনাপতি খালিদ ইবনে ওয়ালিদ তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। তিনি তার বাহিনী নিয়ে পেছন থেকে আক্রমণ করলেন। হঠাৎ পেছন থেকে আক্রান্ত হওয়ায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকে শহিদ হলেন। পেছনে কী হচ্ছে দেখতে গিয়ে সামনে অগ্রসরমান মুসলিম সৈনিকরা থমকে দাঁড়ালেন। পলায়নরত কোরাইশরা ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে গেল। তারা ঘুরে পাল্টা আক্রমণ করল। শুরু হলো যুদ্ধের বিয়োগান্ত পর্ব। পেছনে ও সামনে দুদিক থেকে আক্রান্ত হওয়ায় মুসলমানরা বিশৃঙ্খল ও দিশেহারা হয়ে গেল। এর মধ্যে কুরাইশরা গুজব ছড়িয়ে দিল যে মুহাম্মদ নিহত হয়েছেন।
মুহাম্মদ (স) তখন কাটাচ্ছিলেন কঠিন সময়। ওহুদের প্রান্তরে কোরাইশদের মূল লক্ষ্য ছিলেন তিনি। তাঁকে হত্যা করতে পারলেই সত্যধর্মের বিনাশ ঘটবে, এটাই ছিল তাদের ধারণা। তাই প্রথমেই কোরাইশরা রণক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান চিহ্নিত করে আক্রমণ শুরু করেছিল। এবার মুসলমানদের ছত্রভঙ্গ অবস্থায় চারদিক থেকে তারা নবীর অবস্থানকে সঙ্ঘবদ্ধ আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করল। মুহাম্মদ (স) পাহাড়ের মতো নিজ অবস্থানে অটল থাকলেন। আসলে কোনো নবী কখনো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালান না।
ভয়ঙ্কর আক্রমণের মুখে নবীজীকে রক্ষা করার জন্যে যারা শহিদ হলেন, তাদের সংখ্যা ৩০-এর বেশি। যারা মুহাম্মদের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে শহিদ হন তাদের মধ্যে বীর আবু দুজানা, শামমাস ইবনে উসমান, মুসআব ইবনে উমায়ের অন্যতম। নবীজীকে রক্ষা করতে গিয়ে তারা নিজেদের দেহকেই ঢাল বানিয়ে ফেলেন। আবু দুজানার পিঠে এত তীর বিঁধেছিল যে, তীর বেঁধার আর কোনো জায়গা ছিল না। গুরুতর আহত হয়েও যারা নবীজীর জীবন রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালান তাদের মধ্যে তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, আল হুবাব ইবনে মুনযির, আবু তালহা, উম্মে আমারা নুসাইবার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নুসাইবা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের পানি খাওয়াচ্ছিলেন। অবস্থা সঙ্গিন দেখে পানির পাত্র ফেলে কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে কোনো বর্ম বা শিরস্ত্রাণ ছাড়াই একটা তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুর মোকাবেলায়। তার শরীরের ১৮টি স্থানে আঘাত লাগে। নবীজী (স) পরে বলেছেন, ‘আমি ডানে বামে যেদিকে তাকাচ্ছিলাম নুসাইবাকে দেখছিলাম। প্রতিবারই নুসাইবা আমাকে বাঁচানোর জন্যে সেদিকেই তলোয়ার চালাচ্ছিল।’
তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ ৭০টি আঘাত নিয়েও অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত নবীজীকে রক্ষা করার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করলেন। আক্রমণের একপর্যায়ে আক্রমণকারীরা নবীজীর এত কাছে এসে গিয়েছিল যে, তারা সরাসরি তাঁকে আঘাত করতে সক্ষম হলো। তাঁর ঠোট ও চিবুক কেটে গেল। সামনের একটা দাঁত ভেঙে গেল। শিরস্ত্রাণের ওপর আঘাত লেগে শিরস্ত্রাণ নিচে দেবে গেল। শিরস্ত্রাণের দুই দিকের সংযোগ আংটা চিবুকের ভেতরে বাঁকা হয়ে ঢুকে গেল। কাঁধে তলোয়ারের কঠিন আঘাত লাগল। তবে তলোয়ার বর্ম ভেদ করতে পারে নি। রক্তাক্ত নবীজী মাটিতে পড়ে গেলেন এবং ক্ষণিকের জন্যে জ্ঞান হারালেন।
নবীজীকে আক্রমণোদ্যত আমর ইবনে কামিয়ার মাঝখানে এসময় মুসআব ইবনে উমায়ের এসে পড়লেন। আমরের আঘাত পড়ল মুসআবের ওপর। মুসআব শহিদ হলেন। নবীজীর চেহারার সাথে মুসআবের চেহারার কিছুটা সাযুজ্য ছিল। আর মুসআব সম্ভবত নবীজীর বর্ম পরেছিলেন, যা নবীজী সকালবেলায় বদল করেছিলেন একজন সৈনিকের সাথে।
আমর ইবনে কামিয়ার সাথে সাথে উল্লাসে ফেটে পড়ে ঘোষণা করল, ‘আমি মুহাম্মদকে হত্যা করেছি।’ কোরাইশদের মধ্যে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ল। আর রণক্ষেত্রে সাধারণ মুসলমানরা বিশৃঙ্খলভাবে পাহাড়ের দিকে ছুটতে শুরু করল। মুহাম্মদ (স) নিরাপদে পড়ে রইলেন সহযোদ্ধাদের লাশের মাঝে দুজন আহতের পাশে। মুসলমানদের এই বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে আনাস ইবনে নাদর গর্জন করে উঠলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা কীজন্যে অপেক্ষা করছ? মুহাম্মদ মারা যাওয়ার পর আমাদের আর বেঁচে থেকে লাভ কী? আল্লাহর রসুল যে লক্ষ্য অর্জনে জীবন দিয়েছেন, আসো! আমরাও সে লক্ষ্যে জীবনপাত করি!’
বলেই নবীজী যেদিকে ছিলেন, সেদিকে তলোয়ার চালাতে চালাতে অগ্রসর হলেন। আনাস ইবনে নাদরের শরীরে ৮০টিরও বেশি ক্ষতচিহ্ন ছিল। আঘাতে আঘাতে শরীর এত ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে, তাকে চেনার কোনো উপায় ছিল না। যুদ্ধ শেষে তার বোন তার একটি আঙুলের বিশেষ চিহ্ন থেকে তাকে শনাক্ত করলেন। আনাসের কথায় কোরআনের বাণীই প্রতিধ্বনিত হয়েছে: ‘মুহাম্মদ একজন রসুল মাত্র। তার আগে বহু রসুল গত হয়েছে। এখন সে যদি মারা যায় বা নিহত হয়, তাহলে কি তোমরা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে? সত্য থেকে কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে আল্লাহর কোনো ক্ষতি হবে না; বরং সে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আল্লাহ তাঁর শোকরগোজার বান্দাদের শিগগিরই পুরস্কৃত করবেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৪৪)
আনাস ইবনে নাদেরের গর্জন শুনে বিশ্বাসীরা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করল। আবু বকর, ওমর, আলী প্রমুখ নেতৃস্থানীয় বিশ্বাসীদের মন বলছিল যে, নবীজী বেঁচে আছেন। তারা অনেকের লাশ ডিঙিয়ে রণক্ষেত্রে নবীজীর সর্বশেষ অবস্থানের কাছাকাছি এসে পৌঁছলেন। ইতোমধ্যেই নবীজীর জ্ঞান ফিরে এলো। প্রথমে কাব ইবনে মালিক নবীজীকে শনাক্ত করলেন, বর্মের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া জ্বলজ্বলে চোখ দেখে। তিনি আনন্দধ্বনি দিয়ে উঠলেন, ‘হে মুসলমানরা শোনো! আল্লাহর রসুল এখানে।’ নবীজী তখন তাকে চুপ থাকতে বললেন। ততক্ষণে আবু বকর, ওমর, আলী-এরা কাছে চলে এসেছেন।
নবীজী তাঁর শারীরিক অবস্থা বুঝতে পারলেন। প্রথমে একটু ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘যে জাতি আল্লাহর পথে আহ্বানকারী নবীর মুখে আঘাত করে দাঁত ভেঙে দেয়, তাদের কল্যাণ হবে কেমন করে?’ একজন বললেন, ‘হে আল্লাহর রসুল আপনি এদের অভিশাপ দিন।’ মুখমণ্ডল থেকে রক্ত মুছতে মুছতে নবীজী তার দিকে তাকিয়ে বললেন, মানুষকে অভিশাপ দেয়ার জন্যে নয়, আমি প্রেরিত হয়েছি তাদেরকে দয়া ও ক্ষমার পথে ডাকার জন্যে। তারপর একটু থেমে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার জাতিকে ক্ষমা করে দাও! ওরা অবুঝ, সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ!’
নবীজী মুসআব ইবনে উমায়েরের কাছে দেয়া পতাকা আলীকে তুলে ধরতে বললেন। পতাকা দেখে আস্তে আস্তে বিশৃঙ্খল মুসলমানরা পতাকার দিকে জড়ো হতে শুরু করল। আহত নবীজীকে তারা পাহাড়ের পাদদেশে নিরাপদ স্থানে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। আবু ওবায়দা ইবনে আল জাররাহ নিজের দাঁত দিয়ে নবীজীর চিবুকে ঢুকে যাওয়া শিরস্ত্রাণের বেড়ি আস্তে আস্তে বের করে আনলেন। এতে আবু ওবায়দার সামনের একটা দাঁত ভেঙে গেল। আবু ওবায়দা দ্বিতীয় বেড়িটিও একই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে বের করে আনলেন। এতে আবু ওবায়দার সামনের দুটি দাঁতই ভেঙে গেল। তবু তিনি অন্য কাউকে এ কাজটি করতে দেন নি।
নবীপ্রেমিক আবু ওবায়দা। প্রতিটি যুদ্ধে ছিলেন নবীজীর সহচর। ওহুদে যে ১০ জন সহযোদ্ধা অবিশ্রান্ত তীরের আঘাত থেকে নবীজীকে রক্ষার জন্যে মানব ঢালে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, তিনি তাদেরই একজন। প্রজ্ঞা, বিশ্বস্ততা, আনুগত্য ও অনুসরণে তিনি ছিলেন খলিফাদেরই সমকক্ষ।
এনএস/